ফুটবলে গোল হওয়া মানেই ম্যাচের মোড় ঘুরে যাওয়া। মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতি মুহূর্তে স্ট্রাইকারদের কাঁধে থাকে প্রত্যাশার তুমুল চাপ। নিয়মিতভাবে জালে বল জড়ানোই ভাল খেলোয়াড়দের সঙ্গে মহান খেলোয়াড়দের দূরত্ব তৈরি করে দেয়। গোল্ডেন বুট পুরস্কার সেই ধারাবাহিকতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) প্রতি মরশুম শেষে সর্বোচ্চ গোলদাতাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয় এবং ১১ মরশুমে ১০ জন ভিন্ন ফুটবলার এই খেতাব অর্জন করেছেন।

গোল্ডেন বুটের লড়াইও প্রতি মরশুমে দিয়েছে প্রচুর নাটকীয় মুহূর্ত। কয়েকটি মরশুমে একজন স্ট্রাইকার একচেটিয়া আধিপত্য দেখিয়েছেন। তবে ভক্তদের সবচেয়ে বেশি মনে আছে সেই রোমাঞ্চকর দ্বৈরথগুলি, যেখানে একাধিক তারকা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমানে সমান লড়াই করেছেন। এই বিশেষ প্রতিবেদনে আমরা ফিরে দেখব আইএসএল ইতিহাসের কয়েকটি সবচেয়ে বিনোদনপূর্ণ গোল্ডেন বুটের প্রতিযোগিতা।

আইএসএল ২০১৫ – মেন্ডোজা বনাম হিউম

আইএসএলের দ্বিতীয় মৌসুমে গোল্ডেন বুটের দৌড় দর্শকদের চোখ আটকে রেখেছিল প্রতিটি মুহূর্তে।স্টিভেন মেন্ডোজাইয়েন হিউম মুখোমুখি লড়াইয়ে লিগকে আলোকিত করেছিলেন তাদের গোলের লড়াই দিয়ে। হিউম শুরুতে ধীরগতিতে এগোন, কিন্তু মরশুমের গুরুত্বপূর্ণ পর্বে টানা পাঁচ ম্যাচে গোল করে দুর্দান্ত ছন্দে ফেরেন, যার মধ্যে এফসি পুনে সিটির বিপক্ষে একটি হ্যাটট্রিকও ছিল। তার এই দারুণ জ্বলে ওঠা দেখে মনে হচ্ছিল, হয়তো তিনি মেন্ডোজাকে পিছনে ফেলে শীর্ষে পৌঁছবেন।

কিন্তু কলম্বিয়ান ফরোয়ার্ডের পরিকল্পনা ছিল অন্য।চেন্নাইন এফসি-র হয়ে আক্রমণের নেতৃত্বে মেন্ডোজা প্রতিপক্ষের গোলের সামনে ছিলেন নির্মম। হিউমের মতো তিনিও লিগ পর্বে দুটি হ্যাটট্রিক করেছিলেন। নিয়মিত মরশুম শেষে মেন্ডোজা ১১–১০ গোলের ক্ষীণ ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। প্লে-অফে এসে তিনি আরও দুটি গোল করেন, যেখানে হিউম করতে পেরেছিলেন মাত্র একটি। ফলে গোল্ডেন বুট জিতে নেন মেন্ডোজা, আর হিউমকে সামান্য ব্যবধানে পিছিয়ে পড়তে হয়।

আইএসএল ২০১৯-২০ – ত্রিমুখী লড়াই

২০১৯–২০ মরশুম আইএসএল ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় গোল্ডেন বুট সমাপ্তি উপহার দিয়েছিল। চেন্নাইন এফসিরনেরিউস ভাল্সকিস, এটিকে এফসিররয় কৃষ্ণা এবংকেরালা ব্লাস্টার্স-এরবার্থোলোমিউ ওগবেচে – তিনজনই ১৫ গোল করে মরশুম শেষ করেন, যা সেরা গোলদাতার লড়াইকে রূপ দেয় উত্তেজনায় ঠাসা রোলার কোস্টারে।

কৃষ্ণা দুর্দান্ত সূচনার মাধ্যমে প্রথম কয়েক সপ্তাহেই তালিকার শীর্ষে ছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভাল্সকিস তাঁর ধার ফিরে পান এবং ধীরে ধীরে ব্যবধান কমাতে থাকেন। অপরদিকে, ওগবেচে মরশুমের শেষদিকে বিস্ফোরক ফর্মে উঠে এসে শীর্ষে থেকে লিগ পর্ব শেষ করেন। তবে প্লে-অফে কেরালা ব্লাস্টার্সের অনুপস্থিতি তাঁর গোল্ডেন বুট জয়ের সম্ভাবনাকে যথেষ্ট ক্ষীণ করে দেয়।

তখন নিয়ম ছিল—যদি দুই বা ততোধিক খেলোয়াড় সমান সংখ্যক গোল করে মরশুম শেষ করেন, তা হলে বেশি অ্যাসিস্ট থাকা খেলোয়াড় গোল্ডেন বুট পাবেন। যদি গোল ও অ্যাসিস্ট দুই ক্ষেত্রেই সমান হয়, তবে কম সময় খেলা খেলোয়াড়কে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।

প্লে-অফে কৃষ্ণা একটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট যোগ করেন, আর ভালস্কিস করেন দুটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট। দুজনেরই মরসুম শেষ হয় ১৫ গোল ও ছটি করে অ্যাসিস্ট নিয়ে। অন্যদিকে, ওগবেচের ছিল মাত্র একটি অ্যাসিস্টে। ফলে শেষ লড়াই জমে ওঠে ভালস্কিস ও কৃষ্ণার মধ্যে। মাঠে কম সময় থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত ভালস্কিসের হাতেই ওঠে গোল্ডেন বুট।

আইএসএল ২০২০–২১ – আঙ্গুলোর স্বপ্নের অভিষেক

ইগর আঙ্গুলো-র প্রথম আইএসএল মরশুমই ছিল ব্লকবাস্টার। এই স্প্যানিশ ফরোয়ার্ডএফসি গোয়া-র আক্রমণকে আলোকিত করেছিলেন এবং রয় কৃষ্ণার সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন গোল্ডেন বুটের এক রোমাঞ্চকর প্রতিযোগিতা। প্রথম দিন থেকেই দুজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন এবং প্রায় প্রতি সপ্তাহেই শীর্ষস্থান হাতবদল হয়েছে।

লিগ পর্বের শেষে কৃষ্ণা মাত্র এক গোলের ব্যবধানে আঙ্গুলোর চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তবে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে আঙ্গুলো গোল করে গোলসংখ্যায় সমতা এনে ফেলেন (১৪ গোল)। কৃষ্ণা প্লে-অফে চারটি অ্যাসিস্ট যোগ করলেও গোলের দেখা পাননি।

তখনকার নিয়ম অনুযায়ী, যদি একাধিক খেলোয়াড় সমান সংখ্যক গোল করেন, তবে মাঠে কম সময় থাকা খেলোয়াড় গোল্ডেন বুট পাবেন। সেই অনুযায়ী, কম মিনিট খেলার সুবাদে আঙ্গুলো শেষ পর্যন্ত গোল্ডেন বুট জেতেন, তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেছনে ফেলে।

আইএসএল ২০২২–২৩ – মরিসিও, সিলভা ও পেট্রাটসের মরশুম

২০২২–২৩ আইএসএল মরশুম উপহার দিয়েছিল লিগের ইতিহাসে গোল্ডেন বুটের তীব্রতম প্রতিযোগিতার অন্যতম। আটজন খেলোয়াড় এই দৌড়ে ছিলেন, যার মধ্যে তিনজন শেষ করেন ১২ গোল নিয়ে, দুজন ১১ গোল নিয়ে এবং আরও তিনজন ১০ গোল নিয়ে। ফলে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত লড়াই পুরোপুরি জিইয়ে ছিল।

ওডিশা এফসিতে ফিরে আসাদিয়েগো মরিসিও শেষদিকে দারুণ ফর্মে উঠে আসেন, অন্যদিকে,ইস্টবেঙ্গল এফসিক্লেটন সিলভা উপভোগ করেন দুর্দান্ত গোলের ধারাবাহিকতা।মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট-এরদিমিত্রিয়স পেট্রাটস নকআউট পর্বে তিনটি গোল করে বেশ এগিয়ে যান। যার মধ্যে ফাইনালে ছিল জোড়া গোল।

শেষ পর্যন্ত তিনজনই ১২ গোল নিয়ে শীর্ষে থাকেন। সিলভা প্লে-অফ মিস করায় এবং পেট্রাটস দারুণ ফর্মে ফিরেও সেই সংখ্যা বাড়াতে ব্যর্থ হওয়ায়, মরিসিও তাঁর উন্নত মিনিট-প্রতি-গোল অনুপাতের সুবাদে এগিয়ে যান এবং আইএসএল ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর গোলদাতার দৌড়ে গোল্ডেন বুট জিতে নেন

আইএসএল ২০২৩–২৪ – দিয়ামান্তাকস বনাম কৃষ্ণা

আরেকটি মরশুম, গোল্ডেন বুটের জন্য আরেকটি রোমাঞ্চকর দৌড়। ন’জন খেলোয়াড় দু’অঙ্কের গোল নিয়ে মরশুম শেষ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই পরিণত হয় মুখোমুখি দ্বৈরথে—রয় কৃষ্ণা ওদিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস দুজনেই মরশুম শেষ করেন ১৩ গোল নিয়ে। ওডিশা এফসির হয়ে কৃষ্ণা আবারও দেখান তাঁর ধারাবাহিকতা। নিয়মিত গোল করে দলকে সেমিফাইনালে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি।

অন্যদিকে, কেরালা ব্লাস্টার্স এফসির হয়ে দিয়ামান্তাকস ছিলেন ধ্বংসাত্মক ফর্মে। প্রতিপক্ষের গোলের সামনে বারবার নির্মম হয়ে উঠে মাত্র ১৭ ম্যাচ খেলে ১৩ গোল করেন তিনি। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টেরজেসন কামিংস ফাইনালে পৌঁছনোর সুবাদে খানিকটা সুযোগ পেলেও, প্লে-অফে দুটি গোল করে তিনি শেষ করেন ১২ গোল নিয়ে।

শেষ পর্যন্ত মিনিট-প্রতি-গোল অনুপাতের দৌড়ে এগিয়ে থেকে গোল্ডেন বুট জিতে নেন দিয়ামান্তাকস, আর অল্পের জন্য আবারও পিছিয়ে পড়েন কৃষ্ণা।