প্রথমে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে কোনও গোল না হওয়া। শেষে উত্তেজনায় ঠাসা টাই ব্রেকার ও সাডেন ডেথ। রবিবার রাতে ফতোরদার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে সুপার কাপ ফাইনালের দর্শকেরা প্রায় সারাক্ষণই উত্তেজনায় কাঁপল। অবশেষে টাই ব্রেকারের তুমুল চাপ সামলে সুপার খেতাব জিতে নিল এফসি গোয়া। পেনাল্টি শুট আউটে ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে ৬-৫-এ হারিয়ে তৃতীয় বারের জন্য সুপার কাপ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করে নিল তারা।

এ দিন ফাইনালে নির্ধারিত সময়ে কোনও গোল না হওয়ার পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও কোনও পক্ষই গোল করতে পারেনি। দু’পক্ষই প্রচুর সুযোগ তৈরি করা ও শট গোলে রাখা সত্ত্বেও গোল না পাওয়ায় অবধারিত ভাবে খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুট আউটে।

প্রথম পাঁচটি করে শটে দুই দলই একবার করে ব্যর্থ হওয়ায় স্কোর দাঁড়ায় ৪-৪। ফলে ম্যাচের ফয়সালা হয় সাডেন ডেথ-এ। যার প্রথম রাউন্ডে দু’পক্ষই গোল করলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে বল গোলে রাখতে পারেননি ইস্টবেঙ্গলের তরুণ ফরোয়ার্ড পিভি বিষ্ণু। শেষে স্থানীয় তারকা সাহিল তাভোরাই প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দলকে চ্যাম্পিয়নের খেতাব এনে দেন।

এ দিন শুরুতেই গোলের বাইরে বল পাঠিয়ে দলকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছিলেন এফসি গোয়ার অধিনায়ক বোরহা হেরেরা। তবে পরের স্পট কিকগুলির একটিও মিস করেননি হাভিয়ে সিভেরিও, দেজান দ্রাজিচ, মহম্মদ নেমিল, ডেভিড তিমর, উদান্ত সিং ও সাহিল তাভোরা।

ইস্টবেঙ্গল এফসি-র কেভিন সিবিল সফল জালে বল জড়িয়ে পেনাল্টি শুট আউট শুরু করেন। সল ক্রেসপো ও মিগুয়েল ফিগুয়েরা সেই সাফল্যের ধারা বজায় রাখলেও মহম্মদ রশিদ ব্যর্থ হওয়ায় দল বেশ চাপে পড়ে যায়। আনোয়ার আলি ও হামিদ আহদাদও তাদের দায়িত্ব সফল ভাবেই পালন করেন। কিন্তু শেষে পিভি বিষ্ণু-র শট বারের উপর দিয়ে উড়ে যেতেই উল্লাসে ফেটে পড়েন গোয়ার ফুটবলার, কোচেরা ও গ্যালারিতে থাকা তাদের সমর্থকেরা।

এ দিন নির্ধারিত সময়ে শুরুর দিকে বলের দখল বাড়িয়ে মাঠের নিয়ন্ত্রণ আনার প্রবণতা দেখা যায় ইস্টবেঙ্গলের খেলায়। আক্রমণে খুব বেশি না উঠলেও তাদের চেষ্টাই দেখা যায় বেশি। ১২ মিনিটের মাথায় ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে গোল মিস করেন মিগুয়েল ফিগুয়েরা। ডানদিক দিয়ে বক্সে ঢুকে দ্বিতীয় পোস্টের দিক দিয়ে গোল করতে যান তিনি। কিন্তু তাঁর শট অল্পের জন্য পোস্টের বাইরে বেরিয়ে যায়।

ম্যাচের ২০ মিনিটের মাথায় মাঝমাঠ থেকে হিরোশির দেওয়া বল নিয়ে বাঁ উইং দিয়ে উঠে বক্সের মধ্যে নিখুঁত ক্রস বাড়ান বিপিন সিং। বলে সঠিক ভাবে পা ছোঁয়াতে পারলে হয়তো গোল পেতেন নাওরেম মহেশ সিং কিন্তু প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারের চাপে ব্যর্থ হন তিনি।

প্রথমার্ধের মাঝামাঝি, ২৬ মিনিটের মাথায় চোটের কারণে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন গোয়ার দুই ডিফেন্ডার বরিস ও রনি। পরিবর্তে মাঠে নামেন নিম দোরজিউদান্ত সিং এখানেই এফসি গোয়া কিছুটা হলেও ধাক্কা খায়। রক্ষণে নতুন কম্বিনেশন তৈরি করতে হয় তাদের। তবে এই সুযোগ ইস্টবেঙ্গল তেমন ভাবে কাজে লাগাতে পারেনি, প্রতিপক্ষ নতুন করে রক্ষণ গোছানোতে মন দেওয়ায় এবং বলের দখল বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করায়।

পাল্টা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও শুরু করে গতবারের চ্যাম্পিয়নরা। ৩৯ মিনিটের মাথায় উদান্তর উদ্দেশ্যে বাড়ানো ব্রাইসনের ক্রস আনোয়ার আলি ক্লিয়ার না করলে হয়তো বিপদে পড়ত লাল-হলুদ বাহিনী। প্রথমার্ধের গোলের সামনে তাদের ফিনিশিংয়ের অভাব স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে। সারা অর্ধে একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি এফসি গোয়া।

প্রথমার্ধের শেষ দিকে ইস্টবেঙ্গলের একমাত্র গোলমুখী শটটি আসে মহেশের পা থেকে, ৪৩ মিনিটের মাথায় গোয়ার বক্সের বাঁ দিকে অনেকক্ষণ বল পায়ে রাখার পর যখন মহেশের উদ্দেশ্যে ক্রস বাড়ান বিপিন। তখন অবধারিত গোলের সুযোগ পায় লাল-হলুদ বাহিনী। তবে মহেশের গোলমুখী শট দক্ষতার সঙ্গে সেভ করেন হৃত্বিক তিওয়ারি

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে দেখা যায় গোয়ার দলকে। শুরুতেই আয়ূষ ছেত্রীর দূরপাল্লার শট অল্পের জন্য বারের উপর দিয়ে চলে যায়। ৫০ মিনিটের মাথায় পরপর দুবার গোলের সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ হন বোরহা প্রথমবার গোলে শট নিতে পারেননি, পরেরবার ঠিকমতো হেড করতে পারেননি।

ঘন ঘন আক্রমণে ওঠার সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণের চেষ্টা মাঝমাঠেই ব্যর্থ করার প্রবণতা দেখা যায় গোয়ার খেলায়। তাও ৬৩ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিক দিয়ে উঠে গোলের সামনে হিরোশির উদ্দেশ্যে নিখুঁত ক্রস উড়িয়ে দেন বিপিন। কিন্তু হিরোশির হেড সোজা গোলকিপারের হাতে জমা হয়ে যায়।

আক্রমণে ধার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মহেশকে ৬৪ মিনিট পর্যন্ত মাঠে রেখে তাঁর পরিবর্তে পিভি বিষ্ণু-কে নামায় ইস্টবেঙ্গল। মাঠে নামার দশ মিনিটের মধ্যেই দুই ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে বক্সে ঢুকে গোলে বল ঠেলেন বিষ্ণু, যা হৃত্বিকের হাত ফস্কে গোলের দিকে যায়। কিন্তু পিছন দিকে দৌড়ে বল গোল লাইনের বাইরে বের করে দিয়ে অনবদ্য রিফ্লেক্সের পরিচয় দেন গোয়ার গেলপ্রহরী।

বিষ্ণুর এই গোলের সুযোগের চেষ্টার মিনিট তিনেকের মধ্যে, ৭৭তম মিনিটে পরপর দু’টি গোলের সুযোগ পায় এফসি গোয়া। প্রথমে ব্রাইসনের দূরপাল্লার জোরালো শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। পরের মিনিটেই বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢোকা বোরহার হেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এর দু’মিনিট পরেই মাঝমাঠ থেকে নেওয়া পল মোরিনোর লম্বা ভলি ডিপ করে ইস্টবেঙ্গলের বারে গিয়ে লাগে। তৎপর প্রভসুখন গিল অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে বলের দখল নিয়ে দলকে বিপদমুক্ত করেন।

রক্ষণ ও আক্রমণে যথাক্রমে জয় গুপ্তাডেভিড লালনসাঙ্গা কে নামায় ইস্টবেঙ্গল, চুঙনুঙ্গা ও হিরোশির জায়গায়। তাতে অবশ্য দমানো যায়নি এফসি গোয়াকে। ম্যাচের শেষ দিকে ঘন ঘন গোলের চেষ্টা চালিয়ে যায় তারা এবং ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণও ছিল সদাতৎপর। তিন মিনিটের সংযুক্ত সময়েও ফল অর্জন করতে পারেনি কোনও পক্ষই।

অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধে বিপিনের জায়গায় নামেন চোট সারিয়ে মাঠে ফেরা হামিদ আহদাদ। অন্যদিকে এফসি গোয়াও ব্রাইসন ও আয়ূষের বদলে নামায় সাহিল তাভোরা ও আবদুল রাবি। স্বাভাবিক ভাবেই এই আধঘণ্টায় খেলোয়াড়দের শরীরে ক্লান্তির ছাপ ছিল স্পষ্ট।

তবে দ্বিতীয়ার্ধে খেলা জমে ওঠে। এফসি গোয়া পরপর যে রকম গোলের সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ হয়, তা ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য। গোলের সামনে থেকে বল গিলের হাতে জমা করে দেন হাভিয়ে সিভেরিও তার আগে দেজান দ্রাজিচ বক্সের বাইরে থেকে গোলে যে শট নিয়েছিলেন, সেই শটই লাল-হলুদ গোলকিপারের হাতে লেগে সিভেরিওর কাছে আসে। কর্নার থেকে ডেভিড তিমর হেড করে গোলের দিকে বল পাঠালেও তা আটকে দেন আনোয়ার।

ইস্টবেঙ্গলও গোল পেতে পারত, যদি তিমরের ক্লিয়ারেন্স থেকে সল ক্রেসপোর দূরপাল্লার শট সোজা হৃত্বিকের হাতে না পৌঁছে যেত। অতিরিক্ত সময়ে এই একটিই সুবর্ণ সুযোগ পায় তারা। ১২০ মিনিটের খেলায় ইস্টবেঙ্গল পাঁচটি ও এফসি গোয়া চারটি শট গোলে রাখলেও কোনও পক্ষই একে অপরের জালে বল জড়াতে পারেনি। অবধারিত ভাবে খেলা টাই ব্রেকারে গড়ায়।