আইএসএলে কলকাতার ক্লাবের জার্সি গায়ে মাঠ মাতানো বিদেশি অ্যাটাকাররা
আইএসএলের ক্লাবগুলিতে এখন বিদেশি ফুটবলারদের ছড়াছড়ি। গত আইএসএল মরশুমে সংখ্যাটা ছিল ৮৪। গত এগারোটি মরশুমে কলকাতার দলগুলির হয়ে এ পর্যন্ত একশোরও বেশি বিদেশি ফুটবলার খেলেছেন।

কলকাতার ক্লাব ফুটবলে বিদেশিদের আনাগোনা বহু দশক আগে থেকে। মজিদ বিসকার, চিমা ওকেরি, জামশেদ নাসিরি, থেকে শুরু করে হাল আমলের জেমি ম্যাকলারেন পর্যন্ত কত যে বিদেশি ফুটবলার কলকাতায় খেলে গিয়েছেন এবং এ শহরের ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করে গিয়েছেন, তার কোনও ঠিক নেই।
সেই ধারা আজও চলে আসছে। শুধু কলকাতা নয়, সারা ভারতের ক্লাবগুলিতেই এখন বিদেশি ফুটবলারদের ছড়াছড়ি। গত আইএসএল মরশুমে সংখ্যাটা ছিল ৮৪। আইএসএলের গত এগারোটি মরশুমে কলকাতার দলগুলির হয়ে একশোরও বেশি বিদেশি ফুটবলার খেলেছেন সব পজিশনেই। তাঁদের মধ্যে আক্রমণ বিভাগের সবচেয়ে সফল ফুটবলারদের নিয়ে নিয়ে এই প্রতিবেদন।
রয় কৃষ্ণা (এটিকে, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট)
কলকাতার ক্লাবে খেলে যাওয়া সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের অন্যতম ফিজির এই তারকা স্ট্রাইকার, যিনি তাঁর গতি ও ক্ষিপ্রতাকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক অসাধারণ গোল করেছেন ও সমর্থকদের মন মাতিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে এটিকে ও পরে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হয়ে মাঠে নেমে ধারাবাহিক ভাবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন রয়। এ লিগে ওয়েলিংটন ফিনিক্সে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পর ২০১৯-এ ভারতে এসে এটিকে-র হয়ে ২১টি ম্যাচে ১৫টি গোল করেন ও ছ’টি গোলে অ্যাসিস্ট করেন। সারা মরশুমে মোট ২৫টি গোলের সুযোগ তৈরি করেন এবং তাঁর ৫৫টি শটের মধ্যে ২৫টি-ই ছিল গোলের লক্ষ্যে। পরে যখন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দেন, তখন দুই মরশুমে ৩৯টি ম্যাচে ২১টি গোল করেন ও ১২টিতে অ্যাসিস্ট করেন তিনি। ৪৮টি গোলের সুযোগ তৈরি করেন ও তাঁর ১০২টি শটের মধ্যে ৪১টিই ছিল গোলে। তবে শুধু আক্রমণে নয়, প্রয়োজনে মাঝমাঠে, এমনকী, রক্ষণেও নেমে এসে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন রয়।
দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট)
২০২২-এ সৌদি আরবের আল ওয়েহদা থেকে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দেওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনি এই ক্লাবেই রয়ে গিয়েছেন। সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে ৭০টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে তাঁর। আইএসএলের ইতিহাসে আর কোনও বিদেশি ফুটবলার কোনও একটি ক্লাবের হয়ে এতগুলি ম্যাচ খেলেননি। ইস্টবেঙ্গলে ক্লেটন সিলভা, মোহনবাগানে কার্ল ম্যাকহিউরা দীর্ঘদিন দলে থাকলেও এত ম্যাচ খেলেননি, যা কি না পেট্রাটস খেলেছেন। সেই কারণেই সবুজ-মেরুন সমর্থকদের কাছে প্রিয় দিমি হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে গানও বেঁধে ফেলেছেন সমর্থকেরা। এই ক্লাবের জার্সি গায়ে ৫১১৭ মিনিট মাঠে থেকেছেন তিনি। ২৬টি গোল করেছেন ও ১৭টি করিয়েছেন। এও এক নজির। কলকাতার ক্লাবে খেলা আর কোনও ফুটবলার এতগুলি (৪৩) গোলে প্রত্যক্ষ অবদান রাখতে পারেননি। নজির শুধু গোলেই নেই। গোলের সুযোগ তৈরিতেও, এ পর্যন্ত যার সংখ্যা ১৫৬। শট মেরেছেন ১৯৮টি, যার মধ্যে ৭২টি ছিল লক্ষ্যে। লিগের ইতিহাসে এমন ক্ষিপ্র ও সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকার কমই দেখা গিয়েছে।
ক্লেটন সিলভা (ইস্টবেঙ্গল এফসি)
পরিসংখ্যানে ও পারফরম্যান্সে রয়, দিমি-দের সঙ্গে যদি কেউ পাল্লা দিতে পারেন, তা হলে তিনি ইস্টবেঙ্গলের ব্রাজিলীয় তারকা ক্লেটন সিলভা। ২০২০-তে তিনি ভারতে আসেন বেঙ্গালুরু এফসি-র ডাকে। সেখানে দু’বছর কাটিয়ে ২০২২-এ যোগ দেন ইস্টবেঙ্গল এফসি-তে। লাল-হলুদ বাহিনীতে খেলা বিদেশি ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার তাঁকেই মাঠে দেখা গিয়েছে। অসাধারণ কিছু গোলও করেছেন তিনি। মোট ৫৯ ম্যাচে ২০টি গোল করেছেন ও ছ’টি গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন ক্লেটন। এক সময়ে ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণে প্রধান ভরসা ছিলেন ব্রাজিল থেকে আসা এই ফরোয়ার্ডই। এর আগে কলকাতার ফুটবলে আগমন ঘটেছিল আর এক ব্রাজিলীয় হোসে রামিরেজ ব্যারেটোর। লাল-হলুদ সমর্থকেরা অবশেষে সেই ব্রাজিলীয় ফুটবলের জাদু দেখতে পান ক্লেটনের পারফরম্যান্সে। ৭৪টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি। তবে তাঁর সমস্যা ছিল সঠিক শট নেওয়ায়। ১৫৬টি শট নিলেও ৫৫টির বেশি গোলে রাখতে পারেননি তিনি। গত মরশুমের পরই ব্রাজিলে ফিরে গিয়েছেন তিনি।
ইয়েন হিউম (এটিকে)
কলকাতার ক্লাবে খেলে যাওয়া সফল বিদেশি ফরোয়ার্ডদের মধ্যে অবশ্যই থাকবেন কানাডার ইয়েন হিউম। আইএসএলের প্রথম বছরেই ভারতে আসেন তিনি। যোগ দেন কেরালা ব্লাস্টার্সে। ২০১৫-য় যোগ দেন এটিকে-তে। কলকাতার ক্লাবের জার্সি গায়ে মাতিয়ে দেন ফুটবলপ্রেমীদের। এটিকে-র হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল যেমন করেছেন তিনিই, তেমনই সবচেয়ে বেশি গোল অবদানও তাঁর। ৩০টি ম্যাচ খেলে মোট ১৮টি গোল করেন হিউম এবং অ্যাসিস্ট করেন চারটিতে। অর্থাৎ, ২২টি গোলে তাঁর অবদান ছিল, রয় কৃষ্ণার চেয়ে একটি বেশি। তাঁর নির্ভুল শটের পরিসংখ্যানও মনে রাখার মতো। ৬৮টির মধ্যে ৩৫টিই ছিল লক্ষ্যে। ৩৯টি সুযোগও তৈরি করেছিলেন। ২০২৬-য় এটিকে-র আইএসএল খেতাব জয়ে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সে বার সাতটি গোল করেন। সেমিফাইনালের প্রথম লেগে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেন তিনি।
ডেভিড উইলিয়ামস (এটিকে, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট)
রয় কৃষ্ণার সঙ্গে ওয়েলিংটন ফিনিক্স ছেড়ে ভারতে আসেন ডেভিড। সেই বছরই, ২০১৯-এ এটিকে-তে যোগ দেন এই অস্ট্রেলীয় তারকা। অস্ট্রেলিয়ার লিগ মাতিয়ে ভারতে আসা দুই সতীর্থ সে বার লিগ মাতিয়ে দেন। রয়-ডেভিডের জুটি বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। তাদের জুগলবন্দি প্রতিপক্ষের কাছে হয়ে ওঠে ত্রাস। এটিকে-র জার্সি গায়ে ১৮টি ম্যাচ খেলে ডেভিড সাতটি গোল করেন ও পাঁচটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন। পরের বছর মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দেন। তাদের হয়ে দুই মরশুমে ৩৭টি ম্যাচ খেলেন ও দশটি গোল করেন। গোলের সংখ্যা কম হলেও তাঁর বেশিরভাগ গোলই দলের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ২০১৯-২০ মরশুমে চেন্নাইন এফসি ও বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে দুই ম্যাচেই এটিকে ১-০-য় জিতেছিল এবং দুই ম্যাচেই একমাত্র গোল করেন ডেভিড। ২০২০-২১-এও দক্ষিণের এই দুই দলের বিরুদ্ধে গোল করেই জেতান ডেভিড। সে বার কলকাতা ডার্বিতেও গোল করেন তিনি। প্লে অফে দুই সেমিফাইনাল ও ফাইনাল, সব ম্যাচেই গোল করেন। পরের মরশুমে অবশ্য চারটির বেশি গোল করতে পারেননি ডেভিড। তবে তাঁর গোলেই মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এই জন্যই কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের মনে রয়েছে তাঁকে।
হুগো বুমৌস (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট)
স্ট্রাইকার না হলেও এই ফরাসি তারকার দিকে সমর্থকেরা তাকিয়ে থাকেন গোলের জন্য। হুগোর গোলের সামনে যাওয়া মানেই প্রতিপক্ষের বিপদ আসন্ন। তাই এই তারকা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারকে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা রাখেন চোখে চোখে। ২০১৮-য় ভারতে এসে তিনি প্রথম এফসি গোয়ায় যোগ দেন, তখন তাদের কোচ ছিলেন সের্খিও লোবেরা। ২০২০-তে যান মুম্বই সিটি এফসি-তে। ২০২১-এ সই করেন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে। তখন তিনি ফর্মের শিখরে। কলকাতার দলে দুই মরশুমে ৪৫টি ম্যাচ খেলেছেন। ১১টি গোল করেছেন, ন’টি করিয়েছেন। প্রতিপক্ষের গোলের উদ্দেশ্যে ৫৬টি শট মেরেছেন। কিন্তু ২০টি নিশানায় ছিল। তবে মাঝমাঠ থেকে গোল তৈরিতে তিনি বিশেষজ্ঞ। গোলের পাস বাড়ানোর ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সবুজ-মেরুন জার্সিতে ৪৫টি ম্যাচে ১০৪টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন। কলকাতায় খেলা বিদেশিদের মধ্যে গোলের সুযোগ তৈরিতে দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (১৫৬) ছাড়া আর কেউ হুগোকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি।
জেসন কামিংস (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট)
রয় কৃষ্ণার সঙ্গে ডেভিড উইলিয়ামস যেমন বিধ্বংসী জুটি বেঁধেছিলেন, তেমনই মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে আরও এক জুটি বাঁধেন দিমি পেট্রাটস ও জেসন কামিংস। ২০২৩-এ অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কোস্ট মেরিনার্স থেকে কলকাতার মেরিনার্সের দলে যোগ দেন বিশ্বকাপার জেসন, যিনি বিশ্বকাপ ২০২২-এ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে নেমেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। ২০৩-২৪ আইএসএল মরশুমে ১২টি ও ২০২৪-২৫-এ সাতটি গোল করেন তিনি। আটটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন তিনি। ৪৩টি গোলের সুযোগ তৈরি করেন ও ৮০টি শটের মধ্যে ৩৯টি রাখেন লক্ষ্যে। ২০২৩-২৪-এ কলকাতা ডার্বিতে তাঁর গোল হয়তো অনেকেরই মনে আছে। সেই সময় টানা তিনটি ম্যাচে গোল পান তিনি। সেবার সেমিফাইনাল ও ফাইনালেও গোল করেন তিনি। গত মরশুমে তিনি লিগের ১১টি ম্যাচে শুরু থেকে নামেন। ১৪টি ম্যাচে তাঁকে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামানো হয়। তবে কার্যকরী ফুটবলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জেসন। যে সময় অসংখ্য গোলের সুযোগ পেয়েও তা থেকে গোল করতে পারছিলেন না, সেই সময় তিনি অ্যাসিস্টে মন দেন এবং তাঁর পাস থেকে একাধিক গোল পান জেমি ম্যাকলারেন। নিজেকে কার্যকর হিসেবে বজায় রাখতে সব রকম দায়িত্বই পালন করেছেন তিনি।
এ ছাড়াও যাঁরা আইএসএলে কলকাতার ক্লাবগুলির আক্রমণ বিভাগে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন:
এটিকে- সমিঘ দৌতি (দক্ষিণ আফ্রিকা, ৫ গোল, ১০ অ্যাসিস্ট), এডু গার্সিয়া (স্পেন, ৯, ৫), মানুয়েল লানজারোতে (স্পেন, ৫, ২), তেফেরা ফিকরু (ইথিওপিয়া, ৫, ৩), রবি কিন (আয়ারল্যান্ড, ৬)।
মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট- জনি কাউকো (ফিনল্যান্ড, ৬ গোল, ১০ অ্যাসিস্ট), জেমি ম্যাকলারেন (অস্ট্রেলিয়া, ১২, ২), আলবার্তো রড্রিগেজ (স্পেন, ৫, ১), আরমান্দো সাদিকু (আলবানিয়া, ৮, ১)।
ইস্টবেঙ্গল এফসি- সউল ক্রেসপো (স্পেন, ৫ গোল, ২ অ্যাসিস্ট)।