২০২০-২১ মরশুমে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) অভিযান শুরুর পর থেকে ইস্টবেঙ্গল এফসি বারবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। লিভারপুল কিংবদন্তি রবি ফাউলারের অধীনে শুরু হয়েছিল কলকাতার এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের আইএসএল অধ্যায়। যদিও তারা এ পর্যন্ত পাঁচটি মরশুমের একটিতেও প্লে-অফে উঠতে পারেনি, তবু মাঝেমধ্যে তারা নিজেদের ক্ষমতা ও দক্ষতার ঝলক দেখিয়েছে। যদিও ধারাবাহিকতার অভাবই তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

তবে এই পাঁচ বছরে লাল-হলুদ বাহিনীতে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের অভাব ছিল না। লাল-হলুদ জার্সি গায়ে ক্লাবকে তার কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন অনেকেই। এই প্রতিবেদনে তাঁদের নিয়েই গড়া ক্লাবের সেরা আইএসএল একাদশ তুলে ধরা হল।

গোলরক্ষক: প্রভসুখন সিং গিল

সুব্রত পাল থেকে অরিন্দম ভট্টাচার্য, দেবজিৎ মজুমদার – বহু অভিজ্ঞ গোলকিপার ইস্টবেঙ্গলে খেলেছেন। তবে তরুণ প্রভসুখন সিং গিল নিজের দক্ষতায় নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেছেন। কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি-তে উত্থানের পর গিল ২০২৩ সালে লাল-হলুদে যোগ দেন। ২০২১-২২ মরশুমে গোল্ডেন গ্লাভ জেতা গিল ক্লাবের রক্ষণে স্থিতিশীলতা আনতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনি ক্লাবের হয়ে ১৩টি ম্যাচে গোল অক্ষত রেখেছেন।

রাইট ব্যাক: মহম্মদ রকিপ

আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে বরাবরই দুর্বলতা ছিল। রাইট ব্যাক পজিশনেও তাই। অঙ্কিত মুখার্জি বা সুমিত পাসি, কেউই নিজেকে সে ভাবে প্রমাণ করতে পারেননি। তবে ২০২২ সালে যোগ দেওয়া রকিপ তিন মরশুম ধরে ধারাবাহিকভাবে খেলেছেন। ৪০টি ম্যাচ খেলেন তিনি এবং সময়ের সাথে সাথে ক্রমশ উন্নতি করেন।

সেন্টার-ব্যাক: হিজাজি মাহের ও লালচুংনুঙ্গা

ড্যানিয়েল ফক্স থেকে আদিল খান, বহু দেশি-বিদেশি সেন্টার-ব্যাক ইস্টবেঙ্গল শিবিরে এলেও স্থিতিশীলতা আনতে পারেননি। কিন্তু জর্ডানের হিজাজি মাহের এসেই রক্ষণে দৃঢ়তা আনেন। ২০২৩-২৪ মরশুমে জর্ডান এলসির বদলে দলে যোগ দেন মাহের। দুই মরশুমে ৩০টি ম্যাচে খেলেছেন, ৯টি ক্লিন শিট রেখেছেন ও ২টি গোল করেছেন। যদিও

চোটের কারণে ২০২৪-২৫ মরশুমে কম সময় (১১২৩ মিনিট) খেলেছেন। তিনিই এ পর্যন্ত ক্লাবের সবচেয়ে সফল বিদেশি ডিফেন্ডার। লালচুংনুঙ্গার উত্থান ছিল অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো। ২০২২-২৩ মরশুমে শুরু করে নিজের শক্তি, পজিশনিং ও ডুয়েল জেতার ক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে দলে পাকা জায়গা অর্জন করেন তিনি। ৫৪টি ম্যাচ খেলে ১১টি ক্লিন শিটও রাখতে সাহায্য করেন দলকে। প্রথমে সেন্টার ব্যাক হিসেবেই খেলতেন। পরে দলে আনোয়ার আলি এসে যাওয়ায় লেফট ব্যাক হিসেবে খেলতে শুরু করেন। জায়গা বদলালেও যথেষ্ট ভাল পারফরম্যান্স দেখান তিনি।

লেফট ব্যাক: নিশু কুমার

কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে লিয়েনে আসার পর ২০২৩-২৪ মরশুমে দলে স্থায়ী হন নিশু। দুই উইংয়েই খেলতে সক্ষম নিশু মূলত বাঁদিক সামলান। ২০টি ম্যাচে ৩টি ক্লিন শিট, ১০টি সুযোগ তৈরি ও ১৭টি ড্রিবল করেন। চোটের কারণে পরের মরসুমে ১৩টির বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। মন্দার রাও বা জেরি লালরিনজুয়ালা থাকলেও আক্রমণাত্মক মানসিকতার কারণে সেরা একাদশে নিশুই এগিয়ে।

ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার: শৌভিক চক্রবর্তী

২০২২ সালে যোগ দেওয়ার পর থেকে ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠে নীরব যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত এই বঙ্গ তারকা। ২০২৩-২৪-এ কার্লস কুয়াদ্রাতের অধীনে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। বলের দখল নেওয়া, প্রতিআক্রমণ থামানো এবং পজিশন ধরে রাখায় দক্ষ শৌভিক এখন অস্কার ব্রুজোনের দলেও অপরিহার্য।

সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার: সউল ক্রেসপো

২০২৩ সালে যোগ দেওয়া স্প্যানিশ মিডফিল্ডার ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠে ভারসাম্য, সৃজনশীলতা ও আক্রমণ যোগ করেছেন। ২৭টি ম্যাচে ৫টি গোল করেছেন ক্রেসপো। ম্যাটি স্টেনম্যান বা আলেক্স লিমা থাকলেও ক্রেসপোর সামগ্রিক প্রভাব তাকে একাদশে জায়গা করে দিয়েছে।

লেফট মিডফিল্ডার: নাওরেম মহেশ সিং

আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলের সেরা খেলোয়াড়দের অন্যতম হিসেবে মহেশের নাম অনায়াসে উঠে আসে। তাঁর সৃষ্টিশীল খেলা, নিখুঁত ক্রস ও বল কন্ট্রোলে তিনি ফরোয়ার্ডদের বারবার সুযোগ তৈরি করেছেন। বাঁ দিক থেকে মাঝমাঠ পর্যন্ত তাঁর বহুমুখী ভূমিকা দলকে অনেকবার উদ্ধার করেছে।

রাইট মিডফিল্ডার: পিভি বিষ্ণু

২০২৩ সালে কুয়াদ্রাতের অধীনে আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলা শুরু করেই নজর কাড়েন বিষ্ণু। ২০২৪-২৫ মরশুমে তিনি ৪টি গোল, ৩টি অ্যাসিস্ট এবং ১৫টি সুযোগ তৈরি করেন। তাঁর ড্রিবলিং দক্ষতা ও ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষকে হারানোর ক্ষমতা এই সেরা একাদশে জায়গা করে দিয়েছে তাঁকে।

ফরোয়ার্ড: ক্লেটন সিলভা ও আন্তোনিও পেরোসেভিচ

ক্লেটন সিলভা সম্ভবত ইস্টবেঙ্গলের আইএসএল পর্বে সেরা ফরোয়ার্ড। ২০২২-২৩ মরশুমে যোগ দিয়ে ১২টি গোল করে যুগ্ম সর্বোচ্চ স্কোরার হন তিনি। তিন মরশুমে ২০টি গোল ও ৬টি অ্যাসিস্ট করেন। তাঁর ফ্রি-কিক, পজিশনিং ও গোলের খিদে তাঁকে কিংবদন্তি করে তুলেছে। ক্রোয়েশিয়ার আন্তোনিও পেরোসেভিচ ২০২১-২২ মরশুমে যোগ

দিয়ে ১৪টি ম্যাচে চারটি গোল, একটি অ্যাসিস্ট ও ২২টি সুযোগ তৈরি করেন। ব্রাইট এনোবাখারে থাকলেও পেরোসেভিচের কঠোর পরিশ্রম ও প্রভাব তাঁকে সেরা করে তোলে।

প্রধান কোচ: কার্লস কুয়াদ্রাত

আইএসএল জয়ী কোচ কুয়াদ্রাত ২০২৩-২৪-এ যখন লাল-হলুদ বাহিনীর দায়িত্ব নেন, তখন সমর্থকদের প্রত্যাশা ছিল আকাশ-ছোঁয়া। তিনিই দলকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবেন, এমনই প্রত্যাশা ছিল সকলের এবং তাঁর অধীনেই দলের মধ্যে লড়াকু মানসিকতা তৈরি হয়, যা তাদের শিবির থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল বলা যায়। ১২ বছর পর ২০২৩-এ কলিঙ্গ সুপার কাপে তিনি ইস্টবেঙ্গলকে কোনও জাতীয় স্তরের ট্রফি এনে দেন। যদিও সেবারও তাদের প্লে-অফে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ২০২৪-২৫ মরশুমের মাঝপথে বরখাস্ত হন কুয়াদ্রাত। তিনিই একমাত্র কোচ যিনি ক্লাবকে টানা দুটি মরশুমে প্রশিক্ষণ দেন এবং একটি ট্রফি জেতান।