নেতৃত্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন: আইএসএল-এ সেরা অধিনায়কেরা
এই তারকারা শুধু আর্মব্যান্ড পরেননি, এঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে ও দলের প্রতি অতুলনীয় অবদান রেখে নেতৃত্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

নেতৃত্ব এক কঠিন দায়িত্ব হলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, এর জন্য কোনও কৃতিত্ব দাবি করতে পারেননি দলনেতা। কোচেরা সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং মাঠে সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ সংগঠিত করে থাকেন অধিনায়ক। সতীর্থদের সংগঠিত করা, কঠিন সময়ে দলকে উদ্বুদ্ধ করা এবং মুহূর্তের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াই মূলত অধিনায়কের কাজ। এ সবের মধ্যেও নিজের পারফরম্যান্স ঠিক রাখতে হয় তাঁকে। অধিনায়কই একটি দলের হৃদস্পন্দন: স্থির, মনোযোগী এবং সদা সজাগ।
এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হচ্ছে আইএসএল-এর পাঁচজন অধিনায়ককে, যাঁরা কেবল আর্মব্যান্ড পরেই থেমে থাকেননি, তাঁরা কঠিন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সাফল্য, সাহসী সিদ্ধান্ত ও নিখাদ নিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁদের দলকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন।
আইএসএলে দলকে শিল্ড জেতানো যে কোনও অধিনায়কের পক্ষে মোটেই সোজা কাজ নয়। আর টানা দুই মরশুমে তা বাস্তবায়িত করে দেখানো—এক অসাধারণ কীর্তি। ঠিক সেটাই করেছেন শুভাশিস। প্রীতম কোটালের বিদায়ের পর মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের অধিনায়ক হন তিনি। অত্যন্ত সংযমী আচরণ ও নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ তাঁকে দায়িত্ব সামলাতে সাহায্য করে।
২০২২–২৩-এ প্রীতমের নেতৃত্বে আইএসএল কাপ জিতেছিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। তবে শিল্ড অধরাই রয়ে গিয়েছিল। শুভাশিসের অধিনায়কত্বে সবুজ-মেরুন সমর্থকদের সেই সাধও পূরণ হয়। প্রথমবারের মতো লিগ-শিল্ড জিতে তারা মুম্বই সিটি এফসি-কে পিছনে ফেলে দেয়।
এর পরের মরশুম ছিল আরও ঐতিহাসিক। কলকাতার ক্লাব শুধু শিল্ড রক্ষা করেনি, বরং আইএসএল কাপও পুনরুদ্ধার করে জোড়া খেতাব অর্জন করে, যা তার আগের মরশুমে অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়েছিল।
আইএসএল ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অধিনায়কদের একজন হিসেবে শুভাশিসের নাম নিশ্চয়ই লেখা হবে। ৫০টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি। শুধুমাত্র ট্রফিজয়ের জন্য নয়, ধারাবাহিক পারফরম্যান্স ও ঠাণ্ডা মাথায় নেতৃত্বের জন্যও ফুটবলপ্রেমীরা মনে রাখবেন তাঁকে।
অধিনায়ক, দলনেতা, কিংবদন্তি— এই তিনটি শব্দই সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে নিখুঁত ভাবে মানানসই। বেঙ্গালুরু এফসির সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ এই সুনীল। আইএসএল-এ সর্বাধিক ১৩৭টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন—যা এক নজির।
২০১৭–১৮ মরশুমে আইএসএল-এ অভিষেক হওয়ার পর থেকে বেঙ্গালুরু এফসিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুনীল। প্রথম দুই মরশুমে লিগ টেবলের শীর্ষে ছিল তাঁর দল এবং ২০১৮–১৯-এ এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালে স্মরণীয় সাফল্য অর্জন করে আইএসএল কাপ জিতে নেয় তারা।
মাঠে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও মাঠের বাইরে তরুণদের পরামর্শদানে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অনেক তরুণ খেলোয়াড়ই তাঁর পরামর্শকে তাঁদের সাফল্যের নেপথ্যে বড় কারণ বলে মানেন। নিষ্ঠার প্রশ্নে সুনীলের কোনও তুলনা নেই। আইএসএল-এ অভিষেক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তিনি বেঙ্গালুরু এফসির সঙ্গেই রয়েছেন।
যে দলেই খেলেছেন, সেই দলেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অমরিন্দর। তবে মুম্বই সিটি এফসি এবং বর্তমানে ওডিশা এফসি-তে তিনি সত্যিই নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। ২০২০–২১ মরশুমে তিনি মুম্বই সিটি এফসি-র অধিনায়ক হিসেবে শিল্ড ও কাপ—উভয়ই জিতে জোড়া খেতাব অর্জন করেন। সে মরশুমে ২৩ ম্যাচে ১০টি ক্লিন শিট (যৌথভাবে সর্বোচ্চ) ও ৫৯টি সেভ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) করেন।
২০২২-এ তিনি ওডিশা এফসি-তে যোগ দেন এবং ২০২৩–২৪ মরশুম থেকে অধিনায়কের দায়িত্ব নেন। ঐ মরশুমে দলকে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে নিয়ে যান এবং সর্বোচ্চ ৮১টি সেভ করেন। ইতিমধ্যেই ৪৮টি ম্যাচে ওডিশার অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি। প্রমাণ করে দিয়েছেন—তাঁর নেতৃত্ব এবং গোলরক্ষার দক্ষতা এখনও আইএসএলে অন্যতম সেরা।
যদিও সর্বোচ্চ ম্যাচে অধিনায়কত্বের তালিকায় নেই পিটার হার্টলে, তবু জামশেদপুর এফসিতে তাঁর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। ২০২০-তে দলে যোগ দেওয়ার পর প্রথম দিন থেকেই তিনি অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পান। রক্ষণে তাঁর মুখর ও উজ্জ্বল উপস্থিতি ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে তিনি ছিলেন স্বাভাবিক নেতা। নেতা হওয়ার জন্যই যেন এসেছিলেন হাটলে।
তিনটি মরশুম খেলেন আইএসএলে এবং ২০২১–২২ মরশুমে তাঁর কেরিয়ারের সেরা মুহূর্তগুলি আসে, যখন তিনি দলকে আইএসএল শিল্ড এনে দেন। সে ছিল লিগের ইতিহাসের তাদের প্রথম সাফল্যে। সে মরশুমে হার্টলের নেতৃত্বে জামশেদপুরের রক্ষণভাগ ছিল ইস্পাতের মতোই কঠিন এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ। ইস্পাতনগরীর দলই সবচেয়ে কম ২১টি গোল হজম করে। জামশেদপুর এফসির স্বর্ণযুগ আসে তাঁরই নেতৃত্বে এবং এখনও আইএসএলে সবচেয়ে সম্মানিত বিদেশি অধিনায়কদের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে।
যখন হায়দরাবাদ এফসি-তে যোগ দেন জোয়াও ভিক্টর, তখন দলটি সবে আইএসএলে যাত্রা শুরু করেছিল। চার বছর পর তিনি দলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ও অধিনায়কে পরিণত হন। ভারতের মাটিতে তিনি শুধুই হায়দরাবাদের হয়ে খেলেছেন এবং ৫০টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন। একই দলের হয়ে দীর্ঘতম অধিনায়কত্ব করা খেলোয়াড়দের তালিকায় তিনি অবশ্যই শীর্ষে থাকবেন।
২০২১–২২ মরশুমে অধিনায়ক ভিক্টর সর্বোচ্চ শিখরে ওঠেন। সে বার তিনি হায়দরাবাদকে তাদের প্রথম আইএসএল কাপ জেতান। অসাধারণ এক ফাইনালে কেরালা ব্লাস্টার্সকে হারায় তাঁর দল। ট্রফি জয়ের বাইরেও মাঠে তাঁর ধারাবাহিকতা এবং মাঝমাঠে তাঁর দাপট ছিল স্মরণীয়। তিনি ১৫টি গোল অবদান রাখেন এবং খেলার ছন্দ ও সংগঠন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভিক্টর ছিলেন হায়দরাবাদ এফসির উত্থানের প্রতীক। শান্ত প্রকৃতির নেতা, প্রবল নিষ্ঠাবান এবং দলের সবচেয়ে সফল অধ্যায়ের কেন্দ্রবিন্দু।