ভারতে এসে প্রথম বছরেই বাজিমাত করে দিয়েছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ান লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা জেমি ম্যাকলারেন ভারতে এসেও যে মাতিয়ে দেবেন, এমন প্রত্যাশা ছিলই মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের সমর্থকদের। কিন্তু কলকাতায় এসে যে এই শহর ও শহরের মানুষগুলোকে এত ভাল লেগে যাবে তাঁর, তা বোধহয় আশা করতে পারেননি জেমি।

গত আইএসএলে ২৫টি ম্যাচে এক ডজন গোল করেন তিনি। গোলের মোট সংখ্যার দিক থেকে হয়তো কমই মনে হতে পারে। মরশুমের সর্বোচ্চ গোলের মালিক আলাদিন আজারেই-এর ২৩ গোলের তুলনায় হয়তো অনেক পিছিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু যে গোলগুলি করেছিলেন জেমি, সেই গোলগুলির গুরুত্ব তাঁর দলের কাছে ছিল অপরিসীম।

তিনি যে ‘পারফেক্ট টিমম্যান’, তা তাঁর সতীর্থরা সকলেই স্বীকার করেন। জেমির কথাতেও তার ছাপ স্পষ্ট। যখন তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত পুরস্কার পেতে সবারই ভাল লাগে। কিন্তু এমনও হতে পারত যে, আমি গোল্ডেন বল পেলে হয়তো আমার দলের জোড়া খেতাব পাওয়া হত না। ফুটবল এক মজার খেলা। এখানে কখন, কী হয় কিছু বলা যায় না। তবে ক্লাবের ওই দুটো ট্রফির (আইএসএল শিল্ড ও কাপ) চেয়ে দামী আমার কাছে কোনও পুরস্কারই নয়”। সম্প্রতি ক্লাবের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল এমবিএসজি টিভি-তে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথাই বলেছেন অস্ট্রেলীয় তারকা।

লাখো সমর্থকে মুগ্ধ

কলকাতার ক্লাবের প্রতি যখন এত ভালবাসা তাঁর, তখন কলকাতা শহর, এখানকার মানুষগুলোকে ভাল লাগবে না, তা আবার হয় না কি? বিশেষ করে ক্লাবের সমর্থকেরা তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। হাজার হাজার সমর্থকদের নিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিপক্ষদের কাছে কলকাতায় এসে খেলা কঠিন। তার অন্যতম কারণ, আমাদের এই সমর্থকেরা। ৬০-৭০ হাজার মানুষ যদি একসঙ্গে একটা দলের জন্য গলা ফাটাতে শুরু করে এবং ওরা যখন আমাদের উৎসাহ জোগানোর জন্য চিৎকার করে, তখন শেষ পর্যন্ত লড়াই করার ইচ্ছাশক্তি প্রবল ভাবে বেড়ে যায়”।

ক্লাবের মতো সমর্থকদেরও ঐতিহ্যের বিষয়ে অবাক এই বিশ্বকাপার। বলেন, “যখন এখানে সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলি, যখন তারা তাদের প্রিয় ক্লাব নিয়ে তাদের অনুভূতির কথা আমাকে বলে, তখন অবাক হয়ে শুনি ওদের কথা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই ক্লাবের সমর্থক! প্রায় ১৫০ বছর ধরে তারা একই ক্লাবের সমর্থক, এই জিনিস সারা বিশ্বে বড় একটা দেখা যায় না। অস্ট্রেলিয়াতেও দেখিনি। ওরা অবশ্য চেষ্টা করছে। কিন্তু মোহনবাগানের মতো পুরনো ক্লাবেই এটা সম্ভব। দাদু, বাবা, নাতি, নাতনি—সবাই একসঙ্গে একই ক্লাবকে সমর্থন করছে, এ বেশ বিস্ময়কর। তাই কলকাতায় আরও দীর্ঘদিন খেলা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে আমার”।

খাদ্যরসিকের প্রিয় খানা!

সমর্থকেরা ছাড়াও প্রেমে পড়েছেন কলকাতার খাবারের। কী খাবার? বলেন, “কলকাতায় থাকলে হোটেলেই থাকি। কিন্তু যখন সুযোগ পাই, তখন হোটেল থেকে বেরিয়ে শহরটা ঘুরে দেখি। রেস্তোরাঁয় গিয়ে এখানকার খাবারও খাই। আমার খুব পছন্দের খাবার ভিন্ডি মশালা। আমি নিরামিষ খেতেও পছন্দ করি। তাই ঝোল-ভাতের সঙ্গে ভিন্ডি মশালা খেতে ভাল লাগে। কলকাতার মিষ্টিও দারুন। বিশেষ করে রসগোল্লা। এ ছাড়াও এখানে যে নানা রকমের মিষ্টি পাওয়া যায়, সেগুলোও লোভনীয়। কিন্তু সে সব থেকে একটু দূরেই থাকি। কারণ, নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়। তবে এখানকার সংস্কৃতি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে একেবারে আলাদা হলেও আমার বেশ পছন্দের”।

যে পাহাড় প্রমাণ প্রত্যাশার পাহাড়ে চড়ে কলকাতায় পা রেখেছিলেন জেমি ম্যাকলারেন, শুরু থেকেই তা পূরণ করা বেশ কঠিন ছিল তাঁর পক্ষে। ফিটনেস সমস্যা নিয়েও এ দেশে আসেন তিনি। তাই আইএসএলের প্রথম তিন ম্যাচে তাঁকে দেখে খুশি হতে পারেননি সমর্থকেরা। প্রথম ম্যাচে তো দলেই ছিলেন না। তার পরের দুই ম্যাচে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামেন।

শুরুর বাধা কাটিয়ে সাফল্য

শুরুর দিকের সেই অধ্যায় নিয়ে এই সাক্ষাৎকারে জেমি বলেন, “যে দিন প্রথম কলকাতায় এসে পৌঁছই, সে দিনই সমর্থকদের অভ্যর্থনায় আমার আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়ে যায়। জানতাম যে একটা বড় ক্লাবে আমি খেলতে আসছি, যার ইতিহাসও বিশাল। তাই খুব উত্তেজিত ছিলাম। তবে যে কোনও ভাল জিনিস শুরু করতে সময় লাগে। সে জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন। আমারও সময় লেগেছে, পুরোপুরি ফিট হয়ে মাঠে নামতে। তাই প্রথম দু-একটা ম্যাচে আমি পরিবর্ত হিসেবে নামি, যাতে নতুন মাঠ, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি। কারণ, সম্পুর্ণ নতুন একটা লিগে খেলছি আমি। নতুন স্টেডিয়াম, নতুন ঘাসে, আবহাওয়ায়—এমন অনেক জিনিসই মাথায় ছিল”।

অবশেষে মহমেডান এসসি-র বিরুদ্ধে শুরু থেকে মাঠে নামেন জেমি ম্যাকলারেন এবং আইএসএলের প্রথম গোলটিও করেন। তার দু’সপ্তাহ পরেই ছিল কলকাতা ডার্বি এবং সেই ম্যাচেও গোল পান তিনি। এই দুই গোলই তাঁর মনে থাকবে বলে জানান জেমি। বলেন, “মহমেডানের বিরুদ্ধে হোম ম্যাচের আগে আমার মনে হচ্ছিল, এ বার আমি তৈরি, শুরু থেকে খেলতে পারব। মনে হচ্ছিল প্রথম ম্যাচেই হয়তো গোল পাব। সতীর্থরা অনেক গোলের সুযোগ তৈরিও করছিল। আমি এমন একজন খেলোয়াড়, যে বক্সের মধ্যে ও আশপাশে থাকতেই পছন্দ করি। খুব দ্রুত আক্রমণেও উঠছিলাম সবাই। আমার মনে হচ্ছিল গোলের সুযোগ আসবেই। হয় ক্রস আসবে, না হলে সেট পিস থেকে সুযোগ আসবে। এবং প্রথম গোলটা সেট পিস থেকেই আসে।

গ্রেগ একটা দুর্দান্ত ফ্লিপ করে এবং আমি হেড করে বলটা গোলে ঢুকিয়ে দিই। ডার্বিতে গোল করার অনুভূতি আলাদা রকমের হয়। সে দিনও হয়েছিল এবং (কলকাতায়) প্রথম দুটো গোলই ছিল অসাধারণ, গ্যালারি ভর্তি সমর্থকদের সামনে। এই বিশাল সংখ্যক সমর্থকদের কথা শুনেই তো কলকাতায় আসি আমি। এত সমর্থকের সামনে গোল করে যখন সেলিব্রেট করার সুযোগ পাই, তখন যেন সেটা স্বপ্নের মতো মনে হয়। মনে হয়, সত্যিই কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার পেলাম। মরশুম শুরুর আগে আমি ফিট ছিলাম না ঠিকই। কিন্তু শুরুতেই ওই গোল দুটো করে সবাইকে বোঝাতে পেরেছিলাম, আমি এখানে এমনি এমনি আসিনি, নিজেকে প্রমাণ করতেই এসেছি এবং সে দিন এয়ারপোর্টে সমর্থকদের যে প্রত্যাশা টের পেয়েছিলাম, তা পূরণ করার জন্যই এসেছি”।

সবুজ-মেরুন চ্যালেঞ্জ!

মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের মতো একটি সফল দলে যোগ দিয়ে যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি, তা স্বীকার করে নিয়ে জেমি বলেন, “যখন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দিই, তখন প্রমাণ হয়েই গিয়েছিল, কত ভাল দল আমরা। আমার কাজ ছিল, দলকে আরও ভাল করে তোলা, দলের গোলসংখ্যা আরও বাড়ানো। আরও বড় বড় ম্যাচে যখন আমাকে প্রয়োজন হবে, তখন সেই প্রয়োজন মেটানো। যেমন ফাইনালে জয়সূচক গোলটা করেছিলাম। এটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমার গোলে দল জোড়া খেতাব জিতে ইতিহাস তৈরি করে, এটা দারুণ অনুভূতি। দুর্দান্ত একটা দলে, যেখানে সতীর্থ খেলোয়াড় থেকে স্টাফ, সমর্থক সবাই অনবদ্য, সে রকম দলকে চ্যাম্পিয়ন করে তোলা সত্যিই দারুণ ব্যাপার”।

গত আইএসএলের ফাইনালে ঘরের মাঠে নির্ধারিত সময়ের প্রথমার্ধে বেঙ্গালুরু এফসি আধিপত্য বিস্তার করলেও দ্বিতীয়ার্ধে খেলায় ফিরে আসে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ৪৯ মিনিটের মাথায় আলবার্তো রড্রিগেজের নিজগোলে এগিয়ে যায় বেঙ্গালুরু এফসি। ৭২ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে সেই গোল শোধ করে জেসন কামিংস। অতিরিক্ত সময়ে ছ’মিনিটের মাথায় জেমি ম্যাকলারেনের গোলই শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক খেতাব এনে দেয় গঙ্গা পাড়ের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবকে।

ফাইনালের রোমাঞ্চকর স্মৃতি!

সেই রোমাঞ্চকর ফাইনালের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে জেমি এই সাক্ষাৎকারে বলেন, “ফাইনালের এক সপ্তাহ আগে থেকে যে রকম হইচই চলছিল, সেটাও কম স্পেশাল নয়। এর ফলে আমাদের চাপ বাড়েনি, বরং আমাদের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। আমাদের আত্মবিশ্বাসও ক্রমশ বাড়ছিল। বেঙ্গালুরুর মতো একটা ভাল দলকে হারানো মোটেই সোজা ছিল না। কিন্তু ঘরের মাঠে সমর্থকদের সামনে আমরা এই কঠিন পরীক্ষায় পাস করবই, এমনই আত্মবিশ্বাস ছিল আমাদের মধ্যে”।

সংযুক্ত সময়ের একেবারে শেষ দিকে প্রতিপক্ষের বক্সের ডানদিকের কোণ থেকে বক্সের মাঝখানে বল বাড়ান গ্রেগ স্টুয়ার্ট। সেই বল পেয়ে প্রায় ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গোলে শট নেন ম্যাকলারেন। তাঁর সেই শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি।

সেই ঐতিহাসিক গোল নিয়ে জেমি বলেন, “ফাইনালে কয়েকটা সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি ঠিকই, তবে যে গোলটা করেছিলাম, আমি এই ধরনেই গোলই করতে পছন্দ করি। মানে কঠিন সুযোগ থেকে গোল করা। আমি আগেই বুঝে নিয়েছিলাম, গ্রেগ বলটা বক্সে ফেলবে এবং আমাকে সে জন্য তৈরি হতে হবে। দুই দলের খেলোয়াড়রা তখন ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আমি তুলনামূলকভাবে তরতাজা ছিলাম। শেষ মুহূর্তে গোলটা পেয়ে আমি কতটা আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছিলাম, তা নিশ্চয়ই আমার উল্লাস দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন সবাই। আসলে সারা বছর ধরে এই মুহূর্তটার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। সমর্থকদের সামনে গোলটা করতে পারার অনুভূতিটা স্পেশাল”।

আইএসএলে সেরা গোল

তবে সেই গোলই তাঁর সেরা গোল নয় বলে জানান অজি ফরোয়ার্ড। তা হলে কোন গোলটি সেরা? জেমির মতে, “গুণমানের দিক থেকে কোচিতে যে গোলটা করেছিলাম, সেটাই সেরা ছিল। বিশালের পাঠানো বল আপুইয়া ফ্লিক করে আমার কাছে পাঠায়। আমি জেসনকে দিই, জেসন ফের আমার দিকে ফ্লিক করে। চার-পাঁচটা টাচের পর গোলটা করি। প্রায় একশো মিটার উঠে গিয়ে গোলটা করেছিলাম। বিশ্ব ফুটবলে এমন গোল বড় একটা দেখা যায় না। তাই আমার ওই গোলটার কথা মনে থাকবে। সত্যি বলতে, আমার কেরিয়ারের অন্যতম সেরা গোল”। সেই ম্যাচে ৩-০-য় জিতেছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী। জেমি জোড়া গোল করেছিলেন।

আইএসএলে তাদের কৃতিত্বের ভাগ সমর্থকদেরও দিতে চান জেমি। বলেন, যখন আবহাওয়া প্রতিকুল হয়, গরম ক্রমশ বাড়ে, তখন সমর্থকদের জোগানো প্রবল উৎসাহ খুব কাজে লাগে। ভিতরের তাগিদটা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু যখন মাঠে নেমে চারদিকে তাকিয়ে দেখি সমর্থকেরা সবাই আমাদের জন্য গলা ফাটাচ্ছে, তখন আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠি আমরা। যেটা হয়েছিল ওডিশার বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে শিল্ডজয়ের জন্য আমাদের তিন পয়েন্ট অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। দিমি (ম্যাচের শেষ মুহূর্তে) দুর্দান্ত একটা গোল করে। এটা সমর্থকদের জন্যই করতে পারি আমরা। ওরা সকলেই সোম থেকে শুক্র প্রচুর পরিশ্রম করে। সপ্তাহান্তে ওদের যদি একটু আনন্দ দিতে পারি আমরা, এর চেয়ে ভাল আর কীই বা হতে পারে? গত মরশুমে আমরা অনেকবারই তা করেছি”।

‘আবার আসিব ফিরে’

কাকতালীয় ভাবে মোহনবাগান দিবস, ২৯ জুলাই যাঁর জন্মদিন, সেই জেমি ম্যাকলারেন আসন্ন মরশুমেও সবুজ-মেরুন শিবিরে ফেরার জন্য ছটফট করছেন। নিজেই সে কথা জানিয়ে বলেন, “ফের আমি সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে মাঠে ফিরতে চাই। গত বছর আমরা যা করেছিলাম, তা বজায় রাখতে চাই। আমাদের সেই মান বজায় রাখতে হবে। তাই গর্বের সঙ্গে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের জার্সি গায়ে মাঠে নামার জন্য মুখিয়ে আছি। আর তর সইছে না যেন”।