তিনে মিলে করি গোল: আইএসএল-এ মরশুমসেরা আক্রমণ-ত্রয়ী
একই আইএসএল মরশুমে সবচেয়ে কার্যকর আক্রমণ-ত্রয়ীদের খুঁজে বের করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে— যাঁদের ক্রমতালিকা তৈরি করা হয়েছে গোল অবদানের (গোল + অ্যাসিস্ট) ভিত্তিতে।

গোলেই ফয়সালা হয় হার-জিতের। কিন্তু ইতিহাস গড়ে সেই জুটি বা ত্রয়ী, যাঁরা একসঙ্গে দুর্দান্ত খেলে দলকে সেই গোলগুলি এনে দেন। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে এমন অনেক মরশুম রয়েছে, যেখানে আক্রমণ বিভাগের তিনজন খেলোয়াড় একসঙ্গে দুরন্ত ছন্দে থেকে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে তছনছ করে দিয়েছেন। কখনও ক্লাসিক ফ্রন্ট থ্রি, কখনও সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ— এই ত্রয়ীগুলিরর সমন্বয়েই এসেছে গোল, নজির ও শিরোপা।
এই তালিকায় রয়েছে আইএসএল ইতিহাসে একই মরশুমে সবচেয়ে বিধ্বংসী ও কার্যকরী আক্রমণ-ত্রয়ীরা।
স্টুয়ার্ট, দিয়াজ ও ছাঙতে (মুম্বই সিটি এফসি – ২০২২-২৩)
মোট গোল অবদান: ৫০
গ্রেগ স্টুয়ার্ট – ৮ গোল | ৮ অ্যাসিস্ট
জর্জ পেরেইরা দিয়াজ – ১১ গোল | ৭ অ্যাসিস্ট
লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে – ১০ গোল | ৬ অ্যাসিস্ট
২০২২–২৩ মরশুমে ডেস বাকিংহ্যামের প্রশিক্ষণে মুম্বই সিটি এফসির আক্রমণের তীব্রতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যা ভারতীয় ফুটবলে খুব কমই দেখা যায়। সেই দুর্দান্ত সাফল্যের মূল চাবিকাঠি ছিলেন আক্রমণ বিভাগের তিন খেলোয়াড় — গ্রেগ স্টুয়ার্ট, জর্জ পেরেইরা দিয়াজ এবং লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে। এই ত্রয়ী একসঙ্গে দলের ৫০টি গোলে অবদান (গোল + অ্যাসিস্ট) রেখেছিলেন, যা আইএসএল ইতিহাসে এক মরশুমে কোনও ত্রয়ীর সর্বোচ্চ। সে বার লিগ পর্বে মোট ৫৪টি গোল করে নতুন নজির গড়ে দ্বিতীয়বারের মতো আইএসএল শিল্ড জিতে নেয় সাগরপাড়ের দলটি।
জামশেদপুর এফসির হয়ে তার আগের মরশুমে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর স্টুয়ার্টকে ফের প্রধান স্রষ্টার ভূমিকায় দেখা যায়। ৮টি গোল ও ৮টি অ্যাসিস্ট করেন তিনি। সামনে দিয়াজ ছিলেন এক নিখুঁত ফিনিশার হিসেবে। আর ছাঙতে উইং থেকে গতি ও কৌশলের মিশ্রণে ধারাবাহিকভাবে ফলপ্রসূ আক্রমণ করতেন।
আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার দিয়াজ ১১টি গোল ও ৭টি অ্যাসিস্ট করেন, আর ছাঙতে তাঁর কেরিয়ারের সেরা মরশুম কাটান, ১০টি গোল ও ৬টি অ্যাসিস্ট নিয়ে। জিতেছিলেন গোল্ডেন বল পুরস্কার। স্টুয়ার্টের দুর্দান্ত অনুমান ক্ষমতা, দিয়াজের তীক্ষ্ণতা ও ছাঙতের গতিময়তা ও রোমাঞ্চকর খেলা — সব মিলিয়ে এই ত্রয়ী গড়ে তোলে আইএসএল ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী আক্রমণ বিভাগ।
লানজারোতে, কোরো ও বুমৌস (এফসি গোয়া – ২০১৭-১৮)
মোট গোল অবদান: ৪৬
মানুয়েল লানজারোতে – ১৩ গোল | ৬ অ্যাসিস্ট
ফেরান কোরোমিনাস (কোরো) – ১৮ গোল | ৫ অ্যাসিস্ট
হুগো বুমৌস – ২ গোল | ২ অ্যাসিস্ট
সের্খিও লোবেরার অধীনে এক নতুন আক্রমণাত্মক দর্শনের সূচনা করে এফসি গোয়া, যার কেন্দ্রে ছিলেন লানজারোতে, কোরোমিনাস ও বুমৌস। লানজারোতে ছিলেন আক্রমণ তৈরির প্রাণকেন্দ্র। খেলায় ছন্দ আনা, গোল করা ও সুযোগ তৈরি করার কাজ তিনিই সামলাতেন। অভিষেক মরশুমেই তিনি ১৯ ম্যাচে ১৯টি গোল অবদান রেখে সবার নজর কেড়ে নেন।
অন্যদিকে, কোরোও ছিলেন একেবারে বিস্ফোরক ফর্মে। তিনিও অভিষেক মরশুমেই ১৮টি গোল করে জেতেন গোল্ডেন বুট। সঙ্গে যোগ করেন আরও পাঁচটি অ্যাসিস্ট। তরুণ হুগো বুমৌস মরশুমের মাঝপথে দলে যোগ দেন এবং শুরু থেকেই তাঁর ড্রিবলিং দক্ষতা ও লিঙ্ক-আপ খেলায় ভবিষ্যতের প্লে মেকারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এই তিনজনের বোঝাপড়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। স্প্যানিশ লানজারোতে ও কোরো একে অপরকে নিখুঁত ভাবে বুঝতে পারতেন। বুমৌসের গতিময়তা ও অপ্রত্যাশিত খেলার ধরণ দলের আক্রমণে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। লোবেরার নেতৃত্বে এই ত্রয়ী আইএসএলে এক নতুন যুগের সূচনা করে, যেখানে গতি, মসৃণতা ও আক্রমণাত্মক ফুটবলকে কেন্দ্র করে দল গড়া শুরু হয়।
বুমৌস, কোরো ও জ্যাকিচাঁদ (এফসি গোয়া – ২০১৯-২০)
মোট গোল অবদান: ৪৬
হুগো বুমৌস – ১১ গোল | ৯ অ্যাসিস্ট
ফেরান কোরোমিনাস (কোরো) – ১৪ গোল | ৪ অ্যাসিস্ট
জ্যাকিচাঁদ সিং – ৫ গোল | ৩ অ্যাসিস্ট
সে মরশুমেও সের্খিও লোবেরার প্রশিক্ষণে এফসি গোয়ার আক্রমণাত্মক ফুটবল অভিযান অব্যহত ছিল। ২০১৯–২০ মরশুম ছিল আধিপত্যের। সে মরশুমের কেন্দ্রে ছিল এক কার্যকরী ও বিপজ্জনক ত্রয়ী — হুগো বুমৌস, কোরো ও জ্যাকিচাঁদ সিং।
বুমৌস ছিলেন মাঝমাঠের মাস্টারমাইন্ড, যিনি খেলার ছন্দ তৈরি করতেন। কোরো স্বভাবসিদ্ধ নিখুঁত ফিনিশিংয়ে গোল করে যেতেন আর জ্যাকিচাঁদ উইং থেকে গতি ও ক্ষিপ্রগতির দৌড় দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে বিপদে ফেলতেন। এই ত্রয়ীর আক্রমণভাগ ছিল মসৃণ, দ্রুত ও ধ্বংসাত্মক।
সেই মরশুম বুমৌসের কাছে ছিল অসাধারণ— ১১টি গোল ও ৯টি অ্যাসিস্ট নিয়ে তিনি জিতেছিলেন গোল্ডেন বল। কোরো তাঁর আইএসএল কেরিয়ারে আরও ১৪টি গোল যোগ করেন সে বার আর জ্যাকিচাঁদ ৫টি গোল ও ৩টি অ্যাসিস্ট দিয়ে গতিময় ও সঠিক দিশায় খেলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
এই ত্রয়ীর সম্মিলিত ৪৬টি গোল অবদান ২০১৭–১৮ সালের কিংবদন্তি গোয়া-ত্রয়ীর নজির ছুঁয়ে ফেলে। তাঁদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এফসি গোয়াকে লিগ টেবলের শীর্ষে পৌঁছে দেয় এবং ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনও আইএসএল ক্লাব এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
বেদিয়া, কোরো ও জ্যাকিচাঁদ (এফসি গোয়া – ২০১৮-১৯)
মোট গোল অবদান: ৪৪
এডু বেদিয়া – ৭ গোল | ৬ অ্যাসিস্ট
ফেরান কোরোমিনাস (কোরো) – ১৬ গোল | ৭ অ্যাসিস্ট
জ্যাকিচাঁদ সিং – ৪ গোল | ৪ অ্যাসিস্ট
লোবেরার দ্বিতীয় মরশুমে এই এফসি গোয়া ত্রয়ী স্টাইল ও কার্যকারিতার নিখুঁত মিশ্রণ উপহার দেয়। কোরো ছিলেন আক্রমণের মূলকেন্দ্র, তার আগের মরশুমের মতো সেবারও গোল্ডেন বুট জিতে নেন ১৬ গোল করে, সঙ্গে আরও ৭টি অ্যাসিস্টও যোগ করেন।
এই ত্রয়ীর মধ্যে বিশেষভাবে চোখে পড়ে এডু বেদিয়ার অবদান। মাঝমাঠে একটু এগিয়ে খেলে তিনি খেলার নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকারিতা দুটোই একসঙ্গে আনেন। সে মরশুমে তিনি তাঁর সেরা আক্রমণাত্মক পারফরম্যান্স দেখান, সাতটি গোল ও ছ’টি অ্যাসিস্ট করে।
জ্যাকিচাঁদ সিংয়ের উজ্জ্বল উইং প্লে দলকে ভারসাম্য ও অপ্রত্যাশিত গতিপথ এনে দেয়, যার মাধ্যমে আক্রমণ বিভাগ হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত ও বিপজ্জনক। ভারতীয় উইঙ্গার আটটি গোল অবদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যদিও এফসি গোয়া শেষ পর্যন্ত খেতাব জয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি, আইএসএল কাপের ফাইনালে বেঙ্গালুরু এফসির কাছে পরাজিত হয়, তবু লোবেরার বিস্তৃত ও আক্রমণাত্মক কৌশল গোটা লিগজুড়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।
জিথিন, আজারেই ও আলবিয়াখ (নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি – ২০২৪-২৫)
মোট গোল অবদান: ৪৪
জিথিন এমএস – ২ গোল | ৫ অ্যাসিস্ট
আলাদিন আজারেই – ২৩ গোল | ৭ অ্যাসিস্ট
নেস্টর আলবিয়াখ – ৬ গোল | ১ অ্যাসিস্ট
ডুরান্ড কাপ জিতে আত্মবিশ্বাস নিয়েই মরশুম শুরু করেছিল নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি। সেই গতি ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাদের আক্রমণ বিভাগের ত্রয়ী — জিথিন এমএস, আলাদিন আজারেই এবং নেস্টর আলবিয়াখ। এই ত্রয়ী একসঙ্গে তৈরি করেন আইএসএলের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর আক্রমণ বিভাগ, যেখানে ছিল গতি, কৌশল এবং নিখুঁত ফিনিশিং-এর দুর্দান্ত মিশেল।
আজারেই ছিলেন মরশুমের সবচেয়ে বড় চমক। ২৩টি গোল করে এবং ৭টি অ্যাসিস্ট দিয়ে নজির গড়েন তিনি। অন্যদিকে, আলবিয়াখ ১০ নম্বর পজিশনে খেলে দলকে শেপে আনতে ও শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করেন। তিনি নিজে ছ’টি গোল করেন এবং একটি অ্যাসিস্ট দেন।
উইং থেকে আক্রমণে গতির ঝড় তোলেন জিথিন এবং দু’টি গোল ও পাঁচটি অ্যাসিস্টে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর সরল, গতিময় পারফরম্যান্স প্রতিপক্ষের রক্ষণকে বারবার ভেঙে দেয়। এই ত্রয়ীর সম্মিলিত পারফরম্যান্সে ফের জেগে ওঠে উত্তর-পূর্বের দলটি। ক্লাবের ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো আইএসএল প্লে-অফে জায়গা করে নেয় তারা।