গত এগারো বছরে বহু প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক তারকার উপস্থিতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল)। যাঁরা ফুটবলের সর্বোচ্চ মঞ্চ, ফিফা বিশ্বকাপে নিজেদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁরা পরবর্তীকালে খেলতে এসেছেন ভারতের সেরা ফুটবল লিগে।

২০১৪ থেকে প্রতি মরশুমেই তারকার মেলা বসেছে আইএসএলে। বহু বিশ্বখ্যাত ফুটবলারদের সই করিয়েছে বিভিন্ন ক্লাব। তাঁদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পারফরম্যান্সকে কাজে লাগিয়ে ক্লাবগুলি তাদের নিজস্ব পরিচয় গড়ে তোলে, লিগের সুনাম বাড়ায় এবং আইএসএলের ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য এক দৃঢ় ভিত স্থাপন করে।

দিয়েগো ফোরলান থেকে এলানো ব্লুমার এবং রবার্তো কার্লোস থেকে আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো — বিশ্ব ফুটবলের এমন অসংখ্য মহাতারকা, যাঁদের সারা বিশ্ব এক ডাকে চেনে, যাঁরা খেলোয়াড় ও সমর্থক — সবার কাছেই অনুপ্রেরণার উৎস, তাঁরা খেলে গিয়েছেন এই আইএসএলে। এবার দেখে নেওয়া যাক, আইএসএলে বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কয়েকজন খেলোয়াড়ের আইএসএল অভিযান কেমন ছিল।

আসামোয়া গিয়ান (নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি)

ঘানার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা আসামোয়া গিয়ান ২০১৯ সালে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসিতে যোগ দেন। তিনি তিনটি ফিফা বিশ্বকাপে (২০০৬, ২০১০, ২০১৪) খেলেছেন এবং প্রতিটি আসরেই গোল করেছেন, মোট ১১ ম্যাচে ৬টি গোলের নজির গড়েছেন গিয়ান। নর্থইস্টের কাছে গিয়ানের চুক্তি ছিল বড় ধরনের সাফল্য। কারণ, তিনি আক্রমণ বিভাগে শক্তি এবং নেতৃত্ব দুটিই এনে দিয়েছিলেন। আইএসএলে তার আটটি ম্যাচে চারটি গোল এবং একটি অ্যাসিস্ট রয়েছে, অর্থাৎ গড়ে প্রতি ম্যাচে ০.৫ গোল করেছেন তিনি।

টিম কাহিল (জামশেদপুর এফসি)

টিম কাহিল প্রথম অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলার, যিনি ফিফা বিশ্বকাপে গোল করেছিলেন। তিনি ২০০৬, ২০১০, ২০১৪ এবং ২০১৮-র আসরে ‘সকারু’-দের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৮-১৯ মরশুম শুরুর আগে তিনি জামশেদপুর এফসিতে যোগ দেন, এবং তাঁর প্রভাব মাঠের বাইরেও বিস্তৃত হয়েছিল। একজন দলনেতা, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর তরুণ ভারতীয় সতীর্থদের জন্য একজন ভাল পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন কাহিল। চোটের কারণে সীমিত সময় খেললেও তিনি ইস্পাতনগরীর দলের হয়ে ১১টি ম্যাচে অংশ নিয়েছেন এবং দু’টি গোল করেছেন।

দিয়েগো ফোরলান (মুম্বই সিটি এফসি)

দিয়েগো ফোরলান ২০১৬-য় মুম্বই সিটি এফসিতে যোগ দেন এবং সেই সময় লিগে তাঁর মান ও অভিজ্ঞতা প্রায় তুলনাহীন ছিল। ‘আইল্যান্ডার্স’-এর হয়ে তিনি পাঁচটি গোল এবং তিনটি অ্যাসিস্ট করেন। প্রথম দিন থেকেই ফুটবলার হিসেবে নিজের জাত চিনিয়ে দেন তিনি। তিনটি ফিফা বিশ্বকাপে অংশ নেন ফোরলান। তবে ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে তিনি এক নতুন বিস্ময় হয়ে ওঠেন। সেই আসরে পাঁচটি গোল করেন এবং উজ্জীবিত উরুগুয়ে দলের প্রাণভোমরা ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি গোল্ডেন বল জিতে নেন।

লুসিও (এফসি গোয়া)

তিনটি ফিফা বিশ্বকাপে খেলেছেন লুসিও এবং ২০০২ সালের ফিফা বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তি ব্রাজিল দলে এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১৫-য় এফসি গোয়ায় যোগ দেন এবং তার রক্ষণাত্মক দক্ষতা গোয়ার দলের ডিফেন্স লাইনকে বেশ শক্তপোক্ত করে তোলে। আইএসএলে লুসিওর নেতৃত্ব প্রথম দিন থেকেই চোখে পড়েছিল। তিনি শুধু একজন খেলোয়াড়ই ছিলেন না। বরং মাঠে ছিলেন এক কর্তৃত্বপূর্ণ ফুটবলার, যিনি রক্ষণভাগ সাজিয়ে দিতেন এবং তাঁর সতীর্থ খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স উন্নত করে তুলতে সাহায্য করতেন। এই ব্রাজিলীয় ডিফেন্ডার ২০১৫ ও ২০১৬ দুই মরশুমে এফসি গোয়ার হয়ে মোট ১৯টি ম্যাচ খেলেছেন।

ডেভিড ত্রেজেগি (এফসি পুনে সিটি)

ডেভিড ত্রেজেগি তিনটি ফিফা বিশ্বকাপের আসরে মোট ১২টি ম্যাচ খেলেছেন। ১৯৯৮, ২০০২ এবং ২০০৬ বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিলেন তিনি এবং ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলের সদস্য ছিলেন। এই ফরাসি ফরোয়ার্ড ২০১৪-র আইএসএলে এফসি পুনে সিটির হয়ে খেলেছিলেন। ত্রেজেগি ছিলেন লিগের প্রথম মরশুমের অন্যতম তারকা এবং ন’টি ম্যাচে দুটি গোল করেছিলেন।

আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো (দিল্লি ডায়নামোজ এফসি)

ফিফা বিশ্বকাপজয়ী আর এক তারকা আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো, যিনি ২০১৪-র আইএসএলে খেলেছিলেন। দিল্লি ডায়নামোজ এফসির অন্যতম সেরা তারকা হিসেবে যোগ দেন তিনি এবং ১০টি ম্যাচে একটি গোল করেন। দেল পিয়েরো ২০০৬-এ ইতালিকে বিশ্বকাপ জিততে সাহায্য করেন এবং সেমিফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে একটি গোলও করেছিলেন। ১৯৯৮ এবং ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

রবার্তো কার্লোস (দিল্লি ডায়নামোজ এফসি)

কিংবদন্তি উইংব্যাক রবার্তো কার্লোস ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। সেই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে চিনের বিরুদ্ধে একটি গোলও করেছিলেন। এই ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি ১৯৯৮ এবং ২০০৬ সালের বিশ্বকাপেও অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৫-য় তিনি দিল্লি ডায়নামোজের হয়ে মাত্র তিনটি আইএসএল ম্যাচ খেলেছিলেন। সেই সময় তিনি স্বল্প সময়ের জন্য খেলোয়াড়-প্রশিক্ষকের ভূমিকাতেও ছিলেন।

এই আন্তর্জাতিক তারকারা বছরের পর বছর আইএসএলের মর্যাদা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের উপস্থিতি শুধু দর্শকদের বিনোদনই দেয়নি, বরং নতুন প্রজন্মের ভারতীয় ফুটবলারদের শেখার সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে।

এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য নামগুলো হল:

  • নিকোলাস আনেলকা: ২০১০ ফিফা বিশ্বকাপে খেলেছেন এবং ২০১৪ ও ২০১৫ মরশুমে মুম্বই সিটি এফসির হয়ে খেলেন।
  • এলানো ব্লুমার: ২০১০ ফিফা বিশ্বকাপে খেলেছেন এবং ২০১৪ ও ২০১৫ সালে চেন্নাইয়িন এফসির হয়ে খেলেছেন।
  • কোস্তাস কাতসুরানিস: ২০১০ ও ২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপে খেলেন এবং ২০১৪-য় এফসি পুনে সিটির হয়ে খেলেন।
  • ডেভিড জেমস: ২০১০ ফিফা বিশ্বকাপে খেলেছেন এবং ২০১৪ সালে কেরালা ব্লাস্টার্স এফসির হয়ে খেলেন।
  • আলেসান্দ্রো নেস্তা: ১৯৯৮, ২০০২ ও ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপে খেলেছেন এবং ২০১৪-য় চেন্নাইন এফসির হয়ে খেলেন।
  • রবার্ট পিরেস: ১৯৯৮ ফিফা বিশ্বকাপে খেলেন এবং ২০১৪ মরশুমে এফসি গোয়ার হয়ে খেলেছেন।
  • মার্কো মাতেরাজ্জি: ২০০২ ও ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপে খেলেছেন এবং ২০১৪ সালে চেন্নাইয়িন এফসির হয়ে খেলেছেন।
  • ফ্রেডি লিউনবার্গ: ২০০২ ও ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপে খেলা এই তারকা ২০১৪-য় মুম্বই সিটি এফসির হয়ে খেলেন।