গত বছর নভেম্বরে হায়দরাবাদে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে ভারত। তাজিকিস্তানে রওনা হওয়ার আগে সেটিই ছিল ভারতের জার্সি গায়ে তাঁর শেষ ম্যাচ। তার পরে আর ভারতীয় শিবিরে ডাক পড়েনি গুরপ্রীত সিং সান্ধু-র। শেষ পর্যন্ত তাঁর ডাক পড়ে এক বছর পরে।

কাফা নেশনস কাপে অংশগ্রহনকারী ভারতীয় দলে একাধিক তারকা ফুটবলার অংশ নিতে না পারায় সেই পুরনো ঘোড়া গুরপ্রীতের ওপরই ভরসা করতে হয় ভারতীয় দলের নয়া কোচ খালিদ জামিলকে। তাঁর ওপর ভরসা করে যে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি খালিদ, তার প্রমাণ গুরপ্রীত দিয়েছেন এই টুর্নামেন্টে প্রায় প্রতি ম্যাচেই।

শেষ পরীক্ষাটাও পাস করেন রীতিমতো ভাল মার্কস পেয়ে। ফিফা ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ৫৪ ধাপা ওপরে থাকা ওমানের বিরুদ্ধে তৃতীয় স্থান নির্ধারক ম্যাচে এমন ভাবে ভারতের গোল আগলে দাঁড়িয়েছিলেন, যেন জীবনের শেষ ম্যাচটা খেলতে নেমেছিলেন।

অবশেষে আসে টাই ব্রেকারের পালা, যেখানে গোলকিপারই সব। ভারতের প্রথম দু’টি শটে গোল করেনলালিয়ানজুয়ালা ছাঙতেরাহুল ভেকে। কিন্তু প্রথম দু’বারেই ব্যর্থ হন ওমানের আল সাদি ও আল খাবি। দু’জনের শটই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পরের দুই রাউন্ডেআনোয়ার আলির শট ওমানের গোলকিপার আটকে দিলেওজিথিন এমএস গোল করেন। তবে পরপর দু’টি শটে গোল করেন ওমানের আল রুশাইদি ও আল ঘাসানি।

শেষ রাউন্ডেউদান্ত সিং ব্যর্থ হওয়ায় ওমানের আল ইয়াহমাদির বিরুদ্ধে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েন গুরপ্রীত। সেই শটেই ছিল দুই দলের হার-জিতের চাবিকাঠি। বহু যুদ্ধের নায়ক গুরপ্রীত মাথা বরফের মতো ঠাণ্ডা রেখে তাঁর ডানদিকে দুর্দান্ত ডাইভ দিয়ে ওমানের তারকা ফরোয়ার্ডের শট আটকে দেন এবং দলের জয় সুনিশ্চিত করেন।

এ তো একটি ঘটনা। এমন দুর্দান্ত সেভ গুরপ্রীতের হাতে বহুবার দেখা গিয়েছে সারা টুর্নামেন্টে। প্রথম ম্যাচে ফিফা ক্রমতালিকায় ২৭ ধাপ ওপরে থাকাতাজিকিস্তানকে ২-১-এ হারিয়ে সবাইকে যে দিন অবাক করে দেয় খালিদ জামিলের ভারত, সে দিনও গুরপ্রীত গোটা পাঁচেক অবধারিত গোল বাঁচিয়ে দলের জয় সুনিশ্চিত করেছিলেন।

আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যে ম্যাচেগোলশূন্য ড্র করে ভারত, তাতেও গুরপ্রীত ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। আফগানদের কয়েকটি দূরপাল্লার শট ঠেকাতে তাঁকে একাধিকবার পরীক্ষা দিতে হয়, যা প্রমাণ করে কেন তিনি ভারতীয় দলের অন্যতম প্রধান ভরসা। ম্যাচের শেষ দিকে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড শেরজাদের নীচু শট থেকে দুর্দান্ত সেভ করে ভারতকে লড়াইয়ে রাখেন গুরপ্রীত।

একটা সময়ে ভারতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিলেন গুরপ্রীত। বিশেষ করে মানোলো মার্কেজ ভারতীয় দলের কোচ হয়ে দায়িত্বে আসার পর তাঁকে ভারতীয় শিবিরে ডাকাই বন্ধ করে দেন। কিন্তু আশায় ছিলেন অভিজ্ঞ গোলকিপার। দেশের জার্সি গায়ে ৮০টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। আশায় ছিলেন কোনও না কোনও সময় ফের ডাক পাবেন। তাই ক্লাব মরশুম শেষ হওয়ার পরেও নিজেকে তৈরি রাখতে একসময় নরওয়ের যে ক্লাবে খেলতেন, সেই স্তাবেক-এ গিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করেন। ফলে ফের যখন খালিদ জামিলের ডাক আসে, তখন নিজের সেরাটা দিতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি।

এই ফিরে আসার লড়াই নিয়ে গুরপ্রীত বলেছেন, “(ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়ায়) হতাশা এলেও ভেঙে পড়িনি। বিশ্বাস ছিল ঘুরে দাঁড়াব। একই সঙ্গে জানতাম, আমাকে একাই লড়াই করতে হবে। যদি আমি নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে যেতে পারি, ঠিক ঘুরে দাঁড়াতে পারব”।

বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-কে দেওয়াসাক্ষাৎকারে তিনি এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, “মরশুম শেষ হওয়ার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এ বার বিশ্রাম নেব না। চলে গিয়েছিলাম নরওয়ের স্তাবেক এফসি-তে। পুরনো ক্লাবে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলাম অনুশীলনে। পরে দেশে ফিরে এসে বেঙ্গালুরু এফসি-র যুব দলের সঙ্গেও অনুশীলন করেছিলাম”।

ফিফা ক্রমতালিকায় অনেক এগিয়ে থাকা দু-দু’টি দলকে হারিয়ে কাফা নেশনস কাপ জয় অন্যতম সেরা প্রাপ্তি বলে মনে করেন তিনি। বলেন, “ফুটবল জীবনে সেরা প্রাপ্তির তালিকায় প্রথম পাঁচেই থাকবে এই জয়। কারণ, এই সাফল্য বিদেশের মাটিতে এসেছে। তার ওপর ওমান ম্যাচে আমি অধিনায়ক ছিলাম। ভারতীয় দলে ১৫ বছর ধরে খেলছি। কিন্তু এর আগে ওমানকে কখনওই হারাতে পারিনি। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হল”।

তবে তাজিকিস্তানে এই আট দেশীয় টুর্নামেন্টে কষ্টার্জিত সাফল্যের পরে বিন্দুমাত্র আত্মতুষ্ট নন গুরপ্রীত। তাঁর আসল লক্ষ্য, এএফসি এশিয়ান কাপের মূলপর্বে ওঠা। তাই বলেন, “কাফা নেশনস কাপ শেষ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের কাজ তো এখনও বাকি রয়েছে। সামনেই এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে দু’টি ম্যাচ রয়েছে। মূলপর্বে যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না”।

অক্টোবরে ভারত দু’টি ম্যাচ খেলবে বিশ্বের ১৫৯ নম্বর সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে। প্রথমটি হবে ৯ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে ও পরেরটি ১৪ অক্টোবর গোয়ায়। ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের খেলতে হবে সে দেশে গিয়ে এবং আগামী বছর ৩১ মার্চ হংকংয়ের বিরুদ্ধে বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচ খেলবে ভারত। তাজিকিস্তানে সাম্প্রতিক সাফল্য এই আসন্ন লড়াইয়ের জন্য নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগাবে গুরপ্রীতদের।