আইএসএল আবেগ: পাঁচ ক্লাবের সমর্থকদের সেরা পাঁচ স্লোগান
প্রতিটি স্লোগান স্থানীয় আবহকে বহন করে, যা আইএসএল-কে এক ধরনের সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্রে পরিণত করে।

ফুটবল শুধু ফুটবলারদের বা ক্লাবগুলিকে নিয়ে নয়, ফুটবল সমর্থক, গ্যালারি থেকে ভেসে আসা ধ্বনি আর স্লোগানেরও খেলা। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) কয়েকটি স্লোগান বিভিন্ন ক্লাবের সমর্থকদের গর্ব ও আত্মপরিচয়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সেগুলিই এই লিগকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। সমর্থকদের এক-একটি স্লোগান একটা ক্লান্ত দলকে যেমন চাঙ্গা করে তুলতে পারে, তেমনই প্রতিপক্ষকেও অস্থির করে তুলতে পারে। সমর্থকদের কণ্ঠস্বর স্টেডিয়ামের অনেক দূর-দূরান্ত পর্যন্তও প্রতিধ্বনিত হয়।
ভারতের নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে ফুটবল সমর্থকদের রূপ বিভিন্ন। তাদের প্রতিটি স্লোগান স্থানীয় আবহকে বহন করে, যা আইএসএল-কে এক ধরনের সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্রে পরিণত করে, যেখানে ফুটবলই তাদের এক সূত্রে বাঁধে।
এই স্লোগানগুলো জন্ম নেয় গ্যালারিতে। বেঁচে থাকে এক মরশুম থেকে আরেক মরশুমে এবং বারবার উচ্চারিত হতে হতে ক্লাবপ্রেমীদের কণ্ঠস্বর ভেঙে যায়। তাও তাদের থামানো যায় না। ফুটবলারদের কাছে এ এক শক্তির উৎস। আর সমর্থকদের কাছে এ সমর্থনের ভঙ্গি—যা তাদের নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে।
এই প্রতিবেদনে থাকছে লিগের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাঁচটি স্লোগান, যা ক্লাবগুলির সমর্থকদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি – ‘চাক্কারা লুনা… ভিবিন ভিবিন, থালিরে কুলিরে
কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম বিখ্যাত উন্মাদনাময় আবহের জন্য। আর এর বড় কারণ এই স্লোগান, যা গাওয়া হয় আড্রিয়ান লুনা এবং ভিবিন মোহননের জন্য। “চাক্কারা” শব্দের অর্থ মিষ্টি, আরকেরালা ব্লাস্টার্সের সমর্থকেরা এটি গেয়ে ওঠে আড্রিয়ান লুনার জন্য, যিনি দলের অন্যতম প্রিয় বিদেশি খেলোয়াড়ের আসনে বিরাজমান। এর পর আসে ভিবিন মোহননের অংশ—“ ভিবিন ভিবিন, থালিরে কুলিরে”।
এখানে ‘থালিরে’ মানে কোমল কুঁড়ি আর ‘কুলিরে’ মানে ঠাণ্ডা বা শীতল। শব্দগুলো মজাদার শোনালেও এগুলোতে আছে গভীর তাৎপর্য। ভিবিন একজন ঘরোয়া প্রতিভা, যিনি অ্যাকাডেমি থেকে উঠে এসে সিনিয়র দলের হয়ে খেলছেন। এই স্লোগানটি একসময় সহাল আব্দুল সামাদের জন্য ব্যবহৃত হত। কিন্তু তিনি মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে চলে যাওয়ার পর এটি ব্যবহৃত হয় ভিবিনের জন্য।
এখানেই কেরালা ব্লাস্টার্স সমর্থকদের সৌন্দর্য। তাদের স্লোগানগুলি শুধু খেলোয়াড়দের নয়, সম্পর্কগুলিরও প্রশংসা করে। আর এই স্লোগানটি তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয়গুলোর একটি।
বেঙ্গালুরু এফসি – সান্তোষাক্কে
বেঙ্গালুরু এফসি-র সমর্থকেরা গ্যালারিতে হইচই আর উদ্দীপনা তৈরি করার জন্য সুপরিচিত, আর তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত স্লোগান হলো “সান্তোষাক্কে”। এটি জনপ্রিয় একটি কন্নড় গানের অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে, যা কর্ণাটকের যে কোনও তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরই জানা। প্রবীণদেরও অনেকেই এই গান গুণগুণ করেন।
এই শক্তিশালী স্লোগান ক্লাবকে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করে। এটি শুধুই ফুটবলের স্লোগান নয়, বরং এমন একটি সুর, যার সঙ্গে মানুষ বড় হয়েছে—যা এখন পরিণত হয়েছে যুদ্ধের আহ্বানে। এমনকি কন্নড় ভাষা না জানলেও সহজেই এই স্লোগানে যোগ দেওয়া যায়। এর ছন্দ একেবারে প্রাণবন্ত, আর যখন পুরো স্টেডিয়াম একসঙ্গে গেয়ে ওঠে, তখন স্রোতের মতো টেনে নিয়ে যায় সবাইকে। ফুটবলারদের কাছে এটি যেন উৎসবের মতো অনুভূতি জাগায় আর প্রতিপক্ষের কাছে এটি হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। একটি স্লোগানের তো এমনই কার্যকরী হওয়া উচিত।
এফসি গোয়া – উজ্জো
কোঙ্কণি ভাষায় “উজ্জো” শব্দের অর্থ আগুন।এফসি গোয়ার মেজাজের সঙ্গে এটি একেবারেই মানানসই। এই স্লোগানের জন্ম হয় ২০১৮ সালে, যখন একদল সমর্থক বেঙ্গালুরু এফসির বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে চিৎকার করে এটি বলতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্তেই তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এখন এফসি গোয়ার কোনও ম্যাচ “উজ্জো” ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। স্লোগান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ফাতোরদা গর্জে ওঠে। এক শব্দ, বারবার চিৎকার করে বলা হয়, কিন্তু এত জোরে আর এত আবেগ নিয়ে তা নিক্ষেপ করা হয় যে, মনে হয় আকাশে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে। আইএসএল শুরুর বহু আগে থেকেই গোয়ায় ছিল গভীর ফুটবল সংস্কৃতি। “উজ্জো” সেই আগুনকেই জ্বালিয়ে রাখে। এটি ছোট, জোরালো এবং হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এক স্লোগান, যা একটা দলের ফুটবলারদের মননে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট – ‘আমরা কারা, মোহনবাগান’!
ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে কিছু স্লোগান এতটাই প্রতীকী ও কিংবদন্তিতুল্য যে, শুনলেই বোঝা যায়, এ কাদের স্লোগান। যেমন সবুজ-মেরুন সমর্থকদের এই স্লোগান। খেলার আগে হোক বা পরে এবং খেলা চলাকালীন গ্যালারিতে তারা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে—“আরে আমরা কারা?” বজ্রধ্বনির মতো উত্তর আসে—“মোহনবাগান!” এর পর ফের শোনা যায়—“জিতবে কারা?” আরও একবার পুরো গ্যালারি একসাথে গর্জে ওঠে—“মোহনবাগান!”
এটি যতটা সহজ, ততটাই কার্যকর। স্টেডিয়ামে থাকা যে কেউ দিতে পারে এই স্লোগান আর যখন সল্টলেকে পঞ্চাশ-ষাট হাজার কণ্ঠ একসাথে এই স্লোগান তোলে, তখন তাতে বিদ্যূতের মতো প্রভাব দেখা যায়।মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট সমর্থকদের জন্য এ শুধু ফুটবল নয়, উত্তরাধিকারও বটে। এই স্লোগান তাদের সংস্কৃতিরই এক অংশ, যেমনটা তাদের প্রিয় ক্লাব। খেলোয়াড়দেরও এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে তারা শুধু সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে দেয়নি, তারা নিজেদের কাঁধে বহন করছে এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
ইস্টবেঙ্গল এফসি – ও ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে চলো
“এগিয়ে চলো” মানে বাঙালিরা কে না জানে? অর্থাৎ, সামনে এগিয়ে যাও। এই স্লোগানটির মূল কথাই হলো—অগ্রসর হও, লড়াই চালিয়ে যাও।ইস্টবেঙ্গল এফসি-র সমর্থকেরা তাদের আবেগ ও উচ্ছ্বাসের জন্য বিখ্যাত আর এই স্লোগান তারই প্রতিফলন। সেলিব্রেশনের চেয়ে বেশি এ এক ধরনের তাগিদ। প্রতিবার যখন তারা এটি গায়, তারা প্রিয় দলের ফুটবলারদের বার্তা পাঠায়, লড়াই চালিয়ে যাও, দৌড় থামিও না, এগিয়ে চলো।
এই স্লোগান ক্লাবের ইতিহাসকেও প্রতিফলিত করে। ইস্টবেঙ্গল এফসি সব সময় শ্রমজীবী মানুষের দল হিসেবে পরিচিত। তাদের জীবনে যে বাধাই আসুক না কেন, সামনে এগিয়ে যাওয়াই ছিল মূলমন্ত্র। যখন সমর্থকেরা একসাথে “এগিয়ে চলো” বলে ওঠে, তখন তা যেন সেই সংগ্রামী অভিযানেরই স্মৃতি জাগায়। বিশেষ করে কলকাতা ডার্বিতে যখন গ্যালারি কেঁপে ওঠে এই স্লোগানে, তখন সেই আওয়াজ সত্যিই হয়ে ওঠে অবিস্মরণীয়।