ডুরান্ড কাপ ফাইনাল: হাফ ডজন গোল করে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন নর্থইস্ট ইউনাইটেড
নির্ধারিত সময়ে এত বড় (৬-১) ব্যবধানে কেউ ডুরান্ড কাপ ফাইনালে জেতেনি। ফাইনালে হাফ ডজন গোল করে জেতা, স্বাধীন ভারতে ডুরান্ড কাপের ইতিহাসে এই প্রথম।

রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে টানা দ্বিতীয়বার ডুরান্ড কাপ জিতে নিল ইন্ডিয়ান সুপার লিগের দল নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি। শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতার বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিপক্ষ কলকাতার নবাগত দল ডায়মন্ড হারবার এফসি-কে আধ ডজন গোল দিয়ে খেতাব জিতে নিল তারা। একটির বেশি গোল শোধ করতে পারেনি ডায়মন্ড-বাহিনী। সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে যে দাপট দেখা গিয়েছিল তাদের খেলায়, নর্থইস্টের সামনে তার সামান্য ঝলকই দেখা গিয়েছে তাদের পারফরম্যান্সে।
১৮৮৮ থেকে শুরু হওয়া এই ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টে দেশের স্বাধীনতার পর নির্ধারিত সময়ে এত বড় (৬-১) ব্যবধানে কেউ ফাইনালে জেতেনি। ২০০১-এ মাহিন্দ্রা ইউনাইটেড ৫-০-য় চার্চিল ব্রাদার্সকে হারিয়ে ডুরান্ড কাপ জয় করেছিল। ১৯৫৩-য় ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিকে ৪-০-য় হারিয়েছিল মোহনবাগান। কিন্তু ফাইনালে হাফ ডজন গোল করে জেতা, স্বাধীন ভারতে ডুরান্ড কাপের ইতিহাসে এই প্রথম।
যদিও টানা দু’বার ডুরান্ড কাপ জয়ের নজির কলকাতার দুই প্রধানেরও আছে। দু’বার নয়, তারা টানা তিনবার জিতেছে। মোহনবাগান দু’বার (১৯৬৩, ৬৪, ৬৫ ও ১৯৮৪, ৮৫, ৮৬) এবং ইস্টবেঙ্গল একবার (১৯৮৯, ৯০, ৯১)। সে দিক থেকে তারা নয়া নজির না গড়লেও চলতি শতকে কোনও দল টানা দু’বার ডুরান্ড কাপ জিততে পারেনি।
চ্যাম্পিয়ন হয়ে এক কোটি ২১ লক্ষ টাকার আর্থিক পুরস্কার পেল তারা। সঙ্গে ঐতিহাসিক ডুরান্ড কাপ ও সিমলা ট্রফি। এ ছাড়াও প্রেসিডেন্টস কাপ তাদের হাতে তুলে দেবেন দেশের রাষ্ট্রপতি শ্রীমতি দ্রৌপদি মুর্মু। আগামী সপ্তাহে রাষ্ট্রপতি ভবনে এক অনুষ্ঠানে এই ঐতিহ্যবাহী কাপ তিনি তুলে দেবেন বিজয়ী দলের হাতে।
Back-to-back supremacy! 🏆
— Indian Super League (@IndSuperLeague) August 23, 2025
The Highlanders defend the @thedurandcup after another remarkable campaign! 🔥#DurandCup2025 #NEUDHFC #NorthEastUnitedFC #IndianFootball #134thEditionofIndianOilDurandCup pic.twitter.com/0ov0YHbJ6o
এ দিন নর্থইস্টের আধিপত্য বিস্তার করা ম্যাচের ৩০ মিনিটের মাথায় প্রথম গোল করেন আশির আখতার। প্রথমার্ধের সংযুক্ত সময়ে দলকে এগিয়ে দেন পার্থিব গগৈ। দ্বিতীয়ার্ধে ৫০ মিনিটের মাথায় তৃতীয় গোল করেন রুয়াতকিমা, ওরফে থোই সিং।
৮১ মিনিটের মাথায় জায়রো বাস্তারা ও ৮৬ মিনিটে অ্যান্ডি গাইতানের গোল জয় নিশ্চিত করে এবং সংযুক্ত সময়ের তৃতীয় মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে খেতাব জয় সম্পন্ন করেন তাদের তারকা ফরোয়ার্ড আলাদিন আজারেই, যিনি আট গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরারের খেতাব গোল্ডেন বুট জিতে নেন। গোল্ডেন বলও তিনিই জিতে নেন। গত আইএসএলেও এই দুই খেতাব জিতেছিলেন মরক্কান স্ট্রাইকারই। নর্থইস্টের গোলকিপার গুরমিত সিং জেতেন গোল্ডেন গ্লাভ খেতাব। ডায়মন্ড হারবারের স্লোভেনিয়ান ফরোয়ার্ড লুকা মাজেন একটি গোল শোধ করেন। সারা ম্যাচে ১২ শট গোলে রাখে নর্থইস্ট, যেখানে পাঁচটি গোলমুখী শট নেয় ডায়মন্ড হারবার, যার মধ্যে চারটিই দ্বিতীয়ার্ধে।
এ দিন শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে চাপে রাখে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি। তাদের কোচ হুয়ান পেদ্রো বেনালি এ দিন প্রতিপক্ষকে কৌশলের চালে মাত দেন তাঁর দলের প্রধান অ্যাটাকার আলাদিন আজারেইকে কিছুটা পিছন থেকে খেলিয়ে। তিনি জানতেন ডায়মন্ড হারবারের খেলোয়াড়রা মরক্কোর গোলমেশিনকে কড়া পাহাড়ায় রাখবেন। সে কথা মাথায় রেখেই আলাদিন প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় কমই থাকছিলেন। তিনি গোলের সুযোগ তৈরিতে মন দেন এবং তাতেও নর্থইস্টের আক্রমণের ধার এতটুকু কমেনি।
প্রথমার্ধে যেখানে উত্তর-পূর্ব ভারতের দল হাফ ডজন শট গোলে রাখতে পারে, সেখানে একটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি ডায়মন্ড হারবার এফসি। তাদের আক্রমণের চাপে ডায়মন্ড হারবারের রক্ষণও বেশ আগোছালো হয়ে যায়। তাদের রক্ষণের মধ্যে ছোট ছোট অনেক ফাটল দেখা যায়। এই ফাটল কাজে লাগিয়েই ৩০ মিনিটের মাথায় কর্নারের পর কলকাতার দলের বক্সে হানা দেয় এবং গোল বাঁচাতে গিয়ে গোলকিপার মিরশাদ মিচুর হাত থেকে বল ছিটকে আসে নর্থইস্ট ডিফেন্ডার আশির আখতারের পায়ে। গোলের সামনে থেকে জালে বল জড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি তিনি (১-০)।
গোল খাওয়ার পর তা শোধ করার চেষ্টা শুরু করে ডায়মন্ড বাহিনী। কিন্তু সে জন্য প্রায়ই যে তাদের রক্ষণ প্রায় জনশূন্য হয়ে যাচ্ছিল, তা খেয়াল করেনি তারা। প্রথমার্ধের একেবারে শেষ দিকে সংযুক্ত সময়ে মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে যখন ফাইনাল থার্ডে প্রবেশ করেন অসমের উঠতি তারকা পার্থিব গগৈ, তখন তাঁকে বাধা দেওয়ার মতো খুব কম খেলোয়াড়ই ছিলেন। প্রায় বিনা বাধায় বাঁদিক দিয়ে বক্সে ঢুকে কোণাকুনি শট নেন সোজা গোলে, যা দ্বিতীয় পোস্টের দিক দিয়ে গোলে ঢুকে পড়ে। মিরশাদ হাওয়ায় শরীর ভাসিয়ে বল আটকানোর চেষ্টা করলেও নাগাল পাননি (২-০)।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে একই মেজাজে ছিল নর্থইস্ট। তবে প্রথমার্ধের চেয়ে এই অর্ধে আলাদিনকে কিছুটা চনমনে মনে হয়। চাপে থাকা প্রতিপক্ষের ওপর চাপ আরও বাড়ানোর জন্যই এই কৌশল। ৫০ মিনিটের মাথাতেই আলাদিনের চনমনে হয়ে ওঠার প্রভাব টের পায় ডায়মন্ড বাহিনী। সেন্টার লাইনের এ পারে বল পেয়ে বাঁ দিক দিয়ে দ্রুত গোল এরিয়ায় ঢুকে পড়েন তিনি। তাঁর গতির সঙ্গে পেরে ওঠেননি হীরক বাহিনীর ডিফেন্ডাররা। বক্সের বাঁ দিক থেকে গোলের সামনে নিখুঁত ক্রস পাঠান আলাদিন, যা অনুসরণ করে দূরের পোস্টের দিক থেকে পায়ের টোকায় জালে জড়িয়ে দেন রুয়াতকিমা, ওরফে থোই সিং (৩-০)।
তিন গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করে ডায়মন্ড হারবার এফসি। কিন্তু ততক্ষণে তাদের দলের অনেকেই ক্লান্ত হতে শুরু করেছেন। নর্থইস্টের খেলোয়াড়রাও জয়ের গন্ধ পেয়ে যান। ফলে কিছুটা হলেও গা ছাড়া ভাবা দেখা যায় তাদের খেলায়। এ রকমই সময়ে, ৬৮ মিনিটের মাথায় কর্নার থেকে একটি গোল পেয়ে যায় ডায়মন্ড হারবার।
কর্নারের পর জবি জাস্টিন নীচু হয়ে হেড করে বল গোলের দিকে পাঠান, যাতে ট্যাপ করে বলের গতিপথ বদলে জালে জড়িয়ে দেন লুকা মাজেন। তাঁর টোকাও এমন কিছু জোরালো ছিল না। কিন্তু বলের গতিপথ হঠাৎ বদলে যাওয়ায় সঠিক জায়গায় ছিলেন না গোলকিপার গুরমিত। ফলে প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে বল গোলে ঢুকে যায় (৩-১)।
ব্যবধান কমানোর পর ফের উৎসাহ পেয়ে যায় হীরক-বাহিনী এবং ব্যবধান ফের কমানোর চেষ্টা শুরু করে তারা। নর্থইস্টও জয় নিশ্চিত করতে আরও একটি গোল পাওয়ার জন্য নড়েচড়ে বসে এবং এই সময়ে তৎপর হতে দেখা যায় আলাদিনকে। ৭৫ মিনিটের মাথায় তাঁকে ফাউল করেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার মিকেল কোর্তাজার। তবে বক্সের সামনে থেকে ফ্রি কিক পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি আলাদিন।
ড্রিঙ্কস ব্রেকের পর ৮১ মিনিটের মাথায় জয় ও টানা দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ৯০ শতাংশ নিশ্চিত করে ফেলেন রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামা স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড জায়রো বাস্তারা এবং তার পাঁচ মিনিট পরেই তাদের পাঁচ নম্বর গোলের পর নর্থইস্টের খেতাব জয় নিয়ে কোনও সংশয়ই ছিল না।
বাঁ দিকের উইং থেকে ফ্রি কিক বক্সে উড়ে যাওয়ার পর তা বক্সের বাইরে চলে আসে জায়রোর পায়ে। তখন মিরশাদ গোলের বাঁ দিক ঘেঁষে ছিলেন। তাঁর ডানদিকের ফাঁকা জায়গা দিয়ে দূরপাল্লার শটে বল জালে জড়িয়ে দেন স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড (৪-১)।
নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার চার মিনিট আগে ফের দেখা যায় আলাদিনের জাদু এবং বাঁ দিক দিয়ে ফের বল নিয়ে উঠে দূরের পোস্টের দিকে ক্রস বাড়ান, যা পড়ে অ্যান্ডি গাইতানের পায়ে। তিনি হাঁটুর নীচ দিয়ে বল গোলে পাঠিয়ে দেন (৫-১)।
ফাইনালে এতগুলো গোল হয়ে গেলেও তাঁর নামে কোনও গোল নেই দেখে ম্যাচের শেষ মুহূর্তে গোল করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন আলাদিন এবং সংযুক্ত সময়ের তৃতীয় মিনিটে গোলমুখী মরক্কান তারকাকে বক্সের মধ্যে টেনে ফেলে দেওয়ায় পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। আলাদিনের স্পট কিক বারের নীচে লেগে গোলে ঢুকে যায় (৬-১)। ভারতীয় ফুটবলে এটি তাঁর ৪০তম গোল এবং ডুরান্ড কাপে অষ্টম গোল।
ততক্ষণে ভিআইপি বক্সে টানা দ্বিতীয়বার ডুরান্ড খেতাব জয়ের উৎসব পালন শুরু করে দিয়েছেন নর্থইস্ট ইউনাইটেডের কর্ণধার বলিউড তারকা জন আব্রাহাম ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা।