ইন্ডিয়ান সুপার লিগে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের অভিযান তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত হতে পারে, তবে তাদের প্রভাব ও সাফল্য যথেষ্ট। ২০২০–২১ মরশুমে লিগে প্রবেশ করার পর থেকেই তাদের ধারাবাহিকতা, এবং সাফল্যের উচ্চাকাঙ্খা শক্তিশালী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাদের

কলকাতার এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব প্রতিবার প্লে-অফে পৌঁছেছে, যা তাদের সঠিক পরিকল্পনা ও জেতার মানসিকতার পরিচয় দেয়। পরপর আইএসএল শিল্ড জয়, দুবার কাপ এবং একের পর এক দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য তাদের আইএসএলের সেরা ক্লাবগুলির তালিকায় স্থান নিশ্চিত করেছে

বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল, আক্রমণের আগ্রাস ও রক্ষণভাগের দৃঢ়তায় তারা কখনও খেলার মানের সঙ্গে আপস করেনি। দেশের অভিজ্ঞ তারকা, তরুণ তূর্কি থেকে আন্তর্জাতিক নামজাদা ফুটবলার—সবরকম উপাদান নিয়েই মাঠে নেমেছে তারা। তাই সবুজ-মেরুন বাহিনীর সর্বকালের সেরা আইএসএল একাদশ বেছে নেওয়া বেশ কঠিন কাজ। তবু এই চেষ্টা করেছি আমরা এবং এই দলে ভারসাম্য রাখারও চেষ্টা করেছি

চলুন দেখে নিই আইএসএলে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের সর্বকালের সেরা একাদশ কেমন হতে পারে।

গোলকিপার: বিশাল কয়েথ

সবুজ-মেরুন বাহিনীর অভিষেক মরশুমে ২৩ ম্যাচে ১০টি ক্লিন শিটসহ গোল্ডেন গ্লাভ জিতেছিলেন অরিন্দম ভট্টাচার্য এবং পরের মরশুমে অমরিন্দর সিং দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান, তবু বিশাল কয়েথই এই তালিকায় জায়গা পেয়েছেন শেষ তিন মরশুমে তার অভাবনীয় ধারাবাহিকতার জন্যসব মিলিয়ে ৭৫টি ম্যাচে ৩৫টি ক্লিন শিট এবং মাত্র ৬৯টি গোল হজম করেছেন বিশাল। দু’বার শিল্ড ও দু’বার কাপ জয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এ ছাড়া শেষ তিন মরশুমে দু’বার গোল্ডেন গ্লাভ জয়ী হওয়ায় তাঁর এই দলে থাকা নিয়ে কোনও দ্বিমতই নেই।

রাইট-ব্যাক: আশিস রাই

২০২২–২৩ মরশুমের আগে যোগ দিয়ে দলের রক্ষণে অন্যতম প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছেন আশিস। পরিশ্রম, রক্ষণে সচেতনতা ও আক্রমণে ওভারল্যাপ— সবই তাঁর খেলার অঙ্গ। ৬৬টি ম্যাচ খেলে ২০ বার দলকে গোল অক্ষত রাখতে সাহায্য করেছেন। পাশাপাশি চারটি অ্যাসিস্ট ও একটি গুরুত্বপূর্ণ গোলও করেছেন হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে। হুয়ান ফেরান্দোর অধীনে মাঝে মাঝে আক্রমণাত্মক ভূমিকাও পালন করেছেন তিনি

সেন্টার-ব্যাক: প্রীতম কোটালআলবার্তো রদ্রিগেজ

শুরু থেকেই ডিফেন্সের স্তম্ভ ছিলেন প্রীতম কোটাল। ৬৮ ম্যাচে দুর্দান্ত নেতৃত্ব, দারুণ সংগঠন এবং নিখুঁত পজিশনিং তাঁকে সমর্থকদের কাছে ফেভারিট করে তোলে। একাধিক পজিশনে দক্ষতা এবং টেকনিকের দক্ষতায় সন্দেশ ঝিঙ্গনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন তিনি।

আলবার্তো রদ্রিগেজ মাত্র একটি মরশুম খেলেন এবং দলের ১৬টি ক্লিন শিটের মধ্যে ১৪টিতেই দায়িত্বে ছিলেন। গোল করেছেন পাঁচটি, অ্যাসিস্ট একটি এবং পজিশন নেওয়ার দুর্দান্ত ক্ষমতায় নজর কেড়েছেন। অভিষেক মরশুমেই দলের জোড়া খেতাব জয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন এই স্প্যানিশ তারকা

লেফট-ব্যাক: শুভাশিস বসু

আইএসএল যুগে মোহনবাগানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য লেফট-ব্যাক এবং সম্ভবত পুরো লিগেই সেরা শুভাশিস। প্রীতম কোটালের পর অধিনায়ক হয়ে দলকে দুটি শিল্ড ও একটি কাপ জেতান মাত্র দুই মরশুমে। ১৫টি গোল অবদান, ৪৭টি ক্লিন শিটে সহায়তা এবং সর্বোচ্চ গোলদাতা ডিফেন্ডার হিসেবে ২০২৪–২৫ মরশুমে ৬টি গোল— সবই তাঁর অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের প্রমাণ গত পাঁচ মরশুমে তিনি সবুজ-মেরুন বাহিনীর নিয়মিত সদস্য। রক্ষণের বাঁ দিকে তিনি স্তম্ভ তো বটেই, মাঝে মাঝে অনেকটা উঠেও খেলেন তিনি। এমনকী প্রয়োজনে সেন্টার ব্যাকের ভূমিকাও পালন করেছেন শুভাশিস। এই দলে তাঁর জায়গা হওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও বিতর্ক নেই।

ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার: কার্ল ম্যাকহিউ

তিন মরশুমে ৬০টি ম্যাচ খেলে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ভেঙেছেন, খেলায় ছন্দ এনেছেন এবং রক্ষণ ও মাঝমাঠের মধ্যে যোগসূত্রের ভূমিকা পালন করেছেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমী এবং যে কোনও কোচের কাছে আদর্শ ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন কার্ল। সেন্টার ব্যাকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে পিছন থেকে আক্রমণ তৈরিতে বরাবরই সাহায্য করেছেন তিনি। প্রখর অনুমান ক্ষমতা দিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণকে বানচাল করে দেন প্রায়ই। তাঁর এই ফুটবল দক্ষতা এবং লড়াই করার মানসিকতা দলের সাফল্যের ভিত তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল তাই তাঁকে বাদ দিয়ে মোহনবাগান দল ভাবাই যায় না।

সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার: আপুইয়া

মাত্র একটি মরশুমে অসাধারণ প্রভাব ফেলে সর্বকালের সেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছেন এই পাহাড়ী ফুটবলারমাঝমাঠে খেলার ছন্দ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপক্ষের পা থেকে বল ছিনিয়ে নেওয়ায় তিনি যেমন পারদর্শী, তেমনই কঠিন সময়ে গোল করেও ২০২৪–২৫ মরশুমে দলের জোড়া খেতাব জয়ে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন। গত মরশুমে তিনি ছিলেন দলের হৃদপিণ্ড। রক্ষণ ও আক্রমণের মধ্যে সেতু তৈরি করেছেন। তিনি বাগান শিবিরে যোগ দেওয়া আগে দীপক টাংরি এই জায়গায় ধারাবাহিক হলেও আপুইয়ার কার্যকরী ভূমিকা ও পরিসংখ্যানই তাঁকে দীপকের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে

রাইট উইঙ্গার: মনবীর সিং

আইএসএল অভিযানের শুরু থেকেই দলের সদস্য মনবীর। ২৩ গোল ও ১৮টি অ্যাসিস্ট রয়েছে তাঁর। দুর্দান্ত গতি ও স্ট্যামিনা দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে পারেন তিনি। বেশির ভাগ সময়েই রাইট উইংয়ে খেলেন তিনি। কখনও কখনও বাঁ দিক দিয়েও ধারালো আক্রমণে ওঠেন। কঠিন ম্যাচে অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভারতের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড হিসেবে হয়ে উঠেছেন নির্ভরযোগ্য।

অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার: দিমিত্রিয়স পেট্রাটস

২০২২ সালে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দিয়ে ৭০টি ম্যাচে ২৬ গোল করেন তিনি, যা ক্লাবের আইএসএল ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ ছাড়াও ছিল ১৭টি অ্যাসিস্ট। গোল করাতে তো বটেই, গোলের সুযোগ তৈরি করাতেও তিনি কতটা দক্ষ, তার প্রমাণ এখান থেকেই পাওয়া যায়। মেরিনারদের সাম্প্রতিক সাফল্যে তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইএসএল শিল্ড ও কাপ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাঁর। ফ্যানদের ফেভারিট এবং এক আধুনিক ফরোয়ার্ড হিসেবে তাঁর নাম ক্লাব ইতিহাসে অবশ্যই লেখা থাকবে

লেফট উইঙ্গার: লিস্টন কোলাসো

হায়দরাবাদ থেকে আসার পর বাঁ প্রান্ত দিয়ে ধারাবাহিক আক্রমণে অবদান রেখেছেন লিস্টনতাঁর ফুটবল জীবনের সেরা সময়টা তিনি সবুজ-মেরুন শিবিরেই কাটিয়েছেন। গত চার মরশুম ধরে ড্রিবলিং, লং শট ও সেট-পিসে কোলাসোর অসাধারণ দক্ষতা নিঃসন্দেহে তাঁকে এই পজিশনে থাকার যোগ্য করে তুলেছে। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ধারালো আক্রমণে তিনি অন্যতম অস্ত্র এই গোয়ানিজ তারকা। সেই কারণেই সেরা একাদশে অবশ্যই থাকবেন তিনি।

স্ট্রাইকার: রয় কৃষ্ণা

আইএসএলে মোহনবাগানের প্রথম বছরে দলের আক্রমণের মেরুদণ্ড ছিলেন ফিজির এই তারকা। ২১ গোল ও ১২টি অ্যাসিস্ট করেন সে বার। যদিও ট্রফি আসেনি, কিন্তু তাঁর মুভমেন্ট, ফিনিশিং ও কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্স রয়কে এই একাদশে জায়গা দিয়েছে যদিও গত দুই মরশুমে জেসন কামিংস আক্রমণে দুর্দ্ন্ত ছিলেন, তবে রয়ের আক্রমণ তৈরি করে গোল করার বাড়তি ক্ষমতাই তাঁকে এই দলে জায়গা দিয়েছে।

প্রধান কোচ: আন্তোনিও লোপেজ হাবাস

দুই দফার কোচিং জার্নিতে হাবাস দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দুর্দান্তভাবে। প্রথম শিল্ড এনে দেন ভারতে ফিরে আসার পর। প্রথমবার অল্পের জন্য সাফল্যের দরজা পেরোতে পারেনি তাঁর দল। তবে ফিরে এসে বুঝিয়ে দেন, তিনি আসলে কী। তাঁর প্রশিক্ষণেই সবুজ-মেরুন বাহিনী প্রথম শিল্ড জয় করে। তাঁর অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বে দল অভিজাত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে দলের মধ্যে তিনি লড়াইয়ের মানসিকতার বীজ বপন করেন, যাতে সর্বোচ্চ স্তরে দল শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। হাবাসের তৈরি করে যাওয়া এই ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই মোহনবাগানকে ঐতিহাসিক সাফল্য এনে দেন হোসে মোলিনা।