আপুইয়ার উত্থান, পাহাড় থেকে সমতলে!
হোল্ডিং মিডফিল্ডার, বক্স-টু-বক্স বা আক্রমণভাগে—যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই নিজের সেরাটা দেন আপুইয়া। বড় ম্যাচে জ্বলে ওঠার ক্ষমতা যে আছে তাঁর, তা বারবার প্রমাণ করেছেন আপুইয়া।

তাঁর পারফরম্যান্স শুধু তাঁর টেকনিক্যাল দক্ষতায় সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এক নীরব অধ্যবসায়, দৃঢ় উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অটল সংকল্পের দৃষ্টান্ত, যা তাঁকে ভারতের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডারে পরিণত করেছে। ফুটবল মাঠে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার এক বিশেষজ্ঞের ভূমিকা এবং ইন্ডিয়ান সুপার লিগে এই পজিশনে সবচেয়ে কার্যকরী খেলোয়াড়দের তালিকায় লালেঙমাউইয়া রালতে ওরফে আপুইয়ার নাম অবধারিত ভাবে থাকবে।
পাহাড়ে উদীয়মান খেলোয়াড়ের খেতাব
মিজোরামের সবুজ পাহাড়ে নিজের দক্ষতায় শান দিয়ে শুরু করে আইএসএল-এর ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। কেরিয়ারের শুরুতেই ভারতের অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেওয়া ছিল তাঁর এক উল্লেখযোগ্য সাফল্য। যার পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি আপুইয়াকে।
২০১৯-এ ইন্ডিয়ান অ্যারোজ থেকে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসিতে যোগ দেন আপুইয়া। আইএসএলে অভিষেক মরশুমে তিনি ১০টি ম্যাচ খেলেন। যদিও দলটি লিগ টেবিলের নিচের দিকে শেষ করেছিল, তবু আপুইয়াকে সেরা পারফরমারদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।
পরের মশুমেই, ২০২০–২১ সালে, আপুইয়া বুঝিয়ে দেন, কতটা সম্ভাবনাময় তিনি। ২২টি ম্যাচ খেলে দলকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। অসাধারণ পরিশ্রম, অদমনীয় দক্ষতা এবং পসিংয়ের পরিণত ক্ষমতার জন্য সেই মরশুমে তিনি "ইমার্জিং প্লেয়ার অফ দ্য সিজন" পুরস্কার জেতেন। একই সঙ্গে, মাত্র ২০ বছর বয়সে আইএসএল ইতিহাসের কনিষ্ঠতম অধিনায়কও হন।
মুম্বইয়ে মিডফিল্ড জেনারেল
নর্থইস্ট ইউনাইটেডে দুর্দান্ত সময় কাটিয়ে পরের মরশুমে তিনি মুম্বই সিটি এফসিতে যোগ দেন এক দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে।
আইজলের কাদা মাঠে গড়ে ওঠা সাহস মুম্বইয়ের উপকূলে গিয়ে যেন নতুন করে জ্বলে ওঠে। ২০২১-এ মুম্বই সিটিতে যোগ দিয়ে আপুইয়া দ্রুত মানিয়ে নেন নতুন পরিবেশের সঙ্গে। ২০২২-২৩-এ মুম্বই সিটির লিগ শিল্ড জয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন তিনি। অভিজ্ঞ খেলোয়াড় গ্রেগ স্টুয়ার্ট এবং আহমেদ জাহুর সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী মাঝমাঠের জুটি এবং ৮৪% পাসিং অ্যাকিউরেসি রেখেছিলেন শেষ পর্যন্ত—যা চাপের মুখে মিডফিল্ডারদের পক্ষে এক চমৎকার পরিসংখ্যান।
স্টুয়ার্ট এবং জাহু দল ছাড়ার পরও আপুইয়া দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ডাচ মিডফিল্ডার ইওল ফান নিফের সঙ্গে মজবুত জুটি গড়ে মুম্বই সিটিকে ২০২৩-২৪ আইএসএল কাপ জয়ে সাহায্য করেন। নতুন কোচ পিটার ক্রাতকির স্টাইলের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেন তিনি। আর তাতেই আসে সাফল্য।
হোল্ডিং মিডফিল্ডার, বক্স-টু-বক্স বা আক্রমণভাগে—যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই নিজের সেরাটা দেন আপুইয়া। ২০২৩-২৪ কাপ ফাইনালে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের বিরুদ্ধে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন তিনি। বড় ম্যাচে জ্বলে ওঠার ক্ষমতা যে আছে তাঁর, তা আবারও প্রমাণ করেন আপুইয়া।
পাল তোলা নৌকোর অপরিহার্য কাণ্ডারী
২০২৪-২৫ মরশুম শুরুর আগে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দেন আপুইয়া। আইএসএলের ইতিহাসে সবচেয়ে চর্চিত দলবদলগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সেটি। ডিসেম্বরে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে ২-০ জয় দিয়ে তিনি আইএসএলে শততম ম্যাচ উদযাপন করেন। এই লিগে একশো ম্যাচ খেলা সবচেয়ে কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন তিনি।
মাঝমাঠে রক্ষণভাগে ভারসাম্য, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা এবং ঠাণ্ডা মাথা নিয়ে ফের নিজেকে প্রমাণ করেন তিনি। ট্যাকল, ইন্টারসেপশন, এবং ম্যাচের গতি নিয়ন্ত্রণে তাঁর ক্ষমতা তাঁকে মেরিনারদের জন্য অপরিহার্য করে তোলে। যেমন হয়ে উঠেছিলেন মুম্বইয়ের জন্যও।
২০২৪-২৫ আইএসএলে জোড়া খেতাব (লিগ ও কাপ) জয়ে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট দলের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন তিনি। সবুজ-মেরুন বাহিনীর মাঝমাঠে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে আসে নিয়ন্ত্রণ, স্থিতিশীলতা এবং কৌশলগত শক্তি। দলের এই ঐতিহাসিক মরশুমে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সারা মরশুমের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে জামশেদপুর এফসির বিরুদ্ধে ৯৪তম মিনিটে আপুইয়ার বিস্ময়কর গোল, যা মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে কাপ ফাইনালে পৌঁছে দেয়। সেই গোল ফের প্রমাণ করে দেয়, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে জ্বলে ওঠার নামই হল আপুইয়া।