ইন্ডিয়ান সুপার লিগে সবচেয়ে জনপ্রিয় বঙ্গ-তারকারা
বাংলার ফুটবলকে গর্বিত করা খেলোয়াড়রা এ রাজ্যের ফুটবলপ্রেমীদের নয়নের মণি। এই ফুটবলাররা আইএসএলেরও তারকা। তাঁরা অনেকেই নজর কেড়েছেন এবং জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছেন।

বাংলা, বাঙালি ও ফুটবলের মধ্যে যে কী সম্পর্ক, তা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই ফুটবল নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে যে আবেগ, উন্মাদনা ছিল, তা যে এখনও কমে যায়নি, তার প্রমাণ বারবার দিয়েছে বঙ্গের ফুটবলপ্রেমীরা।
জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, বাঙালিদের ফুটবলে অংশগ্রহণ। পাড়ায়-পাড়ায় মাঠে-ঘাটে, অলি-গলিতে ফুটবল খেলার দৃশ্য এ বাংলায় একেবারেই অপরিচিত নয়। এ বাংলার বিভিন্ন পাড়া থেকেই উঠে এসেছেন ভারতীয় ফুটবলের বড় বড় নাম।
পিকে ব্যানার্জি, চূণী গোস্বামী, শৈলেন মান্না থেকে কৃশানু দে, শিশির ঘোষ, প্রসূন ব্যানার্জিদের মতো বহু বাঙালি ফুটবলার বাংলাকে ভারত তথা এশিয়ার ফুটবল মানচিত্রে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। এ যুগে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন একাধিক বাঙালি ফুটবলার।
বাংলার ফুটবলের গৌরব বজায় রাখা সেই ফুটবলাররা তাই এ রাজ্যের ফুটবলপ্রেমীদের নয়নের মণি। এমনই কয়েকজন ফুটবলার ইন্ডিয়ান সুপার লিগেরও সম্পদ। তাঁরা নজর কেড়েছেন বারবার। অনাবিল জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছেন। তেমনই কয়েকজন জনপ্রিয় তারকাকে নিয়ে এই প্রতিবেদন।
শুভাশিস বোস (আইএসএলে খেলেছেন ২০১৭-২০২৫)
সব মিলিয়ে আটটি আইএসএলের আসরে খেলেছেন এই তুমুল জনপ্রিয় ডিফেন্ডার। ২০১৭-য় বেঙ্গালুরু এফসি-তে যোগ দেওয়ার পর থেকে টানা খেলে চলেছেন দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগে। ২০১৮-য় মুম্বই সিটি এফসি-তে যোগ দেন তিনি এবং সেখান থেকে ২০২০-তে আসেন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে। সেই থেকে সবুজ-মেরুন বাহিনীই তাঁর ঘর-বাড়ি। ক্লাবকে ঐতিহাসিক সাফল্যে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ভারতীয় দলের হয়েও খেলেছেন শুভাশিস। আইএসএলে ১৬৭টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। এর মধ্যে ৬৩টি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছেন। ডিফেন্ডার হলেও দশটি গোল ও ছ’টি অ্যাসিস্ট রয়েছে তাঁর। এর মধ্যে ছ’টি গোলই তিনি করেন গত মরশুমে। একাধারে যেমন ১০৭টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন, তেমনই ৪১০ বার বল ক্লিয়ার করেছেন, ৮৮বার ব্লক করেছেন এবং ২৬৩ ট্যাকল ও ৯৮০টি বল দখলের লড়াইয়ে সাফল্য পেয়েছেন। যে কোনও ফুটবলারের কাছে এই পরিসংখ্যান ঈর্ষণীয়।
প্রীতম কোটাল (২০১৪-২০২৫)
প্রীতম কোটাল হলেন অন্যতম বাঙালি ফুটবলার, যিনি এ পর্যন্ত সবক’টি আইএসএলের আসরে মাঠে নেমেছেন। ২০১৪-য় পুনে সিটি-র হয়ে তাঁর আইএসএল অভিযান শুরু হয়। পরে এটিকে, দিল্লি ডায়নামোজ, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, কেরালা ব্লাস্টার্স ও চেন্নাইন এফসি-র জার্সি গায়েও আইএসএলে খেলেছেন ৩১ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডার। সাফল্যের সঙ্গে অধিনায়কত্ব করেছেন। আইএসলে ১৮৩টি ম্যাচে নেমেছেন। এর মধ্যে ৫০টি ম্যাচে নিজের দলের গোল অক্ষত রেখেছেন। রক্ষণ ছাড়াও উইং ব্যাক হিসেবেও সফল তিনি। এ পর্যন্ত ৯টি গোলে অ্যাসিস্ট আছে তাঁর। নিজেও পাঁচটি গোল করেছেন। ৬৪টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন। ১৫৯টি সফল ট্যাকল করেছেন এবং ৫৯৪ বার বল দখলের লড়াইয়ে জিতেছেন। ৪৭১ বার বল ক্লিয়ারও করেছেন। ডিফেন্ডার হিসেবে তাঁর পরিসংখ্যানও বেশ ভাল।
শৌভিক চক্রবর্তী (২০১৪-২০২৫)
৩৩ বছর বয়সী এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারও এ পর্যন্ত সবকটি আইএসএলেই খেলেছেন। তিনি আইএসএল অভিযান শুরু করেন দিল্ল ডায়নামোজের সঙ্গে। সেখান থেকে জামশেদপুর এফসি, মুম্বই সিটি এফসি, হায়দরাবাদ এফসি হয়ে ২০২২-এ আসেন ইস্টবেঙ্গল এফসি-তে। এখনও সেই দলেরই অন্যতম নির্ভরশীল সদস্য শৌভিক। লাল-হলুদ বাহিনীর মাঝমাঠকে যেমন সামলে রাখেন, তেমনই প্রতিপক্ষকে সুকৌশলে আটকে রাখার কাজটিও তিনি করেন। আইএসএলে দেড়শোতম ম্যাচের মাইলফলক থেকে তিনি আর দুই ধাপ দূরে রয়েছেন। প্রতিপক্ষকে আটকাতে গিয়ে বহুবারই রেফারির কোপে পড়েছেন তিনি। ৩০ বার হলুদ কার্ড ও চার বার লাল কার্ড দেখেছেন। তবে তিনি যে ভূমিকা পালন করেন, তাতে এই ঝুঁকি থাকেই। এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকা পালনের সাহস তিনি বারবার দেখিয়েছেন এবং সেই কারণেই কোচেদের কাছে তিনি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছেন।
সুব্রত পাল (২০১৪-২০২১)
আইএসএলের শুরুর দিকে ভারতীয় দলের হয়ে খেলা এই বাঙালি গোলকিপার যথেষ্ট জনপ্রিয় অর্জন করেন তাঁর পারফরম্যান্সের জন্য। মোট সাতটি মরশুমে ৯৫টি ম্যাচে গোলে দাঁড়িয়েছেন তিনি। সবচেয়ে সফল হয়েছেন ২০১৬ থেকে ২০১৮-য়। এই সময়ে দুই মরশুমে তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ছিল যথাক্রমে ৮১% ও ৭৬%। এই ৯৫টি ম্যাচে ২৬৯টি সেভ করেছেন সুব্রত। ২৮টি ক্লিন শিট বজায় রেখেছেন। ২০১৪-য় মুম্বই সিটি এফসি-র হয়ে আইএসএলে খেলা শুরু করেন তিনি। পরের মরশুমেও সেখানেই ছিলেন। ২০১৬-য় যোগ দেন নর্থইস্ট ইউনাইটেডে। ২০১৭-১৮ থেকে টানা তিনটি মরশুম তিনি জামশেদপুর এফসি-র হয়ে খেলেন। ২০-২১-এ প্রথমে হায়দরাবাদের হয়ে, পরে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেন।
অরিন্দম ভট্টাচার্য (২০১৪-২০২৩)
আইএসএল ২০১৯-২০-তে এটিকে-র খেতাব জয়ে অরিন্দমের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরের মরশুমেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান তিনি। জেতেন গোল্ডেন গ্লাভও। কিন্তু ফাইনালে এটিকে মোহনবাগানকে জেতাতে পারেননি। ফলে সেই ব্যক্তিগত সাফল্য উপভোগ করতে পারেননি তিনি। সে বার ২৩টি ম্যাচে ৫৩টি সেভ করেছিলেন ও দশটি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ছিল ৭৩ শতাংশ। তার আগের মরশুমে, যে বার এটিকে চ্যাম্পিয়ন হয়, সে বার তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ছিল ৭৪%। সে বার ২০টি ম্যাচে ৫০টি সেভ করেন ও ৯টি ম্যাচে গোল অক্ষত রাখেন। সব মিলিয়ে আইএসএলের ছ’টি মরশুমে ১০০টি ম্যাচে তিনি ৩০টিতে ক্লিন শিট রাখেন ও ২৬৯টি সেভ করেন। তাঁর দিকে ধেয়ে আসা ৬৭ শতাংশ বল আটকেছেন। ২০১৪-য় এফসি পুনের হয়ে আইএসএল শুরু করে মুম্বই সিটি এফসি, এটিকে ও এটিকে মোহনবাগানের হয়ে খেলেন এবং ২০২১-এ যোগ দেন ইস্টবেঙ্গলে এবং ২০২২-এ নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-তে।
দেবজিৎ মজুমদার (২০১৫-২০২৫)
২০১৫ থেকে আইএসএলের আটটি মরশুমে খেলেছেন গোলকিপার দেবজিৎ মজুমদার। মাঝে ২০১৯-২০ মরশুমে তিনি মোহনবাগানকে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার আগের মরশুমে আইএসএলে এটিকে দলে থাকলেও একটিও ম্যাচ খেলতে পারেননি। কিন্তু পরের মরশুমেই আইলিগে তাঁর অনবদ্য পারফরম্যান্স তাঁকে আইএসএলে ফিরিয়ে আনে। তবে সে বার মোহনবাগান ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেন তিনি এবং ১৫টি ম্যাচে লাল-হলুদের গোল সামলান। যার মধ্যে দু’টিতে ক্লিন শিট বজায় রাখতে পেরেছিলেন। মোট ৪৮টি সেভ করেছিলেন এবং তার সেভের শতকরা হার ছিল ৭০ শতাংশ। আইএসএলের আট মরশুমে সব মিলিয়ে ৮৬টি ম্যাচ খেলেছেন দেবজিৎ। মোট ২৬৭টি সেভ করেছেন ও ১৫ বার গোল অক্ষত রাখতে পেরেছেন। সেভ পার্সেন্টেজ ৬৮%। ২০১৫-য় মুম্বই সিটি এফসি-র হয়ে দুটি ম্যাচ খেলে আইএসএল যাত্রা শুরু তাঁর। এটিকে-র হয়ে তিনটি মরশুম খেলেন। ২১-২২ থেকে ২৩-২৪, চার মরশুম ছিলেন চেন্নাইন এফসি-তে। গত মরশুমে ফিরে আসেন ইস্টবেঙ্গলে।
প্রবীর দাস (২০১৪-২০২৫)
জনপ্রিয়তায় অনেককে টেক্কা দিতে পারেন প্রবীর দাস। মাঠের মধ্যে এবং বাইরেও তিনি বেশ রঙিন চরিত্র। ২০১৯-২০ মরশুমে এটিকের খেতাব জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। রয় কৃষ্ণার সঙ্গে জুটি বেঁধে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন সে বার। নিজে কোনও গোল করতে না পারলেও পাঁচটি গোলে অ্যাসিস্ট করেছিলেন প্রবীর। উইং ব্যাক হিসেবে দুর্দান্ত খেলেছিলেন সেই মরশুমে। ডিফেন্ডার হিসেবে ২০টি ম্যাচের মধ্যে আটটিতে ক্লিন শিট বজায় রেখেছিলেন। তবে পরের দুই মরশুমে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হয়ে ততটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেননি। ২০২২-এ যোগ দেন বেঙ্গালুরু এফসি-তে। পরের বছর কেরালা ব্লাস্টার্সে। গত মরশুমের আগে মুম্বই সিটি এফসি-তে যোগ দেন তিনি। আইএসএলে ন’টি মরশুমে এ পর্যন্ত ১২০টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে তাঁর।
কিয়ান নাসিরি (২০২১-২৫)
আইএসএল অভিযান শুরু করার পর দ্বিতীয় ম্যাচেই হ্যাটট্রিক তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে তুলে দেয়। সেই হ্যাটট্রিক আবার করেছিলেন কলকাতা ডার্বিতে। সেই কীর্তির ফলে ইতিহাসে জায়গা করে নেন কিয়ান নাসিরি। এককালের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা জামশিদ নাসির পুত্র কিয়ান ফরোয়ার্ড হিসেবে বেশ ক্ষিপ্র ও গতিময়। তবে সেই হ্যাটট্রিকের পর আইএসএলে আর একটির বেশি গোল করতে পারেননি। তাও চতুর্থ গোলটি করেন ২০২৩-২৪ মরশুমে। ২০২১ থেকে ২০২৪ টানা মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে খেলার পর গত মরশুমের আগে তিনি যোগ দেন চেন্নাইন এফসি-তে। ১৫টি ম্যাচে ৫০০ মিনিট মাঠে ছিলেন। আইএসএলে মোট ৬০টি ম্যাচে নেমেছেন তিনি। ৩৩টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন এবং অ্যাসিস্ট করেছেন দুটি গোলে। তাঁর ২১টির মধ্যে ১২টি শট ছিল গোলের লক্ষ্যে। কলকাতায় বেড়ে ওঠা ২৪ বছর বয়সী এই ফুটবলার এখন ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হচ্ছেন।