চলতি ইন্ডিয়ান সুপার লিগে কেন তারা শিল্ড জয়ের এক নম্বর দাবিদার, তা শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। বাংলার ফুটবলে তাদের অন্যতম চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মহমেডান এসসি-কে ৪-০ গোলে হারিয়ে লিগ টেবলের শীর্ষস্থানে তাদের অবস্থান আরও শক্তপোক্ত করে নিল গতবারের শিল্ডজয়ীরা। এই জয়ের পর হয়তো সবুজ-মেরুন সমর্থকেরা টানা দ্বিতীয়বার শিল্ডজয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিলেন।

পয়েন্ট টেবলের সর্বশেষ স্থানে থাকা মহমেডানের বিরুদ্ধে রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলা বাগান-বাহিনী হয়তো আরও বড় ব্যবধানে জিততে পারত এ দিন। কিন্তু একাধিক সুযোগ হাতছাড়া করে তারা। অধিনায়ক শুভাশিস বোস (১২ ও ৪৩ মিনিটে) ও মনবীর সিং (২০ ও ৫৩), দুজনেই জোড়া গোল করে দলকে জয় এনে দেন। প্রথম লিগের ম্যাচে মহমেডানকে তিন গোলে হারিয়েছিল তারা। এ দিন জয় এল চার গোলে।

এই নিয়ে ১৯টি ম্যাচ খেলে ১৩টি জয় পেল সবুজ-মেরুন বাহিনী। ৪৩ পয়েন্ট নিয়ে দুই নম্বরে থাকা এফসি গোয়ার চেয়ে দশ পয়েন্টের ব্যবধান তৈরি করে ফেলল। ক্রমশ যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে হোসে মোলিনার দল। এই নিয়ে এগারোটি ম্যাচে গোল অক্ষত রইল তাদের, যা আইএসএলে বিশাল কয়েথের ৫০তম ক্লিন শিট।

এ দিন সারা ম্যাচে দাপট ছিল মোহনবাগানেরই। বিরতির ঠিক আগে মহমেডানের মিডফিল্ডার মির্জালল কাসিমভ লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়ায় তাদের অর্ধেক ম্যাচ দশজনে খেলতে হয়। ফলে তাদের আরও চাপে ফেলে দেয় মোহনবাগান। সারা ম্যাচে যেখানে ন’টি শট গোলে রাখে মোহনবাগান, সেখানে দু’টির বেশি শট লক্ষ্য রাখতে পারেনি তাদের প্রতিপক্ষ। মোট ১৪টি গোলের সুযোগ তৈরি করেন মনবীর সিংরা। সেখানে মাত্র সাতটি সুযোগ তৈরি করতে পেরেছেন মনবীর সাইনিরা। মহমেডান গোলরক্ষক পদম ছেত্রী এ দিন চারটি দুর্দান্ত সেভ করেন। মূলত তাঁর তোলা প্রতিরোধের জন্যই পাঁচ গোলে জয় পাওয়া হল না মোহনবাগানের।

সহাল আব্দুল সামাদ, জেসন কামিংস ও আশিস রাই এ দিন সবুজ-মেরুন একাদশে ফিরে আসেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট ও দীপক টাঙরিকে রিজার্ভ বেঞ্চে রেখে। আলবার্তো রড্রিগেজ চোটের জ্ন্য খেলতে পারেননি। অন্য দিকে মহমেডান শিবির মনবীর সাইনি, সাজাদ পারে ও ফ্লোরেন্ট অগিয়েকে নামায় গৌরব বোরা, বিকাশ সিং ও মহম্মদ জাসিমের জায়গায়। মহমেডান যেখানে মনবীর, ফ্রাঙ্কা ও ফানাইকে সামনে রেখে ৪-৩-৩-এ খেলা শুরু করে, সেখানে কামিংস ও ম্যাকলারেনকে ফাইনাল থার্ডে রেখে ৪-৪-২-এ খেলা শুরু করে মোহনবাগান।

শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে খেলা গত বারের শিল্ডজয়ীরা ২০মিনিটের মধ্যেই দু-দু’টি গোল পেয়ে যায়। দু’টিই আসে কর্নার থেকে। প্রথমে ১২ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসোর কর্নারের পর মনবীর সিংয়ের মাথা ও ম্যাকলারেনের পা ঘুরে বল আসে দীপেন্দুর পায়ে। গোলের সামনে থাকা শুভাশিস বোসকে মাপা পাস বাড়ান তিনি। ছ’গজের বক্সের মধ্যে পাওয়া ম্যাচের প্রথম গোলের সুযোগ ছাড়েননি শুভাশিস। পায়ের টোকায় বল জালে জড়িয়ে দেন (১-০)।

এর আট মিনিট পরেই ফের গোল পায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। এ বার কামিংসের কর্নার সোজা গোলের সামনে গিয়ে পৌঁছলে, তা হেড করে গোলে পাঠিয়ে দেন মনবীর। তাঁর পিছনেই গোলকিপার পদম ছেত্রী থাকলেও তিনি বলে পাঞ্চ করার আগেই মনবীর হেড করে তা গোলে ঢুকিয়ে দেন (২-০)। এই গোলের সময় মনবীরকে তিন-তিনজন ডিফেন্ডার বাধা দিতে এসেও ব্যর্থ হন। ম্যাচের প্রথম আধ ঘণ্টায় মহমেডান এসসি একটিও শট নেওয়ার সুযোগ পায়নি। বেশিরভাগ খেলাই হয় তাদের গোল এরিয়ায়। মোহনবাগানের তিনটি শটের মধ্যে দু’টি ছিল লক্ষ্যে, যেগুলি থেকে গোল পায় তারা।

আট মিনিটের মধ্য দু’গোল খাওয়ার পর মহমেডান পাল্টা আক্রমণে ওঠার চেষ্টা শুরু করে। মির্জালল কাসিমভ, ফ্রাঙ্কা, অ্যালেক্সি গোমেজরা আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করলেও তাতে যেমন তীব্রতা ছিল না, তেমনই পরিকল্পনার অভাব ছিল চোখে পড়ার মতো।

এমনিতেই তাদের রক্ষণে দুর্বলতা আছে। এই ম্যাচে সেই দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে মোহনবাগানের আক্রমণের সামনে পড়ে। ৪৩ মিনিটের মাথায় ফের গোল পান শুভাশিস। রীতিমতো পরিকল্পিত আক্রমণে গোলটি করে মোহনবাগান। বাঁ দিকের উইং থেকে কামিংস বল হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন বক্সে থাকা ম্যাকলারেনের উদ্দেশে। ডানপায়ের আউটস্টেপ দিয়ে তা পিছন দিকে গোললাইনের সামনে থাকা শুভাশিসের উদ্দেশে ফ্লিক করেন ম্যাকলারেন এবং গোলের দিকে ৪৫ ডিগ্রি ঘুরে বল জালে জড়িয়ে দেন বাগান অধিনায়ক (৩-০)। চলতি লিগে এই নিয়ে আধ ডজন গোল করে ফেললেন বঙ্গ তারকা।

মহমেডান তাদের প্রথম সুবর্ণ সুযোগটি পায় প্রথমার্ধের সংযুক্ত সময়ে, যখন কাসিমভের ক্রসে হেড করে গোলের দিকে বল পাঠান মনবীর সাইনি। কিন্তু অসাধারণ সেভ করেন বিশাল। কিন্তু এর পরেই যা ঘটে, তা অপ্রত্যাশিত। টম অলড্রেডকে অবৈধ ভাবে আক্রমণ করে বসেন কাসিমভ, যার জেরে তাঁকে লাল কার্ড দেখাতে বেশি সময় নেননি রেফারি।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বজায় রাখে মোহনবাগান এবং ৪৮ মিনিটের মাথায় কামিংসের বাঁ পায়ে নেওয়া দুর্দান্ত শট সেভ করেন গোলকিপার পদম ছেত্রী। পরবর্তী মিনিটেই কামিংসের কর্নারে আপুইয়া গোলের উদ্দেশে হেড করলেও তা বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। তাঁর একটি দূরপাল্লার শটও বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়।

দশ জনে খেলা মহমেডানের ক্রমশ চাপে থাকা রক্ষণ ফের পরাজিত হয় ৫৩ মিনিটের মাথায়, যখন অসাধারণ হেডে অনবদ্য গোল করেন মনবীর সিং। বক্সের বাঁ দিক থেকে কামিংসের মাপা ক্রস বক্সের মাঝখানে পৌঁছলে অনেকটা লাফিয়ে উঠে গোলের দিকে হেড করেন মনবীর, যার গতিপথ বুঝতেই পারেননি গোলকিপার পদম ছেত্রী (৪-০)। এই নিয়ে চলতি লিগের পঞ্চম গোল করলেন তিনি। এ ছাড়া তিনটি অ্যাসিস্টও রয়েছে তাঁর।

দু’মিনিট পরেই পাঁচ নম্বর গোলটি পেয়ে যেত মোহনবাগান। কামিংসের পাস থেকে গোলে শট নেন লিস্টন কোলাসো। কিন্তু এ বার তা আটকে দেন ছেত্রী। দলের আক্রমণে তাজা ভাব আনতে একসঙ্গে তিন পরিবর্ত খেলোয়াড়কে নামায় মহমেডান। ৬১ মিনিটের মাথায় অ্যালেক্সি গোমেজের থ্রু পেয়ে গোলে শটও নেন মনবীর সাইনি। কিন্তু তা আটকে দেন বিশাল। ৬৫ মিনিটে অ্যাডিসন সিংয়ের গোলমুখী শটও আটকান তিনি। মহমেডানের ফুটবলাররা এ দিন যে ক’টি শট গোলে রাখেন, তার প্রতিটিই অনায়াসে সেভ করেন মোহনবাগান গোলকিপার।

গোলের ব্যবধান বাড়ানোর উদ্দেশে ৬৩ মিনিটে অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে নামান বাগান-কোচ হোসে মোলিনা। মনবীর ও সহালকে একসঙ্গে তুলে নেন তিনি। সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে তাঁকে মাঠে একটু বেশি সময় দেওয়ার জন্যই নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার প্রায় আধ ঘণ্টা আগে নামানো হয়। তিনি নামার পরেই জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন পঞ্চম গোলের করার বা করানোর জন্য। ৭৩ মিনিটর মাথায় বাঁ দিক দিয়ে উঠে কঠিন কোণ থেকে গোলে শট নেন দিমি, যা আটকে দেন ছেত্রী। তাঁর হাত থেকে ছিটকে আসা বলে ফের শট নেন ম্যাকলারেন। এ বারও প্রতিহত করেন ছেত্রী। খেলা তখন পুরোপুরি সবুজ-মেরুন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

পেট্রাটসের মতো গ্রেগ স্টুয়ার্টকেও মাঠে বেশি সময় দেওয়ার জন্য শেষ কোয়ার্টারের শুরুতে কামিংসের জায়গায় তাঁকে নামান মোলিনা। হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য মাঠে নামা পেট্রাটস ৮১ মিনিটের মাথায় যে সুযোগ পান, তাকে সুবর্ণ সুযোগ বললেও কম বলা হবে। ডানদিক থেকে আশিস রাইয়ের ক্রস পেয়ে বক্সের মাঝখান থেকে যে শট নেন তিনি, তা পোস্টে লেগে বাইরে বেরিয়ে যায়। ৮৮ মিনিটের মাথায় দলের পাঁচ নম্বর গোলটি প্রায় করেই ফেলেছিলেন পরিবর্ত আশিক কুরুনিয়ান। কিন্তু তাঁর শট অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়। পাঁচ মিনিটের সংযুক্ত সময়েও আর পঞ্চম গোলের সন্ধান পায়নি তারা।

মহমেডান এসসি দল (৪-৩-৩): পদম ছেত্রী (গোল), জুডিকা, জো জোহেরলিয়ানা, ফ্লোরেন্ট অগিয়ে, সাজাদ পারে (গৌরব বোরা-৫৯), মির্জালল কাসিমভ, অ্যালেক্সি গোমেজ (মার্ক স্মেরবক-৮১), মহম্মদ ইরশাদ (লালরিনফেলা -৫৯), মনবীর সাইনি (অমরজিৎ সিং কিয়াম-৮০), কার্লোস ফ্রাঙ্কা, লালরেমসাঙ্গা ফানাই (অ্যাডিসন সিং-৫৯)।

মোহনবাগান এসজি দল (৪-২-৩-১): বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, টম অলড্রেড, দীপেন্দু বিশ্বাস (সৌরভ ভানওয়ালা-৮৯), শুভাশিস বোস, মনবীর সিং (দিমিত্রিয়স পেট্রাটস-৬২), সহাল আব্দুল সামাদ (অবিষেক সূর্যবংশী-৬২), আপুইয়া, লিস্টন কোলাসো (আশিক কুরুনিয়ান-৮১), জেসন কামিংস (গ্রেগ স্টুয়ার্ট-৮১), জেমি ম্যাকলারেন।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: মহমেডান এসসি ৪৫.৩% - মোহনবাগান এসজি ৫৪.৭%, সফল পাসের হার: ৮২%-৮৭%, গোলে শট: ২-৯, ফাউল: ১৩-৭, ইন্টারসেপশন: ১০-১৮, ক্রস: ১১-২১, কর্নার: ৩-৬, হলুদ কার্ড: ০-৩, লাল কার্ড: ১-০।

ম্যাচের সেরা: জেসন কামিংস (মোহনবাগান এসজি)