দেশের মাঠে বা এই উপমহাদেশে ভারতীয় ফুটবল দলের আন্তর্জাতিক খেতাব জয়ের কাহিনী অনেকবারই লেখা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি তাজিকিস্তানে গিয়ে ভারতের সিনিয়র দল যে সাফল্য অর্জন করে আনল, তেমন সাফল্যের অধ্যায় এ দেশের ফুটবল ইতিহাসে একাধিক দশকে লেখা হয়নি।

দু’বছর আগে, ২০২৩-এ ভারতীয় ফুটবল দলের একাধিক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের খেতাব জয়ের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি এ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। সে বছর কুয়েতের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত।

সে বছরই ফিফা ক্রমতালিকায় একেবারে কাছাকাছি থাকা দল লেবাননকে ভারত তিনবারের মুখোমুখিতে যে ভাবে দু’দু-বার হারায় ও একবার ড্র করে, তার কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। এর পরে কুয়েত। যাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে এক ম্যাচে ড্র করে এবং সাফ ফাইনালে এক গোলে পিছিয়ে থেকেও অবশেষে টাই ব্রেকারে জেতে।

সে বছর ইম্ফলে দাপুটে ফুটবল খেলে ত্রিদেশীয় সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। প্রথমে তারা হারায় মায়ানমারকে ও পরে হারায় কিরগিজস্তানকে। কিন্তু এ সবই ছিল দেশে বা উপমহাদেশে। এত সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও বিদেশে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়।

থাইল্যান্ডে কিংস কাপে ফিফা ক্রমতালিকায় ২৯ ধাপ এগিয়ে থাকা ইরাকের বিরুদ্ধে ৯০ মিনিট দুর্দান্ত লড়াই করে টাই ব্রেকারে হারের পর তৃতীয় স্থান নির্ধারক ম্যাচেও তাদের চেয়ে একধাপ পিছিয়ে থাকা লেবাননের কাছে ০-১-এ হারে ভারত। ফলে থাইল্যান্ড থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয় তাদের।

২২ বছর পর ২০২৩-এর মারডেকা কাপেও অংশ নেয় ভারতের সিনিয়র দল। কুয়ালা লামপুরে ফিফা ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ৩২ ধাপ পিছিয়ে থাকা মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করেও জয়ের হাসি হাসতে পারেনি ভারত। সেমিফাইনালে হেরেই বিদায় নিতে হয় ভারতকে। ৪-২-এ জেতে মালয়েশিয়া।

২০২৩ যতটা ভাল গিয়েছিল ভারতের, ২০২৪ ততটাই খারাপ যায়। সে বছর কোনও সাফল্য পায়নি নীল-বাহিনী। এএফসি এশিয়ান কাপের মূলপর্বে সব ম্যাচে হারার পর কোচ বদলেও কোনও লাভ হয়নি। স্প্যানিশ কোচ মানোলো মার্কেজের অধীনে আটটি ম্যাচ খেলে ভারত, যার মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পায় তারা। চারটি ম্যাচ ড্র হয় ও তিনটিতে হারে।

সম্প্রতি কাফা নেশনস কাপে যে রকম সাফল্য অর্জন করল ভারত, বিদেশের মাটিতে এ রকম কৃতিত্বপূর্ণ সাফল্য বহু বছর পরে এল এ দেশের ফুটবলে। ফিফা ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা দু’টি দলকে হারিয়ে টুর্নামেন্টে আটটি দলের মধ্যে তৃতীয় সেরা দলের খেতাব জিতে নেয় ভারত।

তাজিকিস্তানের হিসোরে সেন্ট্রাল স্টেডিয়ামে টুর্নামেন্টের তৃতীয় স্থান নির্ধারক ম্যাচেওমানকে পেনাল্টি শুট আউটে ৩-২-এ হারায় তারা। নির্ধারিত সময়ে ফল ছিল ১-১। ৩০ মিনিটের অতিরিক্ত সময়েও কোনও গোল হয়নি। ওমান ক্রমতালিকায় ভারতের চেয়ে ৫৪ ধাপ ওপরে থাকা দল। প্রথম ম্যাচে ফিফা ক্রমতালিকায় ২৭ ধাপ ওপরে থাকাতাজিকিস্তানকে ২-১-এ হারিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল খালিদ জামিলের ভারত। পরপর দুটি শক্তিশালী দলকে হারিয়ে এমন সাফল্য অর্জন করা সত্যিই বড় কৃতিত্বের।

বিদেশের মাটিতে ভারতের সেরা সাফল্য এসেছিল ১৯৬২-র এশিয়ান গেমসে। সে বার জাকার্তায় ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১-এ হারিয়ে এশিয়ান গেমসের ফুটবলে দ্বিতীয়বার সোনা জেতে ভারত। তার দু’বছর পর, ১৯৬৪-তে ফের দক্ষিণ কোরিয়াকে হারায় ভারত। এএফসি এশিয়ান কাপের গ্রুপ পর্বে ফের কোরিয়ানদের বিরুদ্ধে ২-০-য় জয় আসে।

সে বছর হংকংকে ৩-১-এ হারিয়ে এশিয়ান কাপের গ্রুপে রানার্স আপ হয় ভারত। এই টুর্নামেন্টে সেটিই ছিল ভারতের সেরা পারফরম্যান্স। এর মধ্যে বহুবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব এসেছে এ দেশে। তবে নিজেদের চেয়েও শক্তিশালী দলকে হারানোর কৃতিত্ব অর্জন ভারত করেছিল খুব কমবারই। যেমন ২০২৩-এর নভেম্বরে কুয়েতে গিয়ে তাদের হারিয়ে এসেছিল ভারত। সে ছিল বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচ।

এ ছাড়াও ১৯৫১-র এশিয়ান গেমস, ২০০৮-এ এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। ১৯৭০-এর এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জয় করে। ১৯৫৯ ও ১৯৬৪-র মারডেকা কাপে রানার্স আপ হয় ও ২০১৯-এর কিংস কাপে তৃতীয় স্থান পায়। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে কাফা নেশনস কাপের এই সাফল্য।

এই টুর্নামেন্টে পূর্ণশক্তির দল নিয়ে আসেনি ভারত। বেশ কয়েকজন নির্ভরযোগ্য তারকাকে ছাড়াই জাতীয় কোচ হিসেবে প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে দল নিয়ে তাজিকিস্তানে পৌঁছন খালিদ জামিল। তবে নির্ভরযোগ্য তারকাদের ছাড়াই সাফল্য অর্জন করে নেন তিনি। ভারত ফাইনালে উঠতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু আটদলীয় টুর্নামেন্টের সেরা চারের মধ্যে থাকা এবং তৃতীয় সেরার খেতাব জিতে নেওয়া, তাও ক্রমতালিকায় অনেক এগিয়ে থাকা দু-দু’টি দলকে হারিয়ে, এই সাফল্য অবশ্যই এ দেশের ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

ওমানের বিরুদ্ধে কখনও জয় পায়নি ভারত। ওমান সাতটিতে জেতে ও তিনটি ম্যাচে ড্র হয়েছিল। এর আগে দুই দলের শেষ সাক্ষাৎ হয় ২০২১-এর মার্চে। সেই ম্যাচটি ১-১ ড্র হয়েছিল। প্রায় সাড়ে চার বছর পর ওমানের মুখোমুখি হয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রথম জয় অর্জন করে নিল ভারতীয় দল।

তবে তাদের আসল ও আরও কঠিন পরীক্ষা এখনও বাকি। আগামী মাসেই সেই পরীক্ষা দিতে হবে খালিদ জামিলের বাহিনীকে। এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে ভারতীয় দল বেশ চাপে রয়েছে। গ্রুপ ‘সি’-তে নিজেদের প্রথম দুটি ম্যাচে বাংলাদেশ ও হংকংয়ের বিরুদ্ধে যথাক্রমে একটি ড্র এবং একটি হারের ফলে তারা পয়েন্ট টেবলের সর্বশেষ স্থানে রয়েছে। এই অবস্থা থেকে দলকে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য এ বার ভারতীয় দলকে প্রস্তুত করতে হবে খালিদকে।

অক্টোবরে ভারত দু’টি ম্যাচ খেলবে বিশ্বের ১৫৯ নম্বর সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে। প্রথমটি হবে ৯ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে ও পরেরটি ১৪ অক্টোবর গোয়ায়। ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের খেলতে হবে সে দেশে গিয়ে এবং আগামী বছর ৩১ মার্চ হংকংয়ের বিরুদ্ধে বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচ খেলবে ভারত। তাজিকিস্তানে সাম্প্রতিক সাফল্য তাদের এই আসন্ন লড়াইয়ের জন্য নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগাবে।