এ বারের হিরো আইএসএল যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবে এসসি ইস্টবেঙ্গল ততই ভাল। কোনও দল যদি সারা লিগে ২০টির মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচ জেতে, তা হলে সেই লিগকে তো কোনও দিক দিয়েই স্মরণীয় বলা সম্ভব নয়। স্বাভাবিক ভাবেই ১১ দলের মধ্যে সর্বশেষ স্থানে থেকে এ বারের লিগ অভিযান শেষ করে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী লাল-হলুদ বাহিনী।

কেন এমন হল, তা যদিও এখন আরও কারও জানতেই বাকি নেই। শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে দল গঠন। প্রাক-মরশুম প্রস্তুতি যথেষ্ট না হওয়া, এ সব কিছু মিলিয়ে এই মরশুম এসসি ইস্টবেঙ্গলের কাছে প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে ওঠে। কোনওকিছুই যখন ঠিকমতো চলছিল না, তখন ক্লাব কর্তৃপক্ষ নতুন মুখ এনে পরিস্থিতি শোধরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এমনই যে, তাতে অবস্থার সামান্য উন্নতি হলেও ফলের ক্ষেত্রে তার কোনও প্রতিফলনই দেখা যায়নি।

সারা লিগে একটি জয়, আটটি ড্র এবং ১১টি হার। এরকম হতাশাজনক ফল ক্লাবের একশো বছরের ফুটবল ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু এত হতাশার মধ্যেও হাল্কা হলেও আশার আলো খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এই হাল্কা আলোয় আলোকিত হয়ে আগামী মরশুমের জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে পারে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। কিন্তু কী ভাবে, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।

মন্দের ভাল কী কী পাওয়া গেল?

এই মরশুমে এসসি ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্সে ভাল কী কী পাওয়া গিয়েছে, তার উত্তর জানার জন্য দূরবিন বা আতস কাচের দরকার হয়তো প্রয়োজন পড়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গিয়েছে কিছু ইতিবাচক দিক। প্রথম লেগে একটিও ম্যাচ তারা জিততে পারেনি এ বার। গতবার যে রকম আট নম্বর ম্যাচে প্রথম জয় পেয়েছিল তারা, এ বার তাও করতে পারেনি। প্রথম লেগে তাদের সাফল্যের ভাঁড়ার ছিল প্রায় শূন্য। সম্বল ছিল হাফ ডজন ড্র, যা থেকে ছ’পয়েন্ট পেয়ে তারা দ্বিতীয় লেগে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

মুম্বই সিটি এফসি, চেন্নাইন এফসি-র মতো দলের বিরুদ্ধে ড্র করে সেই স্বপ্ন বাস্তব করার দিকে কিছুটা এগিয়েছিলও তারা। ১২ নম্বর ম্যাচে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে জয়ও পায় তারা। কিন্তু তার পরে টানা আটটি ম্যাচে ফের ব্যর্থতার অন্ধকার ঘিরে ধরে তাদের। এর মধ্যেও আশার আলো দেখিয়েছেন নাওরেম মহেশ সিং, লালরিনলিয়ানা হনামতে ও সৌরভ দাসের মতো দলের তরুণ ফুটবলাররা। মরশুমের মাঝখানে স্প্যানিশ কোচ মারিও রিভেরা দলের দায়িত্ব নেওয়ায় তাও কিছুটা উন্নত ফুটবলের দিশা পায় লাল-হলুদ ফুটবলাররা। তার আগে পর্যন্ত তাদের পথ ছিল দিশাহীন।

দীর্ঘ নেতিবাচক তালিকা

এ মরশুমের এসসি ইস্টবেঙ্গলের ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলি খুঁজে বার করাটা অনেক সোজা। কারণ, এই তালিকা তৈরি করতে বসলে তা অবধারিত ভাবে বেশ লম্বা হবে। কী ছিল না এই দলটার মধ্যে? আক্রমণে মসৃণতার অভাব, মাঝমাঠে সংগঠনের অভাব, রক্ষণে শক্তির অভাব, যা দলকে কখনওই এক ধাপের বেশি উঠতে দেয়নি। এগারো থেকে একবার দশে গিয়েছিল তারা। কিন্তু তার ওপরে এক দিনের জন্যও উঠতে পারেনি কলকাতার দল। তাই বিপক্ষরা তাদের সামনে পেয়ে ইচ্ছেমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে এবং সাফল্য নিয়েও মাঠ ছেড়েছে।

আক্রমণে যথেষ্ট ধার ছিল না দলটার মধ্যে। নাইজেরিয়া থেকে আসা ড্যানিয়েল চিমা চুকুউ ব্যর্থ হয়ে মরশুমের মাঝপথে দল ছেড়ে চলে যান জামশেদপুর এফসি-তে। অন্য দলে গিয়ে নিজের সেরাটা ফিরে পান চিমা, প্রমাণ করে দেন ভাল কোচ ও ভাল দল পেলে তিনি নিজের সেরাটা দিতে পারেন। এসসি ইস্টবেঙ্গল থেকে বেরনোর পরে এখন পর্যন্ত সাত-সাতটি গোল করেছেন চিমা। তাঁর জায়গায় ব্রাজিল থেকে স্ট্রাইকার মার্সেলো রিবেইরোকে আনলেও তিনি ফিটনেসের সমস্যায় পড়ে যান। তার আগে অবশ্য ছ’টি ম্যাচে নেমে একটিও গোল বা অ্যাসিস্ট করতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত ২০ ম্যাচে মাত্র ১৮টি গোল করে তারা। সবচেয়ে কম গোল করার দিক থেকে তাদের চেয়ে ওপরে শুধু চেন্নাইন এফসি (১৭) রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ক্রোয়েশিয়ান স্ট্রাইকার আন্তোনিও পেরোসেভিচ কিছুটা হলেও উজ্জ্বল ছিলেন। কিন্তু আক্রমণে বেশির ভাগ সময়ই যোগ্য সঙ্গত পাননি। মাধখানে যখন পাঁচ ম্যাচে সাসপেন্ড হয়ে বসে ছিলেন তিনি, তখন দল আরও ব্যর্থতার দিকে ঢলে পড়ে। ওই সময় পেরোসেভিচ থাকলে বোধহয় এতটা খারাপ অবস্থা হত না দলের।

সেটপিসের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাও এসসি ইস্টবেঙ্গলের ব্যর্থতার আর এক কারণ বলা যায়। তবে আক্রমণ বা মাঝমাঠের চেয়ে লাল-হলুদ ডিফেন্স মন্দের ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। তবু সারা লিগে ৩৬টি গোল খেয়েছে তারা। গোলকিপার নিয়েও অনেক সমস্যায় ছিল লাল-হলুদ শিবির। গতবার এটিকে মোহনবাগানের হয়ে খেলে গোল্ডেন গ্লাভ জেতা গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্য এ বার একেবারেই নিজের সেরাটা দিতে পারেননি। হতাশায় অধিনায়কত্বও ছেড়ে দেন এবং শেষ দিকে একাধিক ম্যাচে তাঁকে প্রথম দলে দেখাও যায়নি।

শঙ্কর রায়, শুভম সেনদের কাছে সুযোগ আসে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু তাঁরাও সে ভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। আসলে সামনে ডিফেন্ডাররা যদি নড়বড়ে হন, তা হলে গোলকিপারের ওপর যে চাপ আসে, তা সামলানো বেশ কঠিন। সবচেয়ে বেশি গোল খাওয়ার দিক থেকে শুধু নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি ও ওডিশা এফসি তাদের ওপরে ছিল। দুই দলই ৪৩টি করে গোল খেয়েছে এই মরশুমে।

আগামী মরশুমে যা যা চাই

আগামী মরশুমে পুরো দল ঢেলে না সাজালে তাদের ফের এমনই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। এ বারের মতো তাড়াহুড়ো করে দল গঠন না করে হাতে সময় নিয়ে ফুটবলারদের পরখ করে তার পরই দলগঠন করা উচিত তাদের। সবচেয়ে বড় কথা একজন ভাল কোচও আনা উচিত, যিনি এর আগে হিরো আইএসএলে দল সামেলেছেন। ভারতে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা না থাকলে ও ভারতীয় খেলোয়াড়দের ভাল ভাবে না চিনলে যে কোনও কোচই এখানে সফল হতে পারবেন না, সেই শিক্ষা রবি ফাউলার ও হোসে মানুয়েল দিয়াজকে দেখে পাওয়া উচিত লাল-হলুদ শিবিরের। আন্তোনিও পেরোসেভিচ ও হীরা মন্ডল ছাড়া এই মরশুমে দলের আর অন্য কোনও ফুটবলারই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। তাই আগামী মরশুমে এই দু’জনকে রাখার চেষ্টা করা উচিত। পরের মরশুমে ঘুরে দাঁড়াতে হলে বাকিটা পুরোটাই বদলে ফেলতে হবে তাদের।