সেমিফাইনালের প্রথম লেগে হারের পর এ বার ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার পালা মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের। হাতে মাত্র তিনদিন। কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। 

অসম্ভব নয় বলেই বোধহয় সবুজ-মেরুব শিবিরের হেড কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস মঙ্গলবার ম্যাচের পর সাংবাদিকদের বলে দেন, “কথা দিচ্ছি, পরের ম্যাচে আমাদের দলের অন্য রূপ দেখতে পাবেন, আমরা ফল বদলে দেব”। 

কথাগুলো যত না সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন হাবাস, তার চেয়েও বেশি বোধহয় সমর্থকদের বার্তা দেওয়ার জন্যই বলেছেন তিনি। কারণ, তিনি জানেন, মঙ্গলবার ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে তাঁর দলের যে পারফরম্যান্স দেখা গিয়েছে, তার চেয়ে অনেক ভাল পারফরম্যান্স তারা দেখিয়েছে এর আগে। 

গত ১৫ এপ্রিল যে ম্যাচ জিতে তারা লিগশিল্ড জয় করে, সেই ম্যাচই তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। ঘরের মাঠে সেই ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-র মতো শক্তিশালী ও দাপুটে প্রতিপক্ষকে সব দিক থেকে পিছনে ফেলে দেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, লিস্টন কোলাসো, অনিরুদ্ধ থাপা, শুভাশিস বোসরা। 

সম্ভবত সেই পারফরম্যান্সের কথা মাথায় রেখেই হাবাস মঙ্গলবার রাতে এত বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন,  “সাদিকু বলুন, কাউকো বলুন আমাদের কোনও খেলোয়াড়ই তাদের সেরাটা দিতে পারেনি। যার জেরে এই ফল হয়েছে। পরের ম্যাচে সম্পুর্ণ অন্য মোহনবাগানকে দেখা যাবে। ফলও উল্টো হবে। এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি”।

হাবাসের ধারণা, লিগশিল্ড জয়ের আনন্দ ও তৃপ্তি তাঁর দলের খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে। সেই কারণেই এই ম্যাচে যথেষ্ট উজ্জীবিত হয়ে খেলতে পারেননি পেট্রাটসরা। সেই কারণেই তিন মিনিটের মাথায় গোল করে এগিয়ে গিয়েও তা ধরে রাখতে পারেনি তারা। তা ছাড়া বিপক্ষে রয় কৃষ্ণার মতো একজন ক্ষুধার্ত ফরোয়ার্ড থাকতে তাঁকে আটকানোও মোটেই সোজা নয়। 

আগেও পেরেছেন হাবাস 

সোজা নয়, কিন্তু অসম্ভবও তো নয়। লিগ পর্বে তাদের দ্বিতীয়বারের মুখোমুখিতে এই মোহনবাগানই একটিও গোল করতে দেয়নি ওডিশা এফসি-কে। মোহনবাগানের প্রাক্তনী রয় কৃষ্ণাকে সে দিন একটু পিছন থেকে খেলা শুরু করতে দেখা যায়। ম্যাচের প্রথম আধঘণ্টা তিনি অতর্কিত আক্রমণের চেষ্টায় ছিলেন। তবে তাঁকে আটকানোর দায়িত্বে ছিলেন শুভাশিস। ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার দিয়েগো মরিসিও-ও সুযোগ তৈরিতে বেশি মন দেন। 

চলতি আইএসএলে ওডিশার সবচেয়ে বেশি গোল এসেছে প্রথমার্ধের শেষ ১৫ মিনিটে। এই হোমওয়ার্কটা সম্ভবত আগেই করে রেখেছিল তাদের প্রতিপক্ষ। তাই এই সময়ে রয়দের কড়া পাহাড়ায় রাখেন শুভাশিসরা। মাঝমাঠেই আটক হয়ে যান মরিসিওরা। সে দিন খেলেননি আহমেদ জাহু। মাঝমাঠে তাঁর অভাব টের পায় সের্খিও লোবেরার দল। সে দিন ওডিশা এফসি-কে সারা ম্যাচে মাত্র দুটি শট গোলে রাখতে দেয় মোহনবাগান, নিজেদের চারটি শট ছিল লক্ষ্যে। মঙ্গলবার সেমিফাইনালের প্রথম লেগে সেরকম পারফরম্যান্স দেখাতে পারেনি মোহনবাগান। যদি পারত, মনে হয় না, তাদের জয় কেউ আটকাতে পারত। 

সেমিফাইনালের প্রথম লেগে হারা দল দ্বিতীয় লেগে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, এমন ঘটনা এ এর আগে একাধিকবার ঘটেছে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে। হাবাসের প্রশিক্ষণাধীন এটিকে-ও সেই কঠিন কাজটা করে দেখিয়েছিল ২০১৯-২০ মরশুমে। অনেকেরই হয়তো মনে নেই, সে বার বেঙ্গালুরুতে গিয়ে ০-১-এ হেরে আসার এক সপ্তাহ পর কলকাতায় ৩-১-এ জিতে ফাইনালে ওঠে এটিকে। ফাইনালে তারা চেন্নাইন এফসি-কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয়। 

এ ছাড়াও আরও দু’বার একই ঘটনা ঘটেছিল ২০১৫-য় এফসি গোয়া প্রথমে দিল্লি ডায়নামোজের কাছে ০-১-এ হেরে দ্বিতীয় লেগে ৩-০-য় জিতে ফাইনালে ওঠে। ২০১৮-১৯-এ বেঙ্গালুরু এফসি অ্যাওয়ে ম্যাচে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের কাছে ১-২-এ হেরে পরের ম্যাচে ৩-০-য় জিতে ফাইনালে ওঠে। তাই এ বারেও এমন ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। 

রবিবার সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে যদি দু’গোলের ব্যবধানে জিততে পারে মোহনবাগান এসজি, তা হলে ফাইনালে উঠতে পারে লিগশিল্ডজয়ীরা। এক গোলের ব্যবধানে জিতলে টাইব্রেকারে খেলার নিষ্পত্তি হবে। তবে ম্যাচ ড্র হলে বা ওডিশা ফের জিতলে তারাই ফাইনালে উঠবে। তাই মোহনবাগানকে এই ম্যাচে জিততেই হবে। 

ঘরে-বাইরের খতিয়ান

ওডিশাকে সবচেয়ে বেশি চিন্তায় রাখতে পারে এ মরশুমে তাদের অ্যাওয়ে ম্যাচের রেকর্ড। এ পর্যন্ত যে ১১টি ম্যাচ তারা বাইরের মাঠে খেলেছে তার মধ্যে মাত্র তিনটিতে জিতেছে তারা। তিনটিতে ড্র করেছে (যার মধ্যে একটি মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ২-২ ড্র)। পাঁচটি অ্যাওয়ে ম্যাচে হেরেছে লোবেরার দল। এই এগারোটি ম্যাচে ১২টি গোল করে ১৪টি গোল খেয়েছে তারা।    

মোহনবগান সুপার জায়ান্ট তাদের ঘরের মাঠে এ পর্যন্ত মাত্র তিনটিতে হেরেছে। যুবভারতীতে এ মরশুমে ছ’টি ম্যাচে জিতেছে তারা ও দুটিতে ড্র করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জয় অবশ্যই তারা পেয়েছে শেষ লিগ ম্যাচে, মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচে। ঘরের মাঠে তারা নর্থইস্টকে ৪-২-এ, জামশেদপুর এফসি-কে ৩-০-য় ও পাঞ্জাব এফসি-কে ৩-১-এ হারায়। অর্থাৎ, ঘরের মাঠে বড় জয়ের নজির আছে সবুজ-মেরুন ব্রিগেডের। নিজেদের মাঠে শিল্ডজয়ীরা ২২ গোল করেছে ও ১৬ গোল খেয়েছে। 

ষাট হাজারের ওপর সমর্থকদের সমর্থন যদি পায় একটা দল, তা হলে তাদের তা উজ্জীবিত করে তোলাই স্বাভাবিক। যদিও সব ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এই ঘরের মাঠেই তো চেন্নাইন এফসি-র কাছে ২-৩-এ হেরেছে তারা। এফসি গোয়ার কাছেও ১-৪-এ হেরেছে তারা। গোয়ার কাছে হারের কারণ ছিল দলের বেশিরভাগ প্রথম সারির খেলোয়াড়দের না পাওয়া এবং চেন্নাইনের কাছে হার ছিল খারাপ পারফরম্যান্স ও সাইডলাইনে হাবাসের হঠাৎ অনুপস্থিতি। 

যুবভারতীতে কারা এগিয়ে? 

রবিবার হাবাস পাবেন না আরান্দো সাদিকুকে, যিনি আটটি গোল করে দলের সাফল্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তাঁর জায়গায় নিশ্চয়ই জেসন কামিংসকে শুরু থেকে নামাবেন। মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে যে কম্বিনেশন নামিয়েছিল মোহনবাগান, সেই কম্বিনেশনে শুধু সাদিকুর জায়গায় কামিংস থাকতে পারেন। বাকি দলটা যদি অপরিবর্তিত থাকে, যদি দুই উইংয়ে লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিং নিজেদের সেরাটা দিতে পারেন এবং দিমি-জেসন জুটিকে ঠিকমতো গোলের বল সাপ্লাই করতে পারেন এবং তাঁরা যদি ঠিকমতো সুযোগগুলি কাজে লাগাতে পারেন, তা হলে মোহনবাগানকে আটকে রাখা কঠিন। 

ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ালেও সেখানে দুই সেরা গোলকিপার বিশাল কয়েথ ও অমরিন্দর সিংয়ের সমানে সমানে টক্কর দেখা যাবে। সে দিক থেকে অমরিন্দরের চেয়ে এগিয়েই রয়েছেন বিশাল। কারণ, আইএসএলে এখন পর্যন্ত কোনও টাই ব্রেকারের পরীক্ষায় বসতে হয়নি অমরিন্দরকে। কিন্তু বিশাল দু-দু’বার এই পরীক্ষায় বসেছেন এবং দু’বারই সফল হয়েছেন। গত মরশুমেই প্লে-অফে এই দু’বার পেনাল্টি শুট আউটের মোকাবিলা করেন মোহনবাগান গোল রক্ষক। মোট দশটি শটের মধ্যে আটকান দু’টি ও ছ’টিতে পরাস্ত হন। বাকি দু’টি শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। 

লোবেরার পাঁচতারা অস্ত্র

রয় কৃষ্ণা, দিয়েগো মরিসিও ও আহমেদ জাহুদের মাঝমাঠেই আটকে রাখার কৌশল নিয়ে মাঠে নামতে হবে মোহনবাগানকে। ঘনঘন আগ্রাসী আক্রমণে প্রতিপক্ষকে যদি তারা কোণঠাসা করে দিতে পারে, তা হলেই তা সম্ভব। এমনিতেই রয় কৃষ্ণার বিচরণ সর্বত্র। গত ম্যাচেই রক্ষণ থেকে আক্রমণ সর্বত্র দেখা গিয়েছে তাঁকে। জাহুও একই ভাবে সারা মাঠ জুড়ে খেলার চেষ্টা করেন এবং বিপজ্জনক গোলের পাস বাড়ানোর ব্যাপারে তিনি বিশেষজ্ঞ। সেট পিসেও তিনি যথেষ্ট বিপজ্জনক। 

এই তিন বিদেশী তারকা ছাড়াও ওডিশার দুই উত্তর-পূর্ব ভারতীয় তরুণ ইশাক রালতে ও জেরি মাওমিঙথাঙ্গার ক্ষিপ্র আক্রমণও সামলাতে হবে শুভাশিসদের। লোবেরার হাতে থাকা এঁরা একেকটি ধারালো অস্ত্র, যা দিয়ে তিনি প্রায়ই প্রতিপক্ষ বধ করেন। এই অস্ত্রগুলো ভোঁতা করে দেওয়াই হবে হাবাস ও তাঁর দলের ছেলেদের কাজ। অবশ্যই নিজেদের আক্রমণের ধার বজায় রেখে। 

আইএসএলের ইতিহাস বলছে দশবারের মধ্যে মাত্র দু’বার একই দল লিগ ও নক আউটে সেরার শিরোপা অর্জন করেছে। ২০২০-২১-এ মুম্বই সিটি এফসি ও ২০১৮-১৯-এ বেঙ্গালুরু এফসি। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে তাদের পাশে নাম লেখাতে হলে রবিবাসরীয় যুবভারতীতে বড়সড় অঘটন ঘটাতে হবে এবং তাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স যে রকম এবং হাবাসের হাতে যে তাসসগুলি আছে, তাতে এই সম্ভাবনা বোধহয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না।