যে মরশুম থেকে হিরো আইএসএলে খেলা শুরু করেছে ইস্টবেঙ্গল, সেই মরশুম থেকেই তারা ফর্মের অভাবে ভুগছে। অভিষেক মরশুমে তারা ছিল লিগ টেবলের নয় নম্বরে। গত মরশুমে তারা ছিল সর্বশেষ স্থানে, ১১-য় এবং এ বার ফের সেই নয়ে। এখন পর্যন্ত এর ওপরে উঠতে পারেনি তারা। 

একশো বছরের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি একসময় ভারতীয় ফুটবলে দাপিয়ে বেড়াত। দেশের বাইরে থেকেও সন্মান অর্জন করে এনেছে তারা। সেই ক্লাবের এ হেন বেহাল দশা দেখে সমর্থকেরা তো হতাশ হবেই। সারা দেশে, এমনকী বিশ্বেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমর্থকেরা তাই ক্লাবের এই টানা ব্যর্থতা মোটেই মেনে নিতে পারছেন না।

পারফরম্যান্সে উন্নতি...

তবে এ বারের পারফরম্যান্স থেকে একটাই আশার আলো দেখেছেন তাঁরা। আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে লাল-হলুদ ব্রিগেডের পারফরম্যান্স। গতবার সারা লিগে তারা একটিমাত্র ম্যাচ জিতেছিল। এ বার ছ’টি ম্যাচ জেতে, যা গত দুই মরশুমে মোট জয়ের চেয়েও বেশি।

আরও খুশির খবর হল, এ বার তারা বেঙ্গালুরু এফসি-কে দুই মুখোমুখিতেই হারিয়েছে, লিগশিল্ডজয়ী মুম্বই সিটি এফসি-কে তাদের মাঠে গিয়ে হারিয়ে এসেছে এবং ঘরের মাঠে কেরালা ব্লাস্টার্সের মতো দলের বিরুদ্ধেও জিতেছে। এই পারফম্যান্সকে আর যাই হোক, মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

...কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাব 

তাদের প্রধান সমস্যা ধারাবাহিকতার অভাব। এমন একাধিক ম্যাচ তারা খেলেছে, যাতে নিজেদের ছোটখাটো ভুলে জয়ের কাছাকাছি গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে তাদের। জেতার জায়গায় থেকেও মোট ১১ পয়েন্ট খুইয়েছে তারা। প্রথম ম্যাচে কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ৭২ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য রাখার পর ১-৩-এ হারে ইস্টবেঙ্গল। ঘরের মাঠে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে একেবারে শেষে চার মিনিটের স্টপেজ টাইমে এডু বেদিয়ার জয়সূচক গোলে ১-২-এ হারতে হয় তাদের। গুয়াহাটিতে অন্য রূপে দেখা যায় লাল-হলুদ বাহিনীকে। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের ওপর কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ৩-১-এ হারায় তারা।

কিন্তু কলকাতা ডার্বি ও চেন্নাইন এফসি-র কাছে পরপর দুই ম্যাচে হার তাদের সেই উন্নতিতে রাশ টেনে দেয়। এই দুই ম্যাচের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে মাঠে নেমে বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে একেবারে অন্য ইস্টবেঙ্গলকে দেখা যায়। শুরু থেকেই আগ্রাসী ফুটবল খেলেন ক্লেটন সিলভা, নাওরেম মহেশ, চ্যারিস কিরিয়াকু, সেম্বয় হাওকিপরা।

কিন্তু তার পরেই ওডিশার কাছে ২-৪-এর অভাবনীয় হারে যে তিমিরে ছিল তারা, সেই তিমিরেই রয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। সে দিন বিরতিতে দু’গোলে এগিয়ে থেকেও দ্বিতীয়ার্ধে চার গোল খেয়ে ম্যাচ হারে তারা। জামশেদপুর এফসি-কে ৩-১-এ হারিয়ে সেই খাদ থেকে উঠে আসে ইস্টবেঙ্গল। সে দিন দাপুটে পারফরম্যান্স দেখা গিয়েছিল তাদের। কিন্তু হায়দরাবাদ এফসি ও মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে পরপর দুই ম্যাচে পাঁচ গোল খেয়ে হারের ফলে আবার যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে যায় তারা।

দ্বিতীয় লেগ তারা শুরু করে বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে জয় দিয়ে। তখনও তারা সেরা ছয়ে থাকার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় টানা চারটি ম্যাচে হারের ধাক্কায়। এই চারটি ম্যাচে ১১টি গোল খায় তারা দেয় মাত্র চারটি। শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে দুটি বড় জয় পায় লাল-হলুদ বাহিনী। হারায় সেমিফাইনালিস্ট ব্লাস্টার্স ও লিগশিল্ড মুম্বই সিটি এফসি-কে। কিন্তু বাকি ম্যাচগুলিতে ব্যর্থতা তাদের আর ন’নম্বরের ওপর উঠতে দেয়নি।

ভবিষ্যতের আশা

ব্রিটিশ কোচ স্টিফেন কনস্টান্টাইন শুরুর দিকে সেরা ছয়ে থাকার সম্ভাবনার কথা বললেও পরে যখন বুঝতে পারেন তাঁর দলের পক্ষে তা সম্ভব নয়, তখন বলে দেন, “একমাত্র একটা ম্যাচেই প্রতিপক্ষ আমাদের উড়িয়ে দিয়েছিল, যখন কলকতায় গিয়েছিল মুম্বই। বাকি সব ম্যাচেই আমরা লড়াই করেছি। কিন্তু প্রচুর ভুলের জন্য সাফল্য পাইনি। আমার দলের ছেলেরা হয়তো এই লিগে সেরা নয়। কিন্তু ওরা যে ভাবে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে, তা প্রশংসার যোগ্য”।

দলের ভবিষ্যতের কথাও তাঁর মাথায় ছিল তখন। বলেছিলেন, “আমার কাজ হল এই ক্লাবটাকে আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া, যেখানে তারা বেশ কয়েক বছর আগে ছিল। আমি যেটা করি, তার সঙ্গে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলি। এখন আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ইস্টবেঙ্গলকে সেরা ছয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সেটা আমি করেও দেখাব। এ রকম কঠিন সময়ে ক্লাবের কর্তারা, দলের স্টাফ ও খেলোয়াড়দের সাহায্য না পেলে খুব সমস্যা হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সবাই আমার পাশে আছে”। কিন্তু সেই সুযোগ তাঁকে না দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্লাব। সরকারি ভাবে ক্লাব জানিয়ে দিয়েছে, আগামী মরসুমে কোচ থাকছেন না কনস্টান্টাইন।

সেরা তারকা

ক্লেটন সিলভা, স্ট্রাইকার

দলের আক্রমণের দায়িত্ব প্রায় একার কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন বেঙ্গালুরু এফসি থেকে আসা এই ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার। দলের ২২টি গোলের মধ্যে ১৩টিতেই তাঁর অবদান ছিল। ১২টি নিজেই করেন ও একটিতে অ্যাসিস্ট করেন। কিন্তু যোগ্য সঙ্গতের অভাবে আরও অনেক গোল করতে পারেননি তিনি। সুযোগও নষ্ট করেছেন প্রচুর। তবুও গোল্ডেন বুটের দৌড়ে পুরোপুরি ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তাঁরই স্বদেশীয় দিয়েগো মরিসিও গোল্ডেন বুট জিতে নেন ঠিকই, কিন্তু দুজনেরই গোলসংখ্যা সমান। শুরুর দিকে নাওরেম মহেশ সিং তাঁকে একাধিক দুর্দান্ত গোলের পাস বাড়ালেও পরের দিকে মহেশ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারায় এই জুটির কার্যকারিতা কমে যায়।  লিগের শেষ দিকে ব্রিটিশ ফরোয়ার্ড জেক জার্ভিস দলে যোগ দেওয়ায় অবশ্য ক্লেটন একজন যোগ্য সঙ্গী পান। কিন্তু তখন তারা সেরা ছয়ের দৌড় থেকেও ছিটকে যাওয়ায় মোটিভেশন বলে আরা তেমন কিছুই ছিল না। দল ভাল না খেললেও ক্লেটনের স্মরণীয় গোলগুলিই লাল-হলুদ সমর্থকদের মুখে ক্ষণিকের হাসি ফুটিয়েছে।

সেরা উঠতি তারকা

নাওরেম মহেশ সিং

হিরো আইএসএলে তাঁর দল তেমন ভাল কিছু করতে না পারলেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান মহেশ। মোট ১৯টি ম্যাচে তিনি দুটি গোল করেন ও সাতটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন। একই ম্যাচে তিনটি অ্যাসিস্টের রেকর্ডও আছে তাঁর, যা আর কোনও ভারতীয় ফুটবলারের নেই। ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট করেছেন তিনিই। মহেশের কনভারশন রেটও ছিল উল্লেখযোগ্য, ১৩ শতাংশ। ইস্টবেঙ্গলের কোচ স্টিফেন কনস্টান্টাইন একাধিকবার মহেশের প্রশংসা করেন। ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভা ও মহেশের জুটিই লাল-হলুদ শিবিরকে অধিকাংশ গোল এনে দেন। দলের ২২টি গোলের মধ্যে ১৩টিতে ক্লেটনের ও ন’টিতে মহেশের অবদান ছিল। লিগের পরে মহেশ ভারতীয় দলেও ডাক পান। চলতি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে মায়নমারের বিরুদ্ধে ম্যাচে ৭১ মিনিটের মাথায় মহেশকে একসঙ্গে নামান ভারতের কোচ ইগর স্টিমাচ। ম্যাচের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “মহেশ আমাকে অবাক করে দিয়েছে। আইএসএলে ওর দক্ষতার প্রমাণ আমি পেয়েছি। কিন্তু আইএসএল থেকে যখন ফুটবলাররা ভারতীয় দলে আসে, তখন চাপটা অন্য রকমের হয়। আজ ও অসাধারণ খেলেছে। যতটুকু খেলেছে, একেবারে নিখুঁত খেলেছে”। এ বার হয়তো তাঁকে নিয়মিত জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেখা যাবে।

আগামী মরশুমে যা প্রয়োজন

হিরো আইএসএলে তাদের অভিষেক মরশুম থেকেই ধারাবাহিকতার অভাবে ভুগছে ইস্টবেঙ্গল এফসি। এ বারই প্রথম দলের মধ্যে উন্নতি দেখা গিয়েছে। এই উন্নতি ধরে রাখতে লালচুঙনুঙ্গা, মহেশ, কমলজিৎ সিং, সার্থক গলুই, মোবাশির রহমান, ভিপি সুহেরদের দলে রেখে দেওয়া উচিত। তাঁদের সঙ্গে একাধিক মরশুমের চুক্তিও রয়েছে ক্লাবের। দলের ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার ক্লেটন সিলভার সঙ্গে চুক্তি বাড়ানোর ঘোষণা করেই দিয়েছে তারা। এই খেলোয়াড়দের রেখে যদি আরও কিছু ভাল ফুটবলার আনতে পারে ইস্টবেঙ্গল, সঙ্গে হিরো আইএসএলে কাজ করে যাওয়া একজন কোচ, তা হলে এই দলটাই আগামী মরশুমে ভাল খেলতে পারে। দরকার একজন সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারও। একটা নতুন দল তৈরির জন্য অন্তত চার-পাঁচ মাসের প্রস্তুতি প্রয়োজন। তাও তাদের শুরু করে দিতে হবে মে-জুন থেকেই। দলটাকে তার আগেই গুছিয়ে নেওয়া দরকার। সেই প্রস্তুতি অবশ্য শুরু করে দিয়েছে দল।