গত হিরো আইএসএল মরশুমে লিগ শিল্ডজয়ী মুম্বই সিটি এফসি লিগপর্বে কতগুলি গোল করেছিল, তা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। যাদের মনে নেই, তাদের জন্য এই তথ্য। মুম্বই সিটি এফসি ৫৪টি গোল করেছিল। কলকাতার দুই দল মিলেও লিগ পর্বে অত গোল করতে পারেনি। এটিকে মোহনবাগান করেছিল ২৪টি গোল ও ইস্টবেঙ্গল এফসি ২২টি।

সবচেয়ে কম গোল করা ক্লাবের তালিকায় এটিকে মোহনবাগান ছিল নর্থইস্ট ইউনাইটেড (২০), জামশেদপুর এফসি (২১) ও ইস্টবেঙ্গল এফসি-র পরেই। এত কম গোল করা সত্ত্বেও সবাইকে অবাক করে দিয়ে এটিকে মোহনবাগান ফাইনালে ওঠে এবং চ্যাম্পিয়নও হয়। অর্থাৎ, গোলই যে ফুটবলের শেষ কথা, এ কথা যারা বলে, তারা বোধহয় এ বার থেকে কিছুটা হলেও সংযত হবেন।

কিন্তু প্রশ্নটা তো রয়েই গেল। কী করে এটিকে মোহনবাগান এত কম গোল করেও ফাইনালে পৌঁছল? কারণ, তারা যেমন বেশি গোল করতে পারেনি, তেমন বেশি গোল হজমও করেনি। এই জায়গাতেই ভারসাম্য বজায় রেখে তারা ক্রমশ ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে নক আউটের খেতাবও জিতে নেয়। লিগ পর্বে সবচেয়ে কম গোল খাওয়ার দিক থেকে তারা ছিল দু’নম্বরে, হায়দরাবাদ এফসি-র পরেই। হায়দরাবাদ যেখানে মাত্র ১৬টি গোল হজম করে, এটিকে মোহনবাগান খায় ১৭টি। স্বাভাবিক ভাবেই ক্লিন শিটের দিক থেকে সবুজ-মেরুন গোলকিপার বিশাল কয়েথই ছিলেন সবার ওপরে। এক ডজন ম্যাচে কোনও গোল না খেয়ে সেরা গোলকিপারের খেতাব গোল্ডেন গ্লাভ জিতে নেন তিনি।

অবাক করার মতো বিষয় হল, নক আউট পর্বেও এটিকে মোহনবাগানের গোলখরা অব্যহত ছিল। নক আউটের প্রথম ম্যাচে তারা ওডিশাকে ২-০-য় হারানোর পরে সেমিফাইনালের দুই লেগে নির্ধারিত সময়ে কোনও গোলই করতে পারেনি। পেনাল্টি শুট আউটে জিতে ফাইনালে ওঠে তারা। ফাইনালে অবশ্য দুটি গোল করে তারা। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে লিগ ও নক আউট মিলিয়ে মোট ২৮টি গোল করে তারা।

ইস্টবেঙ্গল নক আউট পর্বে না ওঠায় ২২ গোল নিয়েই শেষ করে। তবে হজম করে ৩৮ গোল। -১৬ গোল পার্থক্য নিয়ে তো আর নক আউট পর্বে ওঠা যায় না। তাই কোচ স্টিফেন কনস্টান্টাইন বুঝেই গিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে নক আউটের রাস্তায় থাকা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।

কলকাতার দুই ক্লাবের এই গোলখরা যে তাদের সমর্থকেরা মোটেই ভাল ভাবে নেননি, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই গত মরশুম চলাকালীন দুই ক্লাবেই বারবার উঠেছে ভাল স্ট্রাইকার নিয়ে আসার দাবি। ইস্টবেঙ্গল সেই দাবি মেনে নিলেও এটিকে মোহনবাগানের কোচ হুয়ান ফেরান্দো সমর্থকদের ইচ্ছাপূরণ করেননি। তিনি শুধুমাত্র অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের ওপরই ভরসা করে ছিলেন। সেই পেট্রাটসই অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁর মান রাখেন এবং ফাইনালে প্রথমে গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়ে শেষে তিনিই ফের গোল করে হার বাঁচান। দুটি গোলই অবশ্য আসে পেনাল্টি থেকে।

গত মরশুমেই প্রথম ভারতে খেলতে আসেন পেট্রাটস। এখানে এসে এখানকার আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সফল হওয়া মোটেই সোজা কাজ নয়। তার ওপর তিনি ভারতে আসার আগে অস্ট্রেলিয়ায় বরাবরই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলে এসেছেন। নিজে গোল করার চেয়ে গোল তৈরি করে দেওয়াটাই ছিল পেট্রাটসের কাজ। সেই ভূমিকা বদলে এ বার গোল করার প্রধান দায়িত্ব নেওয়াটা ছিল বেশ কঠিন কাজ। তবু তিনি সফল হয়েছেন এবং কোচের প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু আরও সফল হতে পারতেন, যদি আরও একজন খেলোয়াড়কে পাশে পেতেন প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করার জন্য। তাঁর সাহায্য পেলে পেট্রাটস তথা এটিকে মোহনবাগানের গোলসংখ্যা এত খারাপ হত না বোধহয়। সারা মরশুমে মোট ১২টি গোল করেছেন তিনি। হিরো আইএসএলে সাতটি গোলে প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্যও করেছেন। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে কোচির গমগমে মাঠে নেমে হ্যাটট্রিক করেছেন। ওডিশা এফসির বিরুদ্ধে জোড়া গোল করে দলকে ম্যাচ জিতিয়েছ্ন। তবু যেন বারবার মনে হয়েছে আরও গোল দরকার আরও নিশ্চয়তা প্রয়োজন।

এটিকে মোহনবাগানের যেমন পেট্রাটস, ইস্টবেঙ্গলের তেমন ক্লেটন সিলভা, যিনি পেলের দেশ ব্রাজিল থেকে এসে ভারত মাতিয়ে দিয়েছেন, যেমন অতীতে দেখা গিয়েছে হোসে ব্যারেটোর ক্ষেত্রেও। গতবছর বেঙ্গালুরু এফসি থেকে যখন ইস্টবেঙ্গল এফসি-তে আসেন ক্লেটন, তখন অনেকে বলেছিল, ফুটবল জীবনের শেষ লগ্নে এসে পৌঁছে গিয়েছেন বলেই লাল-হলুদ শিবিরে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু মরশুমের শেষে দেখা যায়, ব্যাপারটা আসলে সম্পুর্ণ উল্টো।

ইস্টবেঙ্গল ভাল খেলতে না পারলেও ক্লেটনের বিজয়রথ থামেনি। একটি-দুটি ম্যাচ অন্তরই গোল করেছেন তিনি। ১২টি গোল করে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতার দৌড়ে। কিন্তু ক্লাব নক আউটে না ওঠায় আর গোলের সুযোগই পাননি তিনি। পেলে হয়তো সেরার খেতাবটা জিতেই নিতেন।  

আসলে কলকাতার দুই ক্লাবের দুই সেরা গোলদাতার সমস্যা ছিল প্রায় একই। তাঁরা সারা মরশুমেই যোগ্য সঙ্গত পাননি। পেলে আরও গোল করতেন। মরশুমের শুরুর দিকে নাওরেম মহেশ সিং ক্লেটনকে একাধিক দুর্দান্ত গোলের পাস বাড়ালেও পরের দিকে মহেশ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারায় এই জুটির কার্যকারিতা কমে যায়। 

লিগের শেষ দিকে ব্রিটিশ ফরোয়ার্ড জেক জার্ভিস দলে যোগ দেওয়ায় অবশ্য ক্লেটন একজন যোগ্য সঙ্গী পান। কিন্তু তখন তারা সেরা ছয়ের দৌড় থেকেও ছিটকে যাওয়ায় মোটিভেশন বলে আরা তেমন কিছুই ছিল না। দল ভাল না খেললেও ক্লেটনের স্মরণীয় গোলগুলিই লাল-হলুদ সমর্থকদের মুখে ক্ষণিকের হাসি ফুটিয়েছে।

পেট্রাটসও হুগো বুমৌসের সাহায্য পেয়েছেন। তবে নিয়মিত নয়। চোটের জন্য ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি ফরাসি তারকা। সারা মরশুমে দলের ২৮টি গোলে অবদান রাখেন দলের আক্রমণ বিভাগের দুই প্রধান স্তম্ভ পেট্রাটস ও বুমৌস। তাঁরা ১৭টি গোল করেন ও ১১টি করান। মোট ন’টি ম্যাচে কোনও গোলই করতে পারেনি এটিকে মোহনবাগান। আসলে ২০২১-২২ মরশুমে সফল হওয়া লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংদের ব্যর্থতা দলের গোলসংখ্যা কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ। আশিক কুরুনিয়ান, কিয়ান নাসিরি, ফেদরিকো গায়েগোরাও গোল করতে পারেননি।

 এ বার তাই দুই দলকেই তাদের দুই প্রধান গোল স্কোরারের সঙ্গী আনতে হবে। যোগ্য সঙ্গত পেলে পেট্রাটস ও ক্লেটন – দুজনেই আরও ভাল খেলবে। দুই তারকাকে গোলের পাস বাড়ানোর লোক না থাকলে তাদের পক্ষে সফল হওয়া কঠিন। সারা বিশ্বেই এই নিয়ম। যারা নিয়মিত গোল করে, তাদের গোলের বল সাপ্লাই দেওয়ার জন্য লোক থাকে। এই বোঝাপড়াটা ভাল হলে গোলের সংখ্যাও বাড়ে। যেমন পেট্রাটস ও বুমৌসের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। গড়ে উঠেছিল ক্লেটন ও মহেশের মধ্যেও।

মুম্বই সিটি এফসি-র দিকে তাকালে দেখতে পাবেন সেই দলে ছিলেন এক ঝাঁক গোলস্কোরার। জর্জ পেরেইরা দিয়াজ একাই ১১টি গোল করেন। লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে দশটি গোল করেন। গ্রেগ স্টুয়ার্ট, বিপিন সিংরা সাতটি করে গোল করেন। আলবার্তো নগুয়েরা চারটি গোল করেন।

সেখানে এটিকে মোহনবাগানে পেট্রাটস যেখানে ১২টি গোল করেন, সেখানে বুমৌস পাঁচটি, কার্ল ম্যাকহিউ তিনটি এবং জনি কাউকো ও মনবীর সিং দুটি করে গোল করেন। কোলাসো একটির বেশি গোল করতে পারেননি। ইস্টবেঙ্গলের ২২টি গোলের মধ্যে ক্লেটন একাই করেন ১২টি। ভিপি সুহের, মহেশরা সেখানে দুটির বেশি গোল করতেই পারেননি।

এটিকে মোহনবাগান কম গোল করলেও সুযোগ তৈরি করার দিক থেকে তারা কিন্তু তালিকার ওপরের দিকেই ছিল। সবচেয়ে বেশি সুযোগ যেখানে তৈরি করেছে মুম্বই সিটি এফসি, ২৬৩টি। সেখানে এটিকে মোহনবাগান তাদের চেয়ে মাত্র তিনটি কম সুযোগ পায়, যায় অনেকে ভাবতেই পারবেন না। পেট্রাটস একাই ৬১টি সুযোগ তৈরি করেছেন। বুমৌস পেয়েছেন ৪৮টি সুযোগ। মনবীর ২৫টি, কোলাসো ১৮টি, আশিস রাই ১৭টি। অথচ গোলের সংখ্যা মাত্র ২৮। হিসেব করলে দেখা যাবে ২৩২টি গোলের সুযোগ তারা নষ্ট করেছে। তাই আগামী মরশুমে একজন ভাল মানের স্ট্রাইকার না আনলে সবুজ-মেরুন শিবির সমস্যায় পড়তে পারে।

ইস্টবেঙ্গল যেমন কম গোল করেছে, সবচেয়ে কম সুযোগও তৈরি করেছে তারা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ক্লেটন যেখানে ২০টি সুযোগ পেয়ে ১২টি গোল পেয়েছেন, মহেশ সেখানে ২৭টি গোলের সুযোগ তৈরি করে গোল পেয়েছেন মাত্র দুটি। এই তথ্য মাথায় রেখেই আগামী মরসুমের জন্য দল গড়তে হবে লাল-হলুদ শিবিরকে। ফুটবলে সাফল্য পাওয়া অনেক সহজ হয় নিয়মিত গোল পেলে। তাই গোলের খরা কাটাতে গেলে দুই শিবিরকেই আনতে হবে ভাল ও বিশেষজ্ঞ স্ট্রাইকার। এই ব্যাপারে তারা কতটা সফল হতে পারবে, তা জানতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগবে না। চলতি মাসেই যখন ট্রান্সফার উইন্ডো খুলবে, তখনই বোঝা যাবে কারা হতে চলেছে কাদের তুরূপের তাস।