প্রথম লিগের মতো ফিরতি লিগেও এফসি গোয়ার কাছে হেরে গেল ইস্টবেঙ্গল। এ দিন গোয়ার দলের স্প্যানিশ মিডফিল্ডার ইকের গুয়ারৎজেনা ম্যাচের প্রথম ২৩ মিনিটের মধ্যেই হ্যাটট্রিক করে প্রতিপক্ষের সমস্ত আশা শেষ করে দেন। ভারতীয় দলের সদস্য ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ এক বিশ্বমানের ফ্রিকিক থেকে গোল করে দলকে চার গোলে এগিয়ে দেওয়ার পরেও অবশ্য দু’গোল দিয়ে লড়াইয়ে ফেরার চেষ্টা করে কলকাতার দল। শেষ দিকে একাধিক সুযোগও পায় তারা। কিন্তু কোনও সুযোগই কাজে লাগাতে পারেননি নাওরেম মহেশ, ক্লেটন সিলভারা।

ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভা এ দিন খুব একটা তৎপর হতে না পারায় গোটা ইস্টবেঙ্গল দলটাই শুরু থেকে ধুঁকতে থাকে। তিনি যখন স্বাভাবিক ফর্মে ফেরা শুরু করেন, তখন তাদের চার গোল খাওয়া হয়ে গিয়েছে। ভিপি সুহের ও সার্থক গলুই গোল করে দলকে লড়াইয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেও পারেননি।

এই জয়ের ফলে এফসি গোয়া ঢুকে পড়ল প্রথম তিনে। ১৬ ম্যাচে ২৬ পয়েন্ট তাদের। যদিও কেরালা ব্লাস্টার্স দুটি ম্যাচ কম খেলে মাত্র এক পয়েন্ট পিছিয়ে। এটিকে মোহনবাগানও দুটি ম্যাচ কম খেলে দু’পয়েন্ট পিছিয়ে। ফলে কতদিন তারা ওই জায়গায় থাকতে পারবে, সেটাই দেখার। এই হারের ফলে ইস্টবেঙ্গল নয় নম্বরেই রয়ে গেল। ১৫ ম্যাচে এটি তাদের ১১ নম্বর হার। অর্থাৎ, চলতি লিগের নক আউট পর্বের দৌড় থেকে ছিটকে যাওয়ার দোরগোড়ায় চলে এল তারা।    

এ দিন তিনটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামান ইস্টবেঙ্গল এফসি-র কোচ স্টিফেন কনস্টান্টাইন। ইভান গঞ্জালেস, জেরি ও সুমিত পাসি দলে আসেন অ্যালেক্স লিমা, সার্থক গলুই ও মহম্মদ রকিপের জায়গায়। দলকে ৪-৪-২-এই খেলার নির্দেশ দেন লাল-হলুদ কোচ। অন্য দিকে, ইকের গুয়ারৎজেনা, নোয়া সাদাউই ও দেবেন্দ্র মুরুগাঁওকরকে সামনে রেখে ৪-১-২-৩-এ দল সাজান এফসি গোয়ার কোচ কার্লোস পেনা।

গোয়ার এই ছক দেখেই শুরু থেকেই বোঝা গিয়েছিল, তারা আক্রমণাত্মক ফুটবলই খেলেবে। এবং সেটাই হয়। প্রথমার্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এফসি গোয়ারই দাপট ছিল পুরোপুরি। ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়দের কার্যত খুঁজেই পাওয়া যায়নি। পুরোপুরি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে গোয়ার দল ও অ্যাটাকিং থার্ডে তাদের আগ্রাসন ছিল দেখার মতো। ২৩ মিনিটের মধ্যে গুয়ারৎজেনার হ্যাটট্রিকই এ দিন লাল-হলুদ শিবিরকে ম্যাচের শুরুতেই জয় থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। উইংয়ে নোয়া সাদাউই-র যত প্রশংসা করা যায় ততই কম মনে হতে পারে।

ম্যাচের ১১ মিনিটের মাথায় প্রথম গোল করে দলকে এগিয়ে দেন গুয়ারৎজেনা। অসাধারণ ড্রিবলিংয়ের পর দেবেন্দ্র ডানদিকের উইং দিয়ে বল নিয়ে উঠে কাট ইন করে অসাধারাণ থ্রু পাস দেন বক্সের মধ্যে। সুমিত পাসি ক্লিয়ার করার জন্য এগিয়ে এলেও নোয়া তাঁকে আটকান। বল গোলের দিকে গেলে তাতে শট নিয়ে জালে জড়িয়ে দেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার (১-০)।

প্রথম গোলের দশ মিনিট পরে তিনি ফের গোল করে ব্যবধান বাড়িয়ে নেন। এ বার নোয়ার অ্যাসিস্ট। বাঁ উইং থেকে অসাধারণ ভাবে বক্সের মধ্যে বল বাড়ান নোয়া। ইভান গঞ্জালেসকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া গুয়ারৎজেনা ডাইভ দেন হেড করার জন্য। তাঁর ফ্লিকে দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে বল ঢুকে যায় গোলে (২-০)।

তৃতীয় গোলটি তিনি করেন ২৩ মিনিটের মাথায়, অর্থাৎ দ্বিতীয়টির দু’মিনিট পরেই। এ বারও গোলের নায়ক গুয়ারৎজেনা এবং এত দ্রুত হ্যাটট্রিক সম্ভবত এই লিগে আর কেউ করতে পারেনি। ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজের কর্নার থেকেই আক্রমণটি শুরু হয়। মহম্মদ ফারেস আর্নোৎ হেড করে বল বক্সের সামনের দিকে পাঠান। সেখানে স্যানসন পেরেইরা ফের লাফিয়ে হেড করে বল গোলের সামনে বিপজ্জনক জায়গায় পাঠান। গুয়ারৎজেনা সেই বল চিপ করে দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে গোলে ঢুকিয়ে দেন। সুমিত পাসি চেষ্টা করেও তা আটকাতে পারেননি (৩-০)। এই গোলের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় শীর্ষে উঠে যান।

তিন গোল খেয়ে যাওয়ার পরে আর লড়াইয়ে ফেরার কোনও উপায় থাকে না। ইস্টবেঙ্গলও তা পারেনি। তবু ৩৪ মিনিটের মাথায় জেরি বাঁ দিক দিয়ে উঠে সোজা গোলে শট নেওয়ার চেষ্টা করলেও তা সাইড নেটে গিয়ে লাগে। এ ছাড়া কোনও দুর্রন্ত সুযোগ তৈরি করতে পারেনি লাল-হলুদ শিবির। এই অর্ধের শেষ দিকে কর্নার কিকের সময় গোয়ার গোলকিপার ধীরজ সিং লালচুঙনুঙ্গাকে ধাক্কা দেওয়ায় দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়, যা রেফারি কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই ঘটনার জেরে ভিপি সুহেরকে গুয়ারৎজেনার জার্সি টেনে ধরতেও দেখা যায়।

দ্বিতীয়ার্ধের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নাওরেম মহেশ সিং গোলের সুযোগ তৈরি করেন। মাঝমাঠ থেকে পাসির দেওয়া পাস পেয়ে মহেশ কাট ব্যাক করে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে গোলের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু দেবেন্দ্র মহেশের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে সেই সুযোগ নষ্ট করে দেন।

কিন্তু ম্যাচের ৫৩ মিনিটের মাথায় ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ এ মরশুমে তাঁর দ্বিতীয় গোলটি করে দলের জয় সুনিশ্চিত করে ফেলেন। লালচুঙনুঙ্গার করা ফাউল তাঁকে যে শুধু হলুদ কার্ড দেখতে বাধ্য করল, তাই নয় বক্সের সামনে বিপজ্জনক জায়গা থেকে ফ্রিকিকের সুযোগও করে দেয় প্রতিপক্ষকে। ব্র্যান্ডনের অসাধারণ ও মাপা ফ্রি-কিক দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে সোজা গোলে ঢুকে পড়ে (৪-০)। শক্তি ও পারফেকশনে ভরপুর এই শটে হওয়া এই গোলটি ছিল  বিশ্বমানের।

এই জায়গা থেকে ফিরে আসার কথা ভাবাও ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে এখন কঠিন। কিন্তু সাত মিনিটের মধ্যে তাদের দু-দু’টি গোল তাদের সমর্থকদের ফের আশাবাদী করে তোলে। ৫৯ মিনিটের মাথায় বাঁ উইং থেকে অসাধারণ একটি ক্রস আসে মহেশের পা থেকে। যা হেড করে প্রতিপক্ষের জালে জড়িয়ে দেন ভিপি সুহের (৪-১)। এর সাত মিনিট পরেই আরও একটি গোল শোধ করে ইস্টবেঙ্গল এফসি। এ বার মহেশের কর্নার থেকে গোল করেন সার্থক গলুই (৪-২)।

দ্বিতীয় গোলটি পাওয়ার পরেই ইস্টবেঙ্গল ব্যবধান কমানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে এফসি গোয়ার ডিফেন্ডাররা একেবারেই ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না। ৭৬ মিনিটের মাথায় সার্থকের লম্বা থ্রো থেকে বল পেয়ে বক্সের মধ্যে জায়গা তৈরি করে গোলের উদ্দেশ্যে শট নেন সুহের। কিন্তু তা গোলের বাইরে চলে যায়। নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার চার মিনিট আগে ফের গোলের সুযোগ পান মহেশ। কিন্তু এ বারও ব্যর্থ হন তিনি। ক্লেটন সিলভা তাঁকে প্রায় গোলের বল সাজিয়ে দেন। কিন্তু সাইড নেটে মারেন মহেশ।

স্টপেজ টাইমেও গোলের সুযোগ পান ক্লেটন। এ বার মহেশ বাঁ দিক থেকে ক্রস দেন ক্লেটনকে। তিনি প্রথম পোস্টে বল পেলেও তা থেকে গোল করতে পারেননি। এই অর্ধ সাত মিনিটের বাড়তি সময় পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি লাল-হলুদ ব্রিগেড।       

ইস্টবেঙ্গল দল: কমলজিৎ সিং (গোল), জেরি লালরিনজুয়ালা (তুহীন দাস), ইভান গঞ্জালেস, লালুচুঙনুঙ্গা (সার্থক গলুই), জর্ডন ও’ডোহার্টি , চ্যরিস কিরিয়াকু, মোবাশির রহমান (অতুল উন্নিকৃষ্ণন), ভিপি সুহের, নাওরেম মহেশ সিং, ক্লেটন সিলভা (অধি), সুমিত পাসি।  

পরিসংখ্যানে ম্যাচ         

বল পজেশন: এফসি গোয়া ৫৯% - ইস্টবেঙ্গল এফসি ৪১%, সফল পাস: ৩৯৭/৪৮৪ (৮২%) - ২৩৮/৩৩৫ (৭১%), গোলে শট: ৬-২, ফাউল: ৫-১৩, সেভ: ০-২, ইন্টারসেপশন: ৮-৪, কর্নার: ৫-৭, হলুদ কার্ড: ৩-৪, ম্যাচের হিরো: ইকের গুয়ারৎজেনা।