শুক্রবার সন্ধ্যায় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ম্যাচটা যে লিগ টেবলে থাকা তিন নম্বর ও ন’নম্বর দলের মধ্যে ছিল, তা কোনও অজানা ব্যক্তিকে বলে না দিলে তার পক্ষে বোঝা বেশ কঠিন হত। ঘরের মাঠে এ দিন এতটাই উজ্জীবিত ফুটবল খেলে চাপমুক্ত ও উন্নত ইস্টবেঙ্গল এফসি যে, এক মুহূর্তের জন্যও বোঝা যায়নি তারা লিগ তালিকার নীচের দিকে রয়েছে এবং গতবারের রানার্স আপ কেরালা ব্লাস্টার্স প্লে-অফে খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে।

বার্থডে বয় ক্লেটন সিলভার ৭৭ মিনিটের গোলে ১-০-য় জিতে প্রথম লিগে হারের বদলা নিল লাল-হলুদ বাহিনী। সম্ভবত এটাই এ বারের লিগে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র সেরা পারফরম্যান্স। বছরের প্রথম জয়, ঘরের মাঠে দ্বিতীয় জয় ও টানা চারটি ম্যাচে হারার পরে প্রথম ও দুঃসাহসিক জয় পেল লাল-হলুদ ব্রিগেড। তবে এই জয়ের ফলে লিগ তালিকায় তাদের অবস্থানে পরিবর্তন হল না। বরং তারা এই ম্যাচ জিতে কিছুটা হলেও সুবিধা করে দিল এটিকে মোহনবাগানকে। ছ’নম্বর হারের ফলে তিনেই রয়ে যাওয়া ব্লাস্টার্সের চেয়ে মাত্র এক পয়েন্ট পিছনে থাকা কলকাতার আর এক দল রবিবার জিততে পারলেই ব্লাস্টার্সকে টপকে তিন নম্বরে উঠে যাবে।  

এ দিন একাধিক গোলে জিততে পারত রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলা লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু দুর্ভাগ্য ও ক্ষণিকের ভুল তাদের বারবার ব্যর্থতার অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। ব্লাস্টার্সও এ দিন একাধিক গোলের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে। কিন্তু তাদের ও গোলের মাঝখানে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান লাল-হলুদ বাহিনীর গোলপ্রহরী কমলজিৎ সিং। সারা ম্যাচে তিনটি অবধারিত গোল সেভ করেন কমলজিৎ। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্লাস্টার্সের গোলকিপারও এ দিন তিনটি দুর্দান্ত সেভ করে দলকে আরও বড় ব্যবধানে হারের হাত থেকে বাঁচান।

চারটি পরিবর্তন করে এ দিন প্রথম এগারো নামান ইস্টবেঙ্গল কোচ স্টিফেন কনস্টান্টাইন, যা সাধারণত তিনি করেন না। অ্যালেক্স লিমা, সার্থক গলুই, অঙ্কিত মুখার্জি প্রথম দলে ফেরেন এবং নবনিযুক্ত ব্রিটিশ ফরোয়ার্ড জেক জার্ভিসকে শুরু থেকেই মাঠে দেখা যায় এ দিন। এতগুলো পরিবর্তন বোধহয় অন্যরকম কিছু করে দেখানোর জন্যই এবং সেটাই করে তারা।

প্রতিপক্ষের মতো কেরালা ব্লাস্টার্সও এ দিন ৪-৪-২-তে দল সাজায় দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকোস ও আপোস্তোলোস গিয়ানুকে সামনে রেখে। ইস্টবেঙ্গল এই ম্যাচেই প্রথম দুই বিদেশি ফরোয়ার্ডকে সামনে রেখে খেলা শুরু করে, ক্লেটন সিলভা ও জার্ভিস। সিলভাকে বরাবরের মতোই ছটফটে দেখালেও জার্ভিস প্রথম ম্যাচে মন ভরাতে পারেননি। 

প্রথম দু-এক মিনিট ইস্টবেঙ্গল কিছুটা আক্রমণ প্রবণতা দেখানোর পরে ক্রমশ ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু করে ব্লাস্টার্স। লাল-হলুদ রক্ষণের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই একাধিক আক্রমণ শানায় তারা এবং তাদের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান গোলকিপার কমলজিৎ সিং। সপ্তম মিনিটে রাহুল কেপির গোলমুখী হেড আটকান তিনি। এর দু’মিনিট পরে ফের ফাঁকা গোল সামনে পেয়েও বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেন রাহুল।

অপ্রত্যাশিত ভাবেই ১৫ মিনিটের মাথায় হঠাৎ অঙ্কিত মুখার্জিকে তুলে মহম্মদ রকিপকে নামান লাল-হলুদ কোচ, যে সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি হতে দেখা যায়নি অঙ্কিতকে। তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়নি, চোটের জন্য বসতে হয় তাঁকে। এমনিতেই দুর্বল লাল-হলুদ রক্ষণ এই আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা হলেও আরও নড়বড়ে হয়ে যায়। পরে অবশ্য রকিপ সতীর্থদের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ায় ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্স নিজেদের সামলে নেয়।

কেরালা ব্লাস্টার্স যথেষ্ট সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে দুই উইং ও মাঝখান দিয়ে যে আক্রমণগুলি করে, তার মধ্যে পরিকল্পনার ছাপ ছিল স্পষ্ট। কিন্তু প্রতিপক্ষের গোলের সামনে গিয়ে বারবার খেই হারিয়ে ফেলেন দিমিত্রিয়স, গিয়ানু, রাহুল, আদ্রিয়ান লুনা-রা। লাল-হলুদ রক্ষণ তেমন গোছানো না হলেও কোনওমতে আটকে দেয় তাদের। এ ছাড়াও ছিল কমলজিতের অসাধারণ দক্ষতা। ৩৯ মিনিটের মাথায় আদ্রিয়ান লুনার মাপা কর্নার কিক অলিম্পিক গোল হওয়ার আগেই তা পাঞ্চ করে বের করে দেন লাল-হলুদ গোলকিপার।

ইস্টবেঙ্গল এফসি ৩৩ মিনিটের মাথায় গোলের যে সুযোগটি তৈরি করেছিল, তা ব্লাস্টার্সের রক্ষণ নষ্ট করে না দিলে হয়তো গোল পেয়ে যেতেন জার্ভিস। ডানদিক দিয়ে ওঠা ভিপি সুহের মাটি ঘেঁষা, মাপা ক্রস দেন গোলের সামনে। কিন্তু জার্ভিস বলের নাগাল পাওয়ার আগেই রুইভা হরমিপাম তা নিজেদের গোলের বাইরে দিয়ে ক্লিয়ার করে দেন। এই সময়ে ইস্টবেঙ্গল সাময়িক ভাবে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বাড়ানো শুরু করে। পরপর বেশ  কয়েকটি আক্রমণ করে তারা। কিন্তু কোনওটিতেই সাফল্য পায়নি।

বিরতির চার মিনিট আগে জার্ভিসের হেড থেকে বল পেয়ে ডানদিক দিয়ে বক্সে ঢোকা সুহের বল জালে জড়িয়েও দেন, কিন্তু তার আগেই সহকারী রেফারির পতাকা উঠে যায় তিনি অফসাইডে থাকায়। এর দু’মিনিট পরেই রাহুল ফের গোলের সুযোগ পেয়ে যান। এ বারও দলকে বাঁচান কমলজিৎ।

প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ে ইস্টবেঙ্গল পরপর দু’টি গোলের সুবর্ণ সুযোগ পেলেও দুর্ভাগ্য তাদের সেই সুযোগ নষ্ট করে দেয়। প্রথমবার বক্সের বাঁ দিক থেকে আসা ক্রসে গোলমুখী শট নিতে যাওয়ার আগেই জার্ভিসের পায়ে পা লাগিয়ে তাঁকে ফেলে দেন, যা রেফারির নজর এড়িয়ে না গেলে পেনাল্টি পেত তারা। ফিরতি বলে ক্লেটন সিলভা ফের গোলে শট নিলেও তা গোলকিপার করণজিতের গায়ে লেগে বেরিয়ে যায়। লিমার মাপা কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে গোলের চেষ্টা করেন সুহের। কিন্তু তা দ্বিতীয় পোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

প্রথমার্ধের প্রথম ২৫ মিনিট কেরালা ব্লাস্টার্সের দাপট দেখা গেলেও ইস্টবেঙ্গল শেষ কুড়ি মিনিটে ম্যাচের রাশ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় এবং ভাগ্যের সহায়তা পেলে হয়তো এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যেতে পারত তারা। প্রথমার্ধে দুই দলই দু’টি করে শট গোলে রাখে। দু’পক্ষই তিনটি করে কর্নার আদায় করে নেয় এবং দুই গোলকিপারই জোড়া সেভ করেন।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও ইস্টবেঙ্গলের প্রেসিং ফুটবল ছিল অব্যহত। ৪৭ মিনিটের মাথায় বিপক্ষের ডিফেন্ডারের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে বক্সের মধ্যে ফাঁকা গোল পেয়ে যান ক্লেটন সিলভা। কিন্তু বলে শট নেওয়ার আগেই মহেশের পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে যান তিনি।

এর পাঁচ মিনিট পরেই কমলজিৎ ফের অবধারিত গোল বাঁচান, যা গিয়ানুর খাতায় জমা হত। ডানদিক দিয়ে ওঠা রাহুল মাইনাস করেন ছ’গজের বক্সের সামনে থাকা গিয়ানুকে। তিনি গোলে শট নেন। কিন্তু তা আটকে দেন লাল-হলুদ গোলপ্রহরী।

ক্লেটনের মতো এ দিন জার্ভিসও ফের ফাঁকা গোল পেয়ে যান ৬০ মিনিটের মাথায়। মাঝমাঠ থেকে আসা লং বল পান যখন পান তিনি, তখন ব্লাস্টার্সের অর্ধে এক ডিফেন্ডার ছাড়া আর কেউই ছিলেন না। সামনে শুধু গোলকিপার। বক্সের বাইরে থেকেই গোলে বল ঠেলে দেন তিনি। কিন্তু তার আগেই সহকারী রেফারি পতাকা তুলে দেন। টিভি রিপ্লে দেখে অবশ্য বোঝা যায়নি জার্ভিস সত্যিই অফসাইড ছিলেন কি না। 

এই সময়ে গোল পাওয়ার ও রোখার জন্য মরিয়া ব্লাস্টার্স নামায় ভারতীয় দলের দুই ফুটবলার নিশু কুমার সহাল আব্দুল সামাদকে। তাতেও অবশ্য দমে যায়নি ইস্টবেঙ্গল। ব্লাস্টার্সের হাইলাইন ফুটবলের সুযোগ নিয়ে একাধিকবার কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠে তারা। আক্রমণে ধার বাড়ানোর জন্য ৭৬ মিনিটের মাথায় জর্ডন ও’ডোহার্টি ও সুমিত পাসিকে নামান কনস্টান্টাইন। তুলে নেন জার্ভিস ও সুহেরকে।

এই জোড়া পরিবর্তনের পরেই ঘরের মাঠে দ্বিতীয় জয়ের দিকে এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। ৭৭ মিনিটের মাথায় বাঁদিক দিয়ে বল নিয়ে উঠে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েন নাওরেম মহেশ সিং এবং কার্যত জন্মদিনের উপহার হিসেবে থালায় গোল সাজিয়ে দেন ক্লেটন সিলভাকে। ভিক্টর মঙ্গিলের মাথায় লেগে আসা বল ক্লেটনের সঙ্গে লেগে থাকা পরিবর্তিত মিডফিল্ডার দানিশ ফারুক ক্লিয়ার করতে যান। কিন্তু ক্লেটন তাতে টোকা মেরে বল জালে জড়িয়ে দেন (১-০)।

পিছিয়ে থাকা ব্লাস্টার্স সমতা ফেরানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং ইস্টবেঙ্গলের গোলের পরেই ঘন ঘন আক্রমণ শানায়। ৮২ মিনিটের মাথায় সমতা আনার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান গিয়ানু। কিন্তু ফের দলকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিখুঁত ভাবে পালন করেন কমলজিৎ। ৮৮ মিনিটের মাথায় গোল লাইনের সামনে থেকে শট নেন দিমিত্রিয়স। তাও ধরে ফেলেন কমলজিৎ। অবশ্য তার আগেই পতাকা তুলে দেন সহকারী রেফারি।

বাড়তি ছ’মিনিটের মধ্যে ফুটবলের চেয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে ঝামেলাই বেশি দেখা যায়। যার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে যেমন লাল কার্ড দেখতে হয় ইস্টবেঙ্গলের এক সাপোর্ট স্টাফকে, তেমনই ম্যাচে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় মোবাশির রহমানকেও। তবে আর গোল শোধ করা সম্ভব হয়নি কেরালা ব্লাস্টার্সের পক্ষে।

ইস্টবেঙ্গল দল: কমলজিৎ সিং (গোল), অঙ্কিত মুখার্জি (মহম্মদ রকিপ), জেরি লালরিনজুয়ালা, চ্যরিস কিরিয়াকু, সার্থক গলুই, অ্যালেক্স লিমা, মোবাশির রহমান, ভিপি সুহের (সুমিত পাসি), নাওরেম মহেশ সিং, ক্লেটন সিলভা (অধি), জেক জার্ভিস (জর্ডন ও’ডোহার্টি)।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ         

বল পজেশন: ইস্টবেঙ্গল এফসি ৪৬% - কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি ৫৪%, সফল পাস: ২১৫/৩৩২ (৬৫%) - ৩২৩/৪৩৮ (৭৪%), গোলে শট: ৪-৩, ফাউল: ১৯-১৩, সেভ: ৩-৩, ইন্টারসেপশন: ৮-১২, কর্নার: ৩-৮, হলুদ কার্ড: ৫-৩, লাল কার্ড: ১-০, ম্যাচের হিরো: ক্লেটন সিলভা।