সেমিফাইনালের প্রথম লেগে অসাধারণ জয়ের পর এ বার ওডিশা এফসি-র সামনে একটাই লক্ষ্য, রবিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে আটকে দিয়ে প্রথমবার আইএসএল ফাইনালে ওঠা। অর্থাৎ, বেশ কঠিন এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে কলকাতায় পা রাখবে কলিঙ্গ বাহিনী। 

এই যুবভারতীতেই গত মরশুমে প্লে-অফের প্রথম ম্যাচে মোহনবাগানের কাছে দু’গোলে হেরে ছিটকে গিয়েছিল ওডিশা এফসি। সে দিন রীতিমতো দাপুটে পারফরম্যান্স দেখিয়ে ২-০-য় জেতে সবুজ-মেরুন বাহিনী। প্রথমার্ধে হুগো বুমৌস ও দ্বিতীয়ার্ধে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের গোলে সে ম্যাচ জিতে নেয় তারা। 

অসংখ্য সুযোগ সে দিন পেয়েছিল কলকাতার দল। সারা ম্যাচে ছ’টি শট গোলে রাখেন পেট্রাটসরা। সেখানে ওডিশা একটির বেশি গোলমুখী শট নিতে পারেনি। মোট ১১টি গোলের সুযোগ তৈরি করে মোহনবাগান। দলের দুই উইঙ্গার মনবীর সিং ও লিস্টন কোলাসোই তিনটি করে সুযোগ তৈরি করেন। কিন্তু গোল পাননি।   

আক্রমণের মতো সে দিন রক্ষণেও যথেষ্ট তৎপরতা দেখায় তৎকালীন এটিকে মোহনবাগান। প্রতিপক্ষের ধারালো ফরোয়ার্ড দিয়েগো মরিসিওকে বোতলবন্দী করে রাখে তারা। নন্দকুমার শেকর, ভিক্টর রড্রিগেজরাও বহুবার গোলের চেষ্টা করলেও বারবার তাঁরা আটকে যান প্রীতম কোটাল, স্লাভকো দামিয়ানোভিচ জুটির তোলা প্রাচীরে।

এ বার সবুজ-মেরুন রক্ষণে প্রীতমও নেই, দামিয়ানোভিচও নেই। আছেন শুভাশিস বোস, ব্রেন্ডান হ্যামিল, হেক্টর ইউস্তেরা। তাদের তৈরি রক্ষণের পাঁচিলে চিড় ধরিয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়াতে পারবেন রয় কৃষ্ণা, দিয়েগো মরিসিওরা? এটাই এই মুহূর্তে কোটি টাকার প্রশ্ন। 

সামনে যখন খোঁচা খাওয়া বাঘ 

লিগের শেষ তিন ম্যাচের আগে চেন্নাইন এফসি-র কাছে হেরে যে রকম ধাক্কা খেয়েছিল মোহনবাগান, সেমিফাইনালের প্রথম লেগে এক গোলে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত ওডিশার কাছে হেরে বড় ধাক্কা খেয়েছে তারা। এক ধাক্কার পর তাদের টানা তিন ম্যাচে জয় (মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে জয়-সহ) যে ভাবে মোহনবাগানকে লিগ শিল্ড এনে দিয়েছিল, সে ভাবেই আর এক ধাক্কার পর তাদের নিজেদের মাঠে আটকানো যে বেশ কঠিন হবে, তা  জেনেই রবিবার নামবে সের্খিও লোবেরার দল। 

তাদের একটা ড্র হলেই চলবে। মোহনবাগানকে গোল করতে না দিলেই তারা ফাইনালের দরজা খুলে ফেলবে। অর্থাৎ শুরু থেকেই তাদের নিজেদের গোলের সামনে পাঁচিল তুলে রাখতে হবে। দলের মাঝমাঠ, উইংয়ের সঙ্গে দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, জেসন কামিংসদের যোগাযোগ বিচ্ছিন করে দিতে হবে। লোবেরার ক্ষুরধার মস্তিষ্কে যে এখন এই সবই চলছে, তা হলফ করে বলা যায়। 

শুক্রবার কলকাতায় রওনা হওয়ার আগে তিনি বলেন, “যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে খেলা মোটেই সোজা নয়। বিশেষ করে মোহনবাগানের মতো বড় দলের বিরুদ্ধে। তবে এই মাঠেই আমরা এএফসি কাপের ম্যাচে ওদের হারিয়েছি। আমাদের খেলোয়াড়দের চারিত্রিক দৃঢ়তা সেই ম্যাচেই প্রমাণিত হয়েছিল। আমি আত্মবিশ্বাসী এবং ম্যাচটা নিয়ে যথেষ্ট উত্তেজিত। আমাদের দলের ছেলেরা বড় ম্যাচের জন্য সব সময়ই তৈরি থাকে। আশা করি, এই ম্যাচে আমরা ভাল ফল নিয়ে মাঠ ছাড়ব এবং ফাইনালে উঠব”। 

রবিবার যুবভারতীর গ্যালারিতে হাজার ষাটেক মোহনবাগান সমর্থকের ঢল নামার সম্ভাবনা প্রবল। গ্যালারির এই দর্শকদের দেখেই নিজেদের উজ্জীবিত করার পরামর্শ দলের ছেলেদের দিয়েছেন লোবেরা। অযথা চাপ নিতেও তাঁদের বারণ করেছেন তিনি। বরং ম্যাচটা উপভোগ করে সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটানোই তাদের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন ওডিশা এফসি-র কোচ। 

৫-২-এর স্মৃতিই প্রেরণা?

গত নভেম্বরে যুবভারতীতে এএফসি কাপের যে ম্যাচের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন লোবেরা, সেই ম্যাচে ৫-২-এ জিতে এশীয়স্তরের ক্লাব টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব থেকেই তারা ছিটকে দেয় সবুজ-মেরুন বাহিনীকে। ম্যাচের ১৭ মিনিটের মাথায় গোল করে মোহনবাগান এসজি-কে এগিয়ে দেন হুগো বুমৌস। কিন্তু ২৯ ও ৩২ মিনিটের মাথায় পরপর গোল করে তাদের পাল্টা চাপে ফেলে দেন যথাক্রমে প্রাক্তন সবুজ-মেরুন তারকা রয় কৃষ্ণা ও দিয়েগো মরিসিও। 

প্রথামার্ধেই ৪১ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন ওডিশার সাই গদার্ড। ৬৩ মিনিটের মাথায় একটি গোল শোধ করেন মোহনবাগানের পরিবর্ত স্ট্রাইকার কিয়ান নাসিরি। কিন্তু ম্যাচের শেষে বাড়তি সময়ে পরপর দুটি গোল করে ওডিশার জয় সুনিশ্চিত করেন দুই সুপারসাব অনিকেত যাদব ও ইসাক রালতে।

হয়তো সেই ম্যাচেই ভিডিও দেখেই রয় কৃষ্ণাদের তাতাবেন লোবেরা। তবে সেই মোহনবাগান আর এই মোহনবাগানের মধ্যে যে তফাৎ রয়েছে, তাও তিনি জানেন। মোহনবাগান সে দিন চোটের জন্য দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে পায়নি। তবে বাকি পাঁচ বিদেশী ফুটবলার সে দিন খেলেছিলেন। কারণ, এএফসি-র ক্লাব টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী ছজন বিদেশীকে খেলানো যায় প্রথম এগারোয়। 

তবে প্রথম দলের প্রায় চারজন ফুটবলারকে (আশিক কুরুনিয়ান, আনোয়ার আলি, মনবীর সিং ও পেট্রাটস) যদি না পাওয়া যায়, তা হলে এএফসি কাপের মতো টুর্নামেন্টে ভাল ফল করা কঠিন হয়ে ওঠে। শুধু যে চোট-আঘাতে জর্জরিত ছিল মোহনবাগান, তা নয়। জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকু, লিস্টন কোলাসো, সহাল আব্দুল সামাদের মতো কয়েকজন নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়ের অফ ফর্মও দলকে দলকে ভোগায়। কিন্তু এখনকার মোহনবাগান সম্পুর্ণ আলাদা। লিগের শেষ তিন ম্যাচেই তা বুঝিয়ে ছেড়েছে তারা। কোচও বদলেছে। দায়িত্বে এসেছেন আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। কৌশলের যুদ্ধে যিনি লোবেরার সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারেন। 

ডিসেম্বরে কঠোর প্রতিরোধ!

ডিসেম্বরে যখন যুবভারতীতে আইএসএলের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল, তখনও যে মোহনবাগান পুরো শক্তি নিয়ে নামতে পেরেছিল, তাও নয়। সে দিন ম্যাচ শুরুর আগে একজন ও ম্যাচ চলাকালীন তিনজন নির্ভরযোগ্য ফুটবলারকে চোটের জন্য হারায় মোহনবাগান। তা সত্ত্বেও ওডিশা এফসি-র মতো ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা দলকে রুখে দিতে পেরেছিল তারা। 

যে ম্যাচে ৩৫ বার ফাউলের বাঁশি বাজাতে হয় ও আটবার হলুদ কার্ড বার করতে হয় রেফারিকে, সেই ম্যাচে চোট পেয়ে বিরতির পর আর খেলতে পারেননি সবুজ-মেরুন শিবিরের দুই নির্ভরযোগ্য তারকা সহাল আব্দুল সামাদ ও অনিরুদ্ধ থাপা। ম্যাচের আগেই ওয়ার্ম-আপ করার সময় হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পান হুগো বুমৌস। থাপার জায়গায় নামা গ্ল্যান মার্টিন্সও চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন।

সে দিন প্রথমার্ধে ৩১ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে ও স্টপেজ টাইমের তৃতীয় মিনিটে গোল করে ওডিশাকে এগিয়ে দেন জাহু। বিরতির পর ৫৮ মিনিটের মাথায় ও ইনজুরি টাইমের চতুর্থ মিনিটে দুটি গোলই শোধ করে দেন সাদিকু। শেষ পর্যন্ত না হারার মানসিকতাই সে দিন তাদের এক পয়েন্ট এনে দেয়। কিন্তু রবিবার সাদিকুকে পাবে না মোহনবাগান। যেমন রক্ষণে কার্লোস দেলগাদোকে পাবে না ওডিশা। দুজনেই গত ম্যাচে লাল-কার্ড দেখেন। 

এ বার আসল মহারণ!

এ মরশুমে যুবভারতীতে বাগান-ওডিশার গত দুই মুখোমুখিতে আরও একজন ছিলেন না, তিনি জনি কাউকো। নতুন বছরে তিনি হাবাসের প্রশিক্ষণাধীন দলে যোগ দিয়ে দলের চেহারাই পাল্টে দেন। সেই কাউকোকে সামলানোও ওডিশার দলের পক্ষে একটা বড় পরীক্ষা হয়ে উঠতে চলেছে। 

রবিবার যে শুরু থেকেই ঘর সামলে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখবে মোহনবাগান, এটাই ধরে নেওয়া যায়। কারণ, এই ম্যাচে তাদের জেতা ছাড়া ফাইনালে যাওয়ার আর কোনও রাস্তা নেই। সে জন্য ম্যাচের অনেকাংশেই হয়তো রক্ষণাত্মক থাকতে হবে ওডিশাকে। কিন্তু দেলগাদোকে ছাড়া তাদের এই কাজটা কিছুটা হলেও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। 

সেক্ষেত্রে আহমেদ জাহুকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় দেখা যেতে পারে। মুর্তাদা ফলের সঙ্গে তিনি সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের ভূমিকা পালন করলে মোহনবাগানের অ্যাটাকারদের পেনাল্টি এরিয়ায় ঢোকা অবশ্যই কঠিন হবে। কিন্তু জাহুকে রক্ষণ সামলাতে হলে মাঝমাঠ থেকে রয় কৃষ্ণা, মরিসিওদের গোলের বল বাড়ানোর জন্য জেরি মাওমিঙথাঙ্গা ও ইশাক রালতেকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। এই ম্যাচে ওডিশার পক্ষে গোল করার চেয়ে গোল আটকানো বেশি জরুরি। তাই লোবেরা নিশ্চয়ই সেই কাজেই বেশি মন দেওয়ার পরামর্শ দেবেন দলের ছেলেদের। 

লোবেরার দলের নিউক্লিয়াস বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তা হলে তিনি অবশ্যই রয় কৃষ্ণা, যাঁর যুবভারতীতে খেলার অভিজ্ঞতা অন্য সতীর্থদের চেয়ে অনেক বেশি। ময়দানি ভাষায় যুবভারতীর প্রতিটি ঘাস তাঁর চেনা। সেই যুবভারতীতে জীবনের অন্যতম সেরা পরীক্ষায় নামতে চলেছেন রয়। সেই পরীক্ষায় পাস করার জন্য নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে উঠবেন ফিজিয়ান তারকা। রক্ষণ থেকে আক্রমণ, সর্বত্র তাঁর আনাগোনা। তাই তাঁকে কড়া পাহাড়ায় রাখার বন্দোবস্ত করতে পারেন হাবাস। সেই পাহাড়া ভেঙে বেরিয়ে আসাটা রয়ের কাছে বড় পরীক্ষা হয়ে উঠবে। তবে রয়কে জায়গা দিলে যে সর্বনাশ হতে পারে, গত ম্যাচেই টের পেয়ে গিয়েছেন মোহনবাগান তারকারা। সেই ভুল আর তাঁরা করবেন বলে মনে হয় না। 

২০১৯-২০ মরশুম থেকে আইএসএলে খেলে আসছে ওডিশা এফসি। প্রথমবার লিগ টেবেলে ষষ্ঠ, দ্বিতীয়বার ১১, তৃতীয় মরশুমে সপ্তমে থাকার পর গত বার তারা প্লে অফে ওঠে এবং প্রথম ম্যাচেই হেরে ছিটকে যায়। এ বার চারবারের চেষ্টা ক্রমশ উন্নতি করে এ বার তারা ফাইনালের দোরগোড়ায়। তাদের প্রিয় দলকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন ওডিশার সমর্থকেরা। ফাইনালে উঠতে গেলে যে বড় হার্ডল পেরোতে হবে তাদের দলকে, সেই হার্ডল এ মরশুমে তারা আগেও পেরিয়েছে। তাই আশায় বুক বাঁধতেই পারেন তাদের সমর্থকেরা।