আর কয়েক ঘণ্টা পেরোলেই শুরু হয়ে যাবে ভারতের নতুন ক্লাব ফুটবল মরশুম। ঐতিহ্যবাহী ডুরান্ড কাপ দিয়ে যা শুরু হচ্ছে এবং আগামী বছর মে মাসে যা শেষ হবে সুপার কাপ দিয়ে। আগের মতো এখন আর শুধু হিরো আইএসএল নয়, তার আগে পরে এই নাতিদীর্ঘ দুই টুর্নামেন্ট জুড়ে যাওয়ায় মরশুমের মেয়াদ বেড়ে হতে চলেছে ন’মাস। গত দু’বছর ধরে যেখানে পাঁচ মাসের হিরো আইএসএলেই মরশুমের শুরু ও শেষ হয়ে যেত, এ বার থেকে তা আর হবে না। ফলে দেশের ফুটবলাররাও নিজেদের প্রায় সারা বছর ব্যস্ত রাখতে পারবেন ফুটবল মাঠে।

ক্লাব মরশুমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠায় ডুরান্ড কাপ এ বার আয়তনেও আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। এ বারই প্রথম ১৩১ বছর পুরনো এই টুর্নামেন্টে ২০টি দল খেলছে। বিশ্বের তৃতীয় প্রাচীন এই ফুটবল টুর্নামেন্টে যা নজিরবিহীন বলা যায়। হিরো আইএসএলে অংশগ্রহনকারী ১১টি ক্লাবই এ বার এই টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে। এই টুর্নামেন্টের আয়োজক ভারতীয় সেনাবাহিনীর চারটি দল আর্মি রেড, আর্মি গ্রিন, বায়ূসেনা ও নৌসেনার দল এবং হিরো আইলিগের পাঁচটি দল মহমেডান স্পোর্টিং, নেরোকা এফসি, ট্রাউ এফসি, রাজস্থান ইউনাইটেড ও সুদেভা দিল্লি এফসি-ও এ বার এই ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টে অংশ নেবে।

শুধু দলের সংখ্যাতেই নয়, আরও বিভিন্ন বিষয়েও পরিবর্তন এসেছে ডুরান্ড কাপে। আগে এই টুর্নামেন্ট প্রতি বছর হত দেশের রাজধানী দিল্লিতে। ২০১৯-এ প্রথম তা দিল্লির বাইরে কলকাতায় আসে। এ বার আর শুধু কলকাতা নয়, গুয়াহাটি ও ইম্ফলেও হতে চলেছে। টুর্নামেন্টের জনপ্রিয়তা যাতে তুঙ্গে ওঠে, সে জ্ন্য কলকাতার দলগুলির খেলা রাখা হয়েছে এই শহরেই। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের ম্যাচগুলি হবে গুয়াহাটিতে এবং নেরোকা ও ট্রাউয়ের ম্যাচগুলি হবে ইম্ফলে।

কুড়িটি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। প্রতি গ্রুপে রয়েছে পাঁচটি করে দল। প্রতি গ্রুপের সেরা দু’টি দল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠবে। গ্রুপ ‘এ’-তে গতবারের চ্যাম্পিয়ন এফসি গোয়া, বেঙ্গালুরু এফসি ও জামশেদপুর এফসি-র সঙ্গে রয়েছে মহমেডান স্পোর্টিং ও ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স। গ্রুপ ‘ডি’-তেও তিনটি হিরো আইএসএলের দল থাকছে, কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি, ওডিশা এফসি ও নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি। সঙ্গে আর্মি গ্রিন ও সুদেভা দিল্লি এফসি। গ্রুপ ‘সি’-তে রাখা হয়েছে চেন্নাইন এফসি, হায়দরাবাদ এফসি-কে। তাদের সঙ্গে আর্মি রেড এবং ইম্ফলের দু’টি ক্লাব দল ট্রাউ এফসি ও নেরোকা এফসি-ও রয়েছে।

আকর্ষণের কেন্দ্রে

গ্রুপ ‘বি’-র দিকে অনেকেই তাকিয়ে থাকবে। কারণ, সেখানে একে অপরের মুখোমুখি হবে কলকাতার দুই প্রধান সবুজ-মেরুন ব্রিগেড ও লাল-হলুদ বাহিনী। মুম্বই সিটি এফসি-ও এই গ্রুপের অন্যতম দল, যাদের সঙ্গে মাঠে নামবে ভারতীয় নৌসেনা ও রাজস্থান ইউনাইটেড এফসি।

গত হিরো আইএসএলে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে কয়েকটি ভুলের মাশুল দিয়ে সেই পর্ব থেকেই ছিটকে যেতে হয় এটিকে মোহনবাগানকে। সেই ভুলগুলি এই মরশুমে শুধরে নিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্য নিয়েই মরশুম শুরু করতে চলেছে তারা। যে কারণে দলের খোলনলচে পাল্টেছেন স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো।

ক্লাব সমর্থকদের দুই নয়ণের মণি রয় কৃষ্ণা ও ডেভিড উইলিয়ামসকে যেমন বিদায় দিয়েছে এটিকে মোহনবাগান, তেমনই ডিফেন্ডার সন্দেশ ঝিঙ্গন, উইঙ্গার প্রবীর দাসকেও অব্যহতি দিয়েছে তারা। আরেক নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার স্প্যানিশ তারকা তিরি চোটের জন্য এই মরশুমের বেশির ভাগ সময়টাই যে মাঠে নামতে পারবেন না, সে রকমই জানা গিয়েছে। এই ঘাটতি পূরণের জন্য দুই বিদেশি ডিফেন্ডার গিনির ফ্লোরেন্তিন পোগবা ও অস্ট্রেলিয়ার ব্রেন্ডান হ্যামিলকে সই করানো হয়েছে।  

এ বার প্রীতম কোটাল, শুভাশিস বোসদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন গত হিরো আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হায়দরাবাদ এফসি থেকে আসা ডিফেন্ডার আশিস রাই। এই ডিফেন্স লাইন-আপের সঙ্গে ২৯ বছর বয়সি হ্যামিল ও ৩২-এর পোগবা যোগ দিলে, সবুজ-মেরুন রক্ষণ দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে পারে। একটা দল যত কম গোল খাবে, ততই তাদের হারের সংখ্যাও কমবে। এই তত্ত্ব অনুসরণ করেই এ ভাবে দল সাজিয়েছেন ফেরান্দো।

দল নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কতটা সঠিক, তার আন্দাজ এই ডুরান্ড কাপেই পেয়ে যাবে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। হিরো আইএসএলের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে নিলেও মরশুমের শুরুতেই কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে এটিকে মোহনবাগানকে। কারণ, একই গ্রুপে রয়েছে ইস্টবেঙ্গল এফসি এবং মুম্বই সিটি এফসি-ও।

কঠিন পরীক্ষা

ইতিহাস বলছে ফুটবল মাঠে লাল-হলুদ ব্রিগেড বরাবরই সবুজ-মেরুন বাহিনীর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দী। সেই প্রতিদ্বন্দিতা যে রকমই হোক না কেন, কলকাতা ডার্বিকে ঘিরে বঙ্গ ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে। কিন্তু গত দু’বছর ধরেই এই প্রতিদ্বন্দিতায় এটিকে মোহনবাগানই এগিয়ে ছিল। ডার্বির পরিচিত ফুটবল যুদ্ধ দেখতে পাওয়া যায়নি তাদের এই দুই বছরের দ্বৈরথে। লড়াইটা হয়েছে একপেশে, যেখানে প্রতিবারই শেষ হাসি হেসেছে এটিকে মোহনবাগান।

এ বার সেই ছবিটা পাল্টাতে মরিয়া লাল-হলুদ শিবির। কিন্তু গত দু’বারের মতোই তারা তাদের দলগঠন শুরু করেছে দেরীতেই। তাই নতুন কোচ স্টিফেন কনস্টানটাইনের প্রশিক্ষণে ডুরান্ড কাপে কতটা সংগঠিত হয়ে নামতে পারবে, সেটাই এখন দেখার। ২৮ অগস্টের কলকাতা ডার্বি গত দু’বছরেরই পুনরাবৃত্তি হয়ে উঠবে কি না, এমন আশঙ্কা অনেকেরই। তবে এই আশঙ্কা নির্মূল করাই হবে ভারতের প্রাক্তন জাতীয় কোচের দলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

কড়া চ্যালেঞ্জ

একে অপরকে কতটা কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবে কলকাতার দুই প্রধান, তা তো সময় এলেই বোঝা যাবে। কিন্তু এই দুই দলের কাছেই যে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মুম্বই সিটি এফসি, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ২৮ তারিখ কলকাতা ডার্বি যতটা উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠবে, তার চেয়েও বেশি চিত্তাকর্ষক ম্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা ২৪ অগস্ট, এটিকে মোহনবাগান ও মুম্বই সিটি এফসি-র মধ্যে। কারণ, দলের খেলোয়াড়দের প্রোফাইল ও প্রস্তুতির দিক থেকে গ্রুপের সেরা দুই দল এরাই।

দুই দলেরই ফুটবলারদের মিশ্রণ তৈরি করা হয়েছে সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী। গতবার হিরো আইএসএলে সেরা চারে থেকে শেষ করতে না পারলেও লিগ তালিকায় পাঁচ নম্বরে ছিল মুম্বইয়ের দলটি। তার আগের বার লিগের এক নম্বর দল হওয়ার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নও হয় তারা। এই এটিকে মোহনবাগানকে ফাইনালে হারিয়েই খেতাব জিতেছিল মুম্বই সিটি এফসি। তাই গত মরশুমের ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে আগের জায়গায় ফিরে যেতে বদ্ধপরিকর তারা।

এটিকে মোহনবাগানে যেমন এ বার এক ঝাঁক নতুন মুখে দেখা যাবে, মুম্বই সিটি এফসি-র জার্সি গায়ে এই প্রথমবার মাঠে দেখা যাবে হিরো আইএসএলের অভিজ্ঞ তারকা গ্রেগ স্টুয়ার্ট, আলবার্তো নগুয়েরা, জর্জ পেরেইরা ডিয়াজদের। বিপিন সিং, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে-দের নিয়ে গড়া দলের আক্রমণ বিভাগের ওপরেও নজর থাকবে দেশের ফুটবল মহলের।

অচেনা শত্রু

গ্রুপের অন্য দুই দল রাজস্থান ইউনাইটেড এবং নৌসেনা বাহিনীকে কম গুরুত্ব দিলে অবশ্য চরম ভুল করবে তথাকথিত নামী এই দলগুলি। কারণ, অচেনা শত্রু বরাবরই বিপজ্জনক। রাজস্থান ইউনাইটেড সে রাজ্যের প্রথম ক্লাব, যারা গত বারই প্রথম হিরো আইলিগে অংশ নেয়। ১২ ম্যাচে ১৬ পয়েন্ট নিয়ে সাত নম্বরে ছিল তারা। সে বার মহমেডান স্পোর্টিং, চার্চিল ব্রাদার্স ও আইজল এফসি-র মতো দলকে হারায়। এ বার তারা আরও কিছুটা শক্তি বাড়াতে পেরেছে কি না, তা এই ডুরান্ড কাপেই বোঝা যাবে। গতবার নৌসেনাদের দল গ্রুপে চতুর্থ হয়েছিল একটিমাত্র ম্যাচ জিতে। পাঁচ গোল দিয়ে সাত গোল খেয়েছিল তারা।

ডুরান্ড কাপের গ্রুপ পর্বে এটিকে মোহনবাগানের ম্যাচগুলি হবে ২০ অগস্ট (বনাম রাজস্থান ইউনাইটেড), ২৪ অগস্ট (মুম্বই সিটি এফসি), ২৮ অগস্ট (কলকাতা ডার্বি) ও ৩১ অগস্টে (নৌসেনা)। লাল-হলুদ ব্রিগেড মাঠে নামবে ২২ অগস্ট (নৌসেনা), ২৫ অগস্ট (রাজস্থান ইউনাইটেড), ২৮ অগস্ট (ডার্বি) ও ৩ সেপ্টেম্বরে (মুম্বই সিটি এফসি)। সব ম্যাচই সন্ধ্যা ছ’টা থেকে। গ্রুপ পর্বের পর শুরু হবে নক-আউট পর্ব, যেখানে হবে কোয়ার্টার ও সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল। তবে তার বিস্তারিত সূচি এখনও প্রকাশিত হয়নি। সব মিলিয়ে ৪৭টি ম্যাচ হবে।