দুই ম্যাচে জয়হীন থাকার পরে শনিবার ঘরের মাঠে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে সাফল্যের পথে ফিরল এটিকে মোহনবাগান। শুধু জয় নয়, এ দিন অসাধারণ ও দাপুটে জয় অর্জন করে নেয় গতবারের সেমিফাইনালিস্টরা। অস্ট্রেলীয় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, যাঁকে ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলানো হচ্ছে, সেই দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের জোড়া গোলেই এই ম্যাচ থেকে তিন পয়েন্ট ছিনিয়ে নেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী।
অনেক দিন পরে যুবভারতীতে এটিকে মোহনবাগানকে সেরা ছন্দে পাওয়া যায়, যার জেরে ম্যাচের কোনও সময়ই লড়াইয়ে ফিরতে পারেনি ওডিশার দল। এই জয়ের ফলে লিগ টেবলে তিন নম্বরে চলে এল সবুজ-মেরুন বাহিনী। ১৫ ম্যাচে তাদের সংগ্রহ ২৭ পয়েন্ট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা হায়দরাবাদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান দাঁড়াল আট পয়েন্টের। অন্য দিকে হারের ফলে ওডিশা এফসি প্রথম ছয় থেকে ছিটকে বেরিয়ে নেমে গেল সাতে।
এ দিন ম্যাচের তৃতীয় মিনিটেই প্রথম গোল করে দলকে এগিয়ে দেন পেট্রাটস। ৮০ মিনিটের মাথায় জয়সূচক গোলটি করেন তিনি। ‘দিমি’গোল করলেও এ দিন দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন হুগো বুমৌস, আশিস রাই, গ্ল্যান মার্টিন্স, মনবীর সিং ও আশিক কুরুনিয়ান। আশিস, শুভাশিস, কার্ল ম্যাকহিউ, আশিক, গায়েগোরা একটি করে গোলের সুযোগ তৈরি করেন। হুগো বুমৌস একাই তিন-তিনটি গোলের সুযোগ তৈরি করেন। কিন্তু ম্যাচের একেবারে শেষে লাল কার্ড দেখেন আশিক। বুমৌসও এ দিন চতুর্থ হলুদ কার্ড দেখেন। ফলে এই দু’জনই আগামী ম্যাচে বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে খেলতে পারবেন না।
দলে একাধিক পরিবর্তন করে এদিন প্রথম এগারো নামায় এটিকে মোহনবাগান। সদ্য শিবিরে যোগ দেওয়া গ্ল্যান মার্টিন্স এবং আশিক কুরুনিয়ানকে এদিন শুরু থেকেই দেখা যায়। দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে সামনে রেখে ৪-২-৩-১-এ দল সাজান সবুজ-মেরুন কোচ হুয়ান ফেরান্দো। অন্য দিকে, আরও আক্রমণাত্মক ছকে দল সাজায় ওডিশা। নন্দকুমার শেখর, দিয়েগো মরিসিও ও জেরি মাউইমিঙথাঙ্গাদের আক্রমণে রেখে ৩-৪-৩-এ খেলা শুরু করেন কোচ জোসেফ গোম্বাউ।
যতই আক্রমণাত্মক ছক সাজান ওডিশার কোচ, এটিকে মোহনবাগানই এ দিন শুরু থেকে দাপুটে ফর্মে ছিল এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রথম গোল করে এগিয়ে যায় তারা। হুগো বুমৌসরা অসাধারণ এক আক্রমণ তৈরি করলেও একেবারে শেষে ওডিশার ওসামা মালিক বল ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোলে বল ঠেলে দেন পেট্রাটস।
মাঝমাঠ থেকে বুমৌসের দ্রুত দৌড় দিয়েই আক্রমণটি শুরু হয়। তিনি ডানদিকে বল বাড়ান মনবীর সিংকে। মনবীর বক্সের মধ্যে ক্রস দিলেও সেটি তেমন ভাল ছিল না। অনায়াসে ক্লিয়ার করে দিতে পারতেন ওসামা। কিন্তু তাঁর মিসক্লিয়ারেন্সের জেরে বল চলে আসে পেট্রাটসের পায়ে এবং তিনি দূরের পোস্ট দিয়ে তা ঠেলে দেন গোলে (১-০)।
পাঁচ মিনিটের মাথায় ডানদিকের উইংয়ে ফাঁকায় বল পেয়ে যান মনবীর। তিনি গোলের দিকে দৌড়ন এবং কাট ব্যাক করে বাঁ পায়ে সোজা গোলে শট নিলেও তা সোজা গোলকিপারের হাতে চলে যায়। একটি গোল ও একটি অনবদ্য সুযোগ পেয়ে আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে এটিকে মোহনবাগান এবং তারাই চালকের আসনে বসে পড়ে।
আশিক কুরুনিয়ান ১৬ মিনিটের মাথায় যে সুযোগটি পান, সেটি থেকেও গোল হতে পারত অনায়াসে। বাঁ উইং দিয়ে ওঠা আশিক ফাঁকায় বল পেয়ে বক্সের মাথা থেকে সোজা গোলে শট নেন। কিন্তু এ বারও গোলকিপার অমরিন্দর সিং ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বল গোলের পথ থেকে বের করে দেন।
কুড়ি মিনিটের মাথায় ওডিশা আবার একটি ধাক্কা খায় রেইনিয়ে ফার্নান্ডেজ মাথায় চোট পেয়ে যাওয়ায়। তিনি মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ায় তাঁর জায়গায় নামেন আইজ্যাক চাকচুয়াক। বিপক্ষের দাপুটে পারফরম্যান্সের চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যান নরেন্দর গেহলট, কার্লোস দেলগাদোরা। প্রথম আধ ঘণ্টায় এটিকে মোহনবাগান গোলে তিনটি শট নিলেও ওডিশা একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি। এই সময়ে অমরিন্দরকে দু’টি সেভ করতে দেখা গেলেও বিশাল কয়েথকে কোনও কড় পরীক্ষার সামনে পড়তে দেখা যায়নি।
মরিসিও, নন্দ-রা তাঁদের মাঝমাঠ থেকে ঠিকমতো সাপ্লাই-ই পাননি। মার্টিন্স সবুজ-মেরুন শিবিরে এসে যাওয়ায় তাদের মাঝমাঠকে এ দিন অনেক শক্তিশালী দেখায়। দুর্দান্ত ডিফেন্সিভ স্ক্রিনের ভূমিকা পালন করেন তিনি। মাঝমাঠ থেকে নিজেদের অর্ধে বল কার্যত যেতেই দিচ্ছিলেন না মার্টিন্স ও কার্ল ম্যাকহিউ। ফলে তাদের রক্ষণের ওপরেও এ দিন চাপ কম ছিল। উপায় না দেখে ৩৭ মিনিটের মাথায় নন্দ বক্সের বাইরে থেকে শট নেন, যা সোজা বিশালের হাতে জমা হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেও সেই এটিকে মোহনবাগানের দাপটই ছিল বেশি। তবে এ বার যথেষ্ট সতর্ক ছিল ওডিশার রক্ষণ। ফলে সবুজ-মেরুন বাহিনী এই অর্ধের প্রথম ১৫ মিনিটে কোনও পজিটিভ অ্যাটাক তৈরি করতে পারেনি।
৬২ মিনিটের মাথায় ওডিশার কোচ গোম্বাউ একসঙ্গে চার-চারটি পরিবর্তন আনেন দলে। নামান তিন ফরোয়ার্ড পেদ্রো মার্টিন্স, আইজ্যাক রালতে ও অনিকেত যাদবকে। এছাড়াও নামেন ডিফেন্ডার নিখিল প্রভু। এই চার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পরিবর্তনের কোটা শেষ হয়ে যায়। অথচ তখনও আধ ঘণ্টার খেলা বাকি। তিন তরতাজা ফরোয়ার্ড একসঙ্গে নামায় স্বাভাবিক ভাবেই ওডিশার আক্রমণে কিছুটা হলেও ধার বাড়ে এবং হাইলাইন ফুটবল খেলা শুরু করে তারা। দলের ডিফেন্ডারদের বেশির ভাগ সময় সেন্টার লাইনে দেখা যায়। তবে এই চাপ ধরে রাখতে পারেনি তারা।
প্রতিপক্ষ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠায় এটিকে মোহনবাগানের মাঝমাঠ ও রক্ষণ আরও তৎপর হয়ে ওঠে এবং তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ফরোয়ার্ডরাও। কাউন্টার অ্যাটাকের সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। এবং একাধিক সুযোগও পান তাঁরা। কিন্তু প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় এত বেশি সময় নিচ্ছিলেন মনবীর, আশিকরা যে ট্রানজিশনে অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয়নি ওডিশাকে। তবে ক্রমশ নিজেদের শুধরে নিয়ে প্রতি আক্রমণের গতি বাড়ান মনবীররা।
নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ২২ মিনিট আগে মনবীরের জায়গায় লিস্টন কোলাসোকে নামান হুয়ান ফেরান্দো, যা ছিল তাঁর প্রথম পরিবর্তন। ৮১ মিনিটের মাথায় ফেদরিকো গায়েগো নামেন বুমৌসের জায়গায়। এই দুই পরিবর্তনের মাঝখানে এটিকে মোহনবাগান তাদের দ্বিতীয় গোলটি তুলে নেয় ৮০ মিনিটের মাথায়, যার নায়ক ফের সেই পেট্রাটস। তিনি গোল করলেও তাঁকে ডানদিকের উইং থেকে অসাধারণ এক লো-ক্রসে গোল সাজিয়ে দিয়ে নেপথ্য নায়ক হয়ে ওঠেন আশিস রাই। প্রতিপক্ষের গোলের সামনে তাঁর সাজানো ক্রসে টোকা দিয়ে জালে বল জড়িয়ে দেন পেট্রাটস (২-০)।
জোড়া গোলের নায়ককে ৮৫ মিনিটের মাথায় তুলে নিয়ে নামানো হয় স্লাভকো দামজানোভিচকে। গ্ল্যান মার্টিন্সও এই সময় মাঠ ছাড়েন পুইতিয়াকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে গায়েগোর থ্রু থেকে বল পেয়ে বক্সের ডানদিক থেকে গোলে শট নেন কোলাসো। কিন্তু বল দূরের পোস্টে লেগে ফিরে আসে।
কিন্তু ম্যাচের একেবারে শেষ মিনিটে যে ভাবে মেজাজ হারিয়ে লাল কার্ড দেখে বসেন আশিক, তা এড়ানো যেত হয়তো। কার্লোস দেলগাদো তাঁকে ফাউল করায় তিনি পড়ে যান। উঠে যখন দেলগাদোকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন, তখন রেফারি ছিলেন তাঁদের কাছেই। দেলগাদোকে হলুদ কার্ড দেখানোর পাশাপাশি আশিককে লাল কার্ড দেখান রেফারি। এই ঘটনার মিনিট খানেকের মধ্যেই খেলা শেষের বাঁশি বাজে। এই ম্যাচে দাপুটে জয় পেলেও পরের ম্যাচে আশিক, বুমৌসদের খোয়ানোর আফসোস রয়ে গেল সবুজ-মেরুন শিবিরে।
এটিকে মোহনবাগান দল: বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, প্রীতম কোটাল (অধি), ব্রেন্ডান হ্যামিল, শুভাশিস বোস, গ্ল্যান মার্টিন্স (পুইতিয়া), কার্ল ম্যাকহিউ, হুগো বুমৌস (ফেদরিকো গায়েগো), আশিক কুরুনিয়ান, মনবীর সিং (লিস্টন কোলাসো), দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (স্লাভকো দামজানোভিচ)।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: এটিকে মোহনবাগান ৫০% - ওডিশা এফসি ৫০%, সফল পাস: ২৯৭/৪১৬ (৭১%) - ৩০৯/৪৩৫ (৭১%), গোলে শট: ৫-১, ফাউল: ৯-১৬, সেভ: ১-৩, ইন্টারসেপশন: ২৮-১৩, কর্নার: ৫-১, হলুদ কার্ড: ২-৪, লাল কার্ড: ১-০ ম্যাচের হিরো: দিমিত্রিয়স পেট্রাটস।