গত শনিবার হিরো আইএসএল ৭-এর ফাইনালে হেরে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই মনমরা সারা দেশের সমর্থকেরা। এমনকী দেশের বাইরে থেকেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের কষ্টের কথা প্রকাশ করেছেন প্রবাসী সমর্থকেরা। শনিবার ফতোরদার স্টেডিয়ামে মুম্বই সিটি এফসি-র কাছে হারকে অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। বেশিরভাগই বলছেন, এত ভাল খেলেও ফাইনালে হার সবুজ-মেরুন ফুটবলারদের প্রাপ্য ছিল না।

সে দিন ফতোরদা স্টেডিয়ামে টানটান উত্তেজনায় ভরা ফাইনাল ম্যাচে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে ৯০ মিনিট পর্যন্ত ফল ১-১ রাখার পরে মণিপুরী মিডফিল্ডার বিপিন সিংয়ের গোলে ম্যাচ জিতে নেয় মুম্বই সিটি এফসি। ১৮ মিনিটের মাথায় ডেভিড উইলিয়ামসের গোলে এটিকে মোহনবাগান এগিয়ে যাওয়ার পরে তাঁরই সতীর্থ স্প্যানিশ ডিফেন্ডার তিরির নিজ গোলে সমতা আনে মুম্বই। সব শেষে বিপিন সিংয়ের গোলে ম্যাচের নিষ্পত্তি হয়।

এই প্রথম হিরো আইএসএলের চ্যাম্পিয়ন খেতাব জিতল মুম্বই সিটি এফসি। এক সপ্তাহ আগে লিগ টেবলে এক নম্বর হিসেবে শেষ করে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্লাব-লিগ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার ছাড়পত্র অর্জন করে নেয় তারা। একই মরশুমে জোড়া খেতাব অর্জন করে তাই রীতিমতো উচ্ছ্বসিত মুম্বইয়ের দলের কোচ ও ফুটবলাররা। ঠিক ততটাই হতাশ ও বিপর্যস্ত এটিকে মোহনবাগানের ফুটবলার ও কোচেরা। ম্যাচের পর থেকে কেউই সংবাদ মাধ্যমে কোনও প্রতিক্রিয়াও দেননি।

তাঁরা কথা না বললেও বাংলার ফুটবল মহলে এই নিয়ে চর্চা তুঙ্গে। বাংলার ফুটবল বিশেষজ্ঞ তথা প্রাক্তন ফুটবলাররাও এই চর্চায় সামিল হয়েছেন। অনেকের মধ্যে নানা বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও একটা ব্যাপারে তাঁরা একমত, শনিবার হারার মতো পারফরম্যান্স ছিল না রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস, প্রীতম কোটাল, সন্দেশ ঝিঙ্গনদের।

সবুজ-মেরুন শিবিরের প্রাক্তন তারকা ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড হোসে রামিরেজ ব্যারেটো ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ তাঁৎ কলামে লিখেছেন, “এটিকে মোহনবাগান যে ভাবে ম্যাচটা শুরু করেছিল, তাতে ট্রফি কলকাতায় আসা ছিল সময়ের অপেক্ষা”। এটিকে মোহনবাগান ডিফেন্সের প্রশংসা করে তিনি লেখেন, “তিরি, সন্দেশ, প্রীতমকে মনে হচ্ছিল দুর্ভেদ্য। তিন ডিফেন্ডারে দল সাজিয়ে শুভাশিসকে উইংহাফে তুলে দিয়েছিলেন হাবাস। হুগো বুমৌসকে জায়গা না দেওয়ার জন্যই বোধহয় মিডফিল্ডে ফুটবলার বাড়িয়ে জ্যাম করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তিরির আত্মঘাতীয় গোলই সব ওলোটপালোট করে দেয়”।

বুমৌসকে আটকানো প্রসঙ্গে ব্যারেটো আরও লিখেছেন, “মুম্বইয়ের সেরা ফুটবলার বুমৌসকে নড়তেই দেননি হাবাস। অন্য ম্যাচগুলোতে যে বুমৌসকে দেখেছি, মানে ছোট ছোট পাসে বিপক্ষকে ভেঙে ফেলা, এ দিন কিন্তু সেই বুমৌসকে দেখতে পাইনি। মাঝমাঠে কার্ল ম্যাকহিউ ও লেনি রড্রিগেজ এত প্রেসিং ফুটবল খেলেছে যে, বল ধরে রাখতে পারেনি বুমৌস”।

অতীতের আর এক ফুটবল তারকা ও মোহনবাগানের প্রাক্তন কোচ সুব্রত ভট্টাচার্য স্প্যানিশ কোচ হাবাসের রণনীতির প্রশংসা করে তাঁর কলামে লিখেছেন, “ফাইনালের আগে দু’বার সের্খিও লোবেরার প্রশিক্ষণাধীন মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে খেলেছে হাবাসের দল। তাই তিনি জানতেন এই দল খেলা তৈরি করে গোলকিপার অমরিন্দরের পা থেকে। রক্ষণে, মাঝমাঠে মোর্তাদা ফল, আমেদ জাহুরা দু-তিনটি পাস খেলার পরই সেই বল বাড়ানো হয় আক্রমণ ভাগে। হাবাস শুরু থেকেই বিপক্ষের এই সাপ্লাই লাইন কেটে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন হাই প্রেসিং ফুটবল খেলিয়ে। আর তাতে তিনি পুরোপুরি সফল”।

বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় তাঁর কলামে সুব্রত তাঁর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে লেখেন, “শুরুতে এটিকে মোহনবাগানের রণনীতি ছিল বিপক্ষ খেলা শুরু করার জন্য পাস খেলা শুরু করলেই দু’তিনজন মিলে তাড়া করতে হবে। ৩-৫-২ ছকে নামা রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস, মনবার সিংরা শুরু থেকে পালা করে সেটাই করছিল। দেখা যায়, বিপক্ষের এই এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণের সামনে পড়ে প্রথম থেকেই বারবার বিপর্যস্ত হচ্ছিল মুম্বই রক্ষণ। ১৮ মিনিটে ম্যাচের গোলটা এই রণনীতিরই ফসল”।

হাবাসের কৌশলের প্রশংসা করলেও প্রাক্তন তারকা ডিফেন্ডার মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর মতো এটিকে মোহনবাগান দু’টি গোলই খেয়েছে নিজেদের দোষে। প্রথম গোলটি তারা খায় ২৯ মিনিটের মাথায়। আহমেদ জাহুর পা থেকে একটি লং বল উড়ে যায় এটিকে মোহনবাগানের বক্সের দিকে, বিপিন সিংয়ের উদ্দেশ্যে। বিপিনের সামনে ছিলেন তিরি। তিনি হেড করে বলটি ক্লিয়ার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর মাথার পিছনে লেগে বল গোলের দিকে চলে যায়। গোললাইন থেকে অনেকটা এগিয়ে আসা অরিন্দম গোলের দিকে যাওয়া বলের নাগাল পাননি।

মনোরঞ্জন প্রথম গোলটি নিয়ে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ লিখেছেন, “স্বাভাবিক ভাবেই সবাই আঙুল তুলবে তিরির দিকে। কিন্তু তিরিকে শুধু দোষ দেব না। বরং এই গোলের পিছনে দায়ী আরও দু’জন। প্রথমজন গোলকিপার অরিন্দম। গোললাইন ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছিল। এই আউটিংয়ের কোনও দরকার ছিল না। দ্বিতীয়জন প্রীতম কোটাল। এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার প্রীতম। জাহু ক্রস বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিপিন সিং মাঝখান দিয়ে দৌড়নো শুরু করেছিল। ওই সময় প্রীতমের কভারিং করা উচিত ছিল। অরিন্দম যে এগিয়ে এসেছিল, তিরি তা জানত না। প্রীতম কভারিংয়ে থাকলে তিরির হেড গোলে ঢুকত না”।

দ্বিতীয় গোলের ক্ষেত্রে অরিন্দম একটি লং বল বুক দিয়ে রিসিভ করতে বক্সের বাইরে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু বল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি তিনি। বল নিয়ে বক্সে ঢুকে যান ওগবেচে। ক্ষিপ্র ওগবেচেকে আটকাতে গিয়ে মাঠে লুটিয়ে পড়েন অরিন্দম। সন্দেশ ঝিঙ্গনও তাঁকে বাধা দিতে যান। কিন্তু তাঁকেও বোকা বানিয়ে কাট করে পিছনে, ডানদিকে সরে গিয়ে ওগবেচে প্রায় গোল সাজিয়ে দেন বিপিন সিংয়ের জন্য। এ বারের লিগের একমাত্র হ্যাটট্রিকের নায়ক বিপিন তাঁর কাজটি করতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি। সোজা গোলে শট নেন।

এই গোল প্রসঙ্গে মনোরঞ্জনের মত, “প্রথম গোলের মতো আবার অহেতুক আউটিংয়ের প্রয়োজন ছিল না। দুই ডিফেন্ডার ছিল, যারা সামলে নিতে পারত। আর গোলকিপার একবার বাইরে চলে আসা মানে তাকে যে করেই হোক বল ক্লিয়ার করতেই হবে। অরিন্দম সেটাই পারেনি। ওগবেচে প্রেস করে গোলকিপারের হাত থেকে বলটা ছিনিয়ে নেয়। দুটো ছোট্ট ভুলেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়”।

কলকাতার দুই প্রধানের জার্সি গায়েই খেলা আর এক প্রাক্তন তারকা শ্যাম থাপা অবশ্য হাবাসের রক্ষণাত্মক নীতির সমালোচনা করেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় তিনি লেখেন, “০-১ পিছিয়ে চাপে পড়ে যাওয়া মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে যখন আক্রমণের ঝড় তোলার কথা, তখন ওদের ম্যাচে ফেরার সুযোগ করে দেন স্প্যানিশ কোচ। দেখে অবাক হয়ে যাই যে, এটিকে মোহনবাগানের ছ-সাতজন ফুটবলার রক্ষণে নেমে গিয়ে খেলছে। এ ভাবে বেশি লে ফন্দ্রে, বিপিন সিংদের আটকে রাখা সম্ভব নয়। কারণ, ওরা নিজেদের মধ্যে অসংখ্য পাস খেলছিল। এবং ২৯ মিনিটে আমার আশঙ্কাই সত্যি হয়”।

বার্থোলোমিউ ওগবেচে পরিবর্ত হিসেবে নামার পরে এটিকে মোহনবাগান আরও রক্ষণাত্মক হয়ে যায় বলে মনে করেন থাপা। তিনি লিখেছেন, “(ওগবেচে নামার পরে) বারবার মনে হচ্ছিল যে কোনও মুহূর্তে গোল খেয়ে যেতে পারে হাবাস-বাহিনী। ৯০ মিনিটে ঠিক সেটাই হল”।