আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা শেষ পর্যন্ত করেই দিলেন ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি সুনীল ছেত্রী। আগামী ৬ জুন কলকাতায় দেশের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলতে নামবেন তিনি। বৃহস্পতিবার নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা এক আবেগঘন ভিডিওয় এই সিদ্ধান্তের কথা নিজেই ঘোষণা করেছেন সুনীল।

আগামী ৬ জুন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ফিফা বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে কুয়েতের বিরুদ্ধে নামবে ভারত। সেই ম্যাচই হবে সুনীলের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ। “গত ১৯টা বছর কর্তব্য পালন করা, প্রচুর চাপ নেওয়া ও আনন্দ পাওয়ার মধ্যে দিয়েই কেটে গিয়েছে। দেশের হয়ে যে এত ম্যাচ খেলতে পারব, তা কখনও ভাবিইনি। গত দেড়-দু’মাস ধরে ভাবছি, হয়তো কুয়েতের বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়েই শেষ করব”, নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডলে পোস্ট করা ভিডিওয় বলেছেন সুনীল।

প্রায় দু’দশক ধরে পেশাদার ফুটবল খেলা সুনীল ছেত্রী শুধু যে দেশের ক্লাব ফুটবলে দাপট দেখিয়েছেন, তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক ফুটবলেও মাইলফলক স্থাপন করেছেন। ৩৯ বছর বয়সী সুনীল বিশ্বের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় বর্তমান ফুটবলারদের মধ্যে লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পরেই রয়েছেন, যা আর কোনও ভারতীয় ফুটবলারেরই নেই।

বাইশ বছর আগে মোহনবাগানের হয়ে ক্লাব-ফুটবল জীবন শুরু করেন সুনীল। ফুটবল জীবনের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পর্তুগালের ক্লাব ফুটবলেও খেলতে যান। দেশে ফিরে এসে ইস্টবেঙ্গল, ডেম্পো, মুম্বই সিটি এফসি এবং বর্তমানে বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে খেলেন। বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়েই সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছেন তিনি। দু’বার (২০১৪, ২০১৬) আই লিগ, একবার (২০১৯) আইএসএল, একবার (২০১৮) সুপার কাপ। এমনকী, ২০১৬-য় এএফসি কাপের ফাইনালেও খেলেছেন তিনি।

ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে সেরা তারকা হয়ে ওঠার পাশাপাশি ভারতীয় ফুটবলেও আধিপত্য বিস্তার করেছেন তিনি। ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১২-এ ভারতের নেহরু কাপ জয়ে তাঁর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও ২০১১, ২০১৫ ও ২০২১-এ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়েও তিনি ছিলেন যথেষ্ট কার্যকরী। ২০০৮-এ এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ জিতে ২৭ বছর পর ভারতের প্রথম এএফসি এশিয়ান কাপে অংশ নেওয়ার পিছনেও তাঁর অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল।

২০০৫-এ পাকিস্তানে ভারতের হয়ে প্রথম ম্যাচে প্রথম গোল করার পর থেকে দেড়শো ম্যাচে মোট ৯৪টি গোল করেছেন তিনি। বিশ্বের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোলদাতাদের তালিকায় তাঁর স্থান চার নম্বরে। ২০১১-র সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সাত গোল করে ভারতের খেতাব জয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি। একই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে আইএম বিজয়নের সবচেয়ে বেশি গোল করার (৬) ভারতীয় নজির ভেঙে দিয়ে এত উজ্জ্বল কেরিয়ারের ইঙ্গিত দেন তিনি।

ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবল মিলিয়ে পাঁচশোর বেশি আড়াইশোর বেশি গোল করেছেন সুনীল। অর্থাৎ প্রতি দুই ম্যাচ অন্তর গড়ে একটি করে গোল করেছেন। এমন বর্ণময় ফুটবল জীবনের জন্য ২০২২-এ ফিফা তাঁর সন্মানে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’।

সম্প্রতি ভারতীয় দলের হয়ে খেললেও সেই চেনা সুনীলকে সে ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি বলেছেন, “ভারতীয় দলের অনুশীলনে যখনই নামি, তখনই আমি তা উপভোগ করতে চাই। কুয়েতের বিরুদ্ধে ম্যাচে আমরা চাপে থাকব। কারণ, ওই ম্যাচ থেকে আমাদের তিন পয়েন্ট চাই-ই চাই। পরের রাউন্ডে যেতে গেলে এই ম্যাচে তিন পয়েন্ট জরুরি। কিন্তু অদ্ভূত ভাবে, এই ১৫-২০ দিন আমি কোনও চাপ অনুভব করছি না। কারণ, এটাই আমার শেষ ম্যাচ”।

এই সিদ্ধান্ত যে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পরই নিয়েছেন, তা জানিয়ে সুনীল বলেন, “যখন আমি অবসরের সিদ্ধান্ত নিই, তখন আমার বাবা-মা ও স্ত্রীকে কথাটা প্রথম জানাই। আমার বাবা স্বাভাবিকই ছিলেন। উনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, খুশি হন। কিন্তু এ কথা শুনে আমার মা ও স্ত্রী-র চোখে জল এসে যায়। ওরা কাঁদতে শুরু করে দেয়”।

কথাগুলি বলার সময় সুনীল নিজেই নিজের চোখের জল ধরে রাখার চেষ্টা করেন। বলেন, “তোমরা তো এতদিন ধরে আমাকে বলে আসছ যে, এত ম্যাচ খেলছ, এত চাপ নিতে হচ্ছে। আর আমি যখন অবসরের সিদ্ধান্ত জানালাম, তখন তোমাদের চোখে জল! কেন যে ওদের চোখে জল এসে গিয়েছিল, তা অবশ্য বলতে পারেনি ওরা”।

তবে তিনি যে ক্লান্তির জন্য অবসর নিতে চলেছেন, তা নয়। নিজেই তা স্পষ্ট করে দিয়ে সুনীল বলেন, “আমি ক্লান্ত ছিলাম বা এটা-ওটা হচ্ছিল, তা কিন্তু নয়। যখন আমার মন বলল, যে এটাই আমার শেষ ম্যাচ হওয়া উচিত, তখনই আমি অবসরের সিদ্ধান্ত নিই। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি”।

ভারতের হয়ে খেলতে না পারলে যে খারাপ লাগবে, তাও জানিয়ে সুনীল তাঁর পোস্ট করা ভিডিওয় বলেন, “এর পরে কি আমার খারাপ লাগবে? অবশ্যই লাগবে। ২০ দিন ট্রেনিং করার পর আর আমাকে অনুশীলনে আসতে হবে না, এটা মেনে নিতে কষ্ট হবে। কারণ, আমার ভিতরের বাচ্চাটা কখনওই দেশের হয়ে খেলা বন্ধ করতে চায়নি। তাই অনেক কিছু হওয়ার পরেও দেশের হয়ে খেলার জন্য যেমন লড়াই চালিয়ে গিয়েছে সে ভবিষ্যতেও হয়তো লড়বে। কিন্তু এখন তো অনেক পরিণত হয়েছে। আশা করি, এ বার বুঝবে, এ বার সময় হয়ে গিয়েছে। অনেক হয়েছে, আর নয়”।

আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে সুনীলের অবসরের সিদ্ধান্তে ব্যথিত তাঁর প্রিয় বন্ধু ভারতীয় ক্রিকেট তারকা বিরাট কোহলি সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, “আমার ভাই, তোমার জন্য গর্বিত”। এ ছাড়াও এ দিন সুনীল তাঁৎ ভিডিও পোস করার পর থেকে তাঁর হাজার হাজার ভক্ত ও বিভিন্ন ক্লাব, সংস্থা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। দেশের ফুটবল মহল ভারত অধিনায়কের এই সিদ্ধান্তে শোকাহত।