ডার্বি স্পেশাল: অতীতে কলকাতা ডার্বির আগে-পরে কোচেদের বাগযুদ্ধ, প্রথম পর্ব
প্রাক আইএসএল যুগে এই যুদ্ধ মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর পর্যায়েও পৌঁছেছে। আইএসএলে অতটা আগ্রাসী বাগযুদ্ধ না হলেও ‘কথা-কাটাকাটি’ কম হয়নি।

মোহন-ইস্ট কলকাতা ডার্বি মানে যে শুধু মাঠের দ্বৈরথ, তা নয়। কলকাতার দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের ফুটবল যুদ্ধ প্রতিবার মাঠের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যায় দুই শিবিরের ড্রেসিংরুমেও। ভারতীয় ফুটবলের এই মহারণের আগে পরে শোনা যায় দুই শিবিরের সেনাপতি অর্থাৎ কোচেদের বাগযুদ্ধও। প্রাক আইএসএল যুগে তা মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর পর্যায়েও পৌঁছেছে। আইএসএলে অতটা আগ্রাসী বাগযুদ্ধ না হলেও ‘কথা-কাটাকাটি’ কম হয়নি। কেমন ছিল গত ন’টি কলকাতা ডার্বির এই বাগযুদ্ধ? আজ প্রথম পর্ব।

প্রথম কলকাতা ডার্বি, ২৭ নভেম্বর, ২০২০, ইস্টবেঙ্গল ০-২ মোহনবাগান
ম্যাচের আগে
ইস্টবেঙ্গল কোচ রবি ফাউলার: প্রস্তুতির দিক থেকে আমরা অন্য সব দলের থেকেই হয়তো পিছিয়ে রয়েছি। মোহনবাগান ইতিমধ্যেই একটা ম্যাচ খেলে ফেলেছে। যেখানে আমরা পিছিয়ে। আমাদের এটাই প্রথম ম্যাচ। তাই আমরা মাঠে নেমে কী কী করতে পারি, সেই ধারণা এখন কারও নেই। সেই ধারণাটা তো দেবই। কিন্তু দুর্দান্ত একটা ধারণা সবাইকে দিতে হবে। যেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মতো পারফরম্যান্স দেখাতে পারে আমাদের ছেলেরা।
মোহনবাগান কোচ আন্তোনিও হাবাস: কারা আগে খেলেছে বা কারা প্রথম নামছে, সেটা বড় কথা নয়। কারা কাল ভাল ফুটবল খেলবে, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ওরা আগে খেলেনি বলে সেটা ওদের অসুবিধা হতে পারে আবার আমরা আগে খেলেছি বলে আমাদের সুবিধাও হতে পারে, এই ধারণাটা ভুল। এখানে প্রতিযোগিতার মান এমনই যে, ভাল ফুটবল না খেললে এই লিগে ম্যাচ জেতা কঠিন।
ম্যাচের পর
ফাউলার: হারের পরে কী করে সন্তুষ্ট হব, বলুন? আমরা সপ্তাহ দুয়েক প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলাম। গত বারের আইএসএল চ্যাম্পিয়ন দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই বিপক্ষে খেলেছে। তাও আমরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। বিশেষ করে প্রথমার্ধে”।
হাবাস: প্রথম ৪৫ মিনিট আমরা সেরা জায়গায় ছিলাম না। তবু গোলশূন্য রাখতে পেরেছি। ৯০ মিনিট পরে ফল ২-০। এটাই তো আসল। প্রথম দিকে রক্ষণ বেশি হয়েছে তো পরের দিকে আক্রমণে উঠেছি। ফুটবল তো রক্ষণ ও আক্রমণ নিয়েই হয়। শুধু রক্ষণ বা শুধু আক্রমণ তো আর সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে যে আমরা প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলাম। স্কোরেই সেটা প্রমাণ হয়েছে”।

কলকাতা ডার্বি-২, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, মোহনবাগান ৩-১ ইস্টবেঙ্গল
ম্যাচের আগে
মোহনবাগান কোচ আন্তোনিও হাবাস: ডার্বিতে সর্বোচ্চ স্তরের মানসিকতা প্রয়োজন। আর পাঁচটা ম্যাচের থেকে এটা আলাদা। কারণ, এই ম্যাচে যে কোনও সমস্যার সমাধান অন্য ভাবে করতে হয়। এটা আমাদের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক ম্যাচ। তা ছাড়া পরিস্থিতিও আলাদা। আমাদের লক্ষ্য একই থাকবে, তিন পয়েন্ট পাওয়া। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল যথেষ্ট ভাল দল। তাই এই ম্যাচ জেতা মোটেই সোজা হবে না”।
ইস্টবেঙ্গলের সহকারী কোচ অ্যান্থনি গ্রান্ট: আমরা টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গিয়েছি বলে আমাদের মানসিক শক্তি কমে গিয়েছে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। আমাদের অনেক খেলোয়াড়ই আগে আইএসএলে খেলেনি। কয়েকজন অনেক উন্নতি করেছে। কয়েকজনের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নক আউটের দৌড় থেকে ছিটকে গেলেও আমরা কিন্তু দমে যাইনি। এখানে রোজই কিছু না কিছু শেখা যায়।
ম্যাচের পর
হাবাস: “এই জয়ের জন্য সমর্থকদের অভিনন্দন জানাই। এই জয় ওদের জন্যই। সমর্থকেরা অনেক দূরে রয়েছেন। কিন্তু দূরে থাকলেও ওদের সমর্থন যে রয়েছে আমাদের সঙ্গে, তা জানি। এই ম্যাচটার একটা আলাদা মোটিভেশন আছে। তবে আমাদের কাছে তিন পয়েন্টটাই সবচেয়ে বড় মোটিভেশন। ছেলেরা যাতে এই ম্যাচে বাড়তি আবেগে ভেসে না গিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে দিকটাও খেয়াল রাখতে হয়েছিল”।
গ্রান্ট: “দলের ছেলেরা সেরাটাই দিয়েছে। প্রতিপক্ষকে একটা গোল যদি উপহার দিই, তা হলে কিছু করার নেই। পরের মরশুমেও ওদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই দুটো ম্যাচ খেলব। তখন ওদের হারানোর সুযোগ পাব। ওরা খুব ভাল দল। ওরা যে জায়গায় রয়েছে, তাতেই সেটা প্রমাণ হয়। আগামী মরশুমে আশা করি ওদের হারাতে পারব”।

কলকাতা ডার্বি-৩, ২৭ নভেম্বর, ২০২১, ইস্টবেঙ্গল ০-৩ মোহনবাগান
ম্যাচের আগে
ইস্টবেঙ্গল কোচ হোসে মানুয়েল দিয়াজ: “আন্ডারডগ তকমাটা আমাদের গায়ে সেঁটে দিলেও কোনও অসুবিধা নেই। আমরা আমাদের শক্তি অনুযায়ী খেলব। মোহনবাগান যদিও গত মরশুমে ভাল খেলেছিল এবং ওদের অনেকেই গত কয়েকটি মরশুম ধরে একসঙ্গে খেলছে, তবে আমরা ওদের বিরুদ্ধে নামার জন্য তৈরি”।
মোহনবাগান কোচ আন্তোনিও হাবাস: “ইস্টবেঙ্গল এ বার একেবারে নতুন দল গড়েছে, নতুন কোচ নিয়েছে। এই অবস্থায় থিতু হতে অন্তত এক বছর লেগে যায়। কিন্তু ভারতে সব কিছু খুব দ্রুত তৈরি করে নিতে হয়। এখানে চূড়ান্ত ফলকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই এখানে কেউ এগিয়ে আছে, এ কথা বলা যাবে না। কেন কেউ এগিয়ে থাকবে? আমাদের কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। ম্যাচটা অন্য শহরে হচ্ছে, কোনও সমর্থক থাকবে না। দুই পক্ষের কাছেই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ”।
ম্যাচের পর
দিয়াজ: “আমাদের বিরুদ্ধে খুবই ভাল একটা দল নেমেছিল আজ। প্রতিপক্ষ হিসেবে বেশ কঠিন। যার ফলে পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলা আমাদের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। আমাদের ছেলেরা একাধিক গুরুতর ভুল করেছে। এ রকম দুর্দান্ত ও বিপজ্জনক একটা দলের বিরুদ্ধে এ রকম ভুল করলে তো চলে না। আমরা আমাদের খেলাটা খেলতেই পারিনি”।
হাবাস: “আক্রমণাত্মক ফুটবলের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম আমরা। আমাদের ছেলেরা ৪০ মিনিট পর্যন্ত সেই প্রস্তুতি অনুযায়ী খেলার পরে একটু গা ছাড়া ভাব এসে যায়। যার ফলে ওদেরও গোলের সুযোগ এসে যায়। আমরাও আরও গোলের সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে আজ আর ছেলেদের কিছুই বলব না। ওদের পারফরম্যান্সে আমি খুশি”।

কলকাতা ডার্বি-৪, ২৯ জানুয়ারি, ২০২২, মোহনবাগান ৩-১ ইস্টবেঙ্গল
ম্যাচের আগে
মোহনবাগান কোচ হুয়ান ফেরান্দো: এই ম্যাচে আমাদের লক্ষ্য থাকবে নিজেদের স্টাইলে উন্নতি করা, কিছু জায়গায় উন্নতি করাও লক্ষ্য। এটা আবেগের ম্যাচ ঠিকই। কিন্তু সে জন্য ফোকাস নড়ে যাওয়া চলবে না। ইস্টবেঙ্গল মরশুমের শুরুর দিকে যেমন ছিল, তার চেয়ে এখন অনেক আলাদা। ওরা যে ভাবে এখন বিপক্ষকে চাপে রাখছে, তাতে আমার বিশ্বাস শেষ কয়েকটা ম্যাচ দেখে ওদের সমর্থকেরা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন।
ইস্টবেঙ্গল কোচ মারিও রিভেরা: আমাদের চেয়ে ওরাই সেরা চারের বেশি কাছাকাছি রয়েছে। ওদের তাই জিততেই হবে। সেজন্য ওদের ওপর চাপই বেশি। ডার্বিতে অবশ্য দুই দলের ওপরই চাপ থাকে। জয় আমাদেরও চাই। কিন্তু শুধু ড্র করলে সেরা চারে পৌঁছতে পারবে না ওরা, ম্যাচটা জিততেই হবে। তাই ওরাই বেশি চাপে ভুগবে। আমাদের জেতার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। ডার্বি সব সময়ই ৫০-৫০। কে টেবলের নীচে, কারা ওপরে, সে সব দেখে লাভ হয় না।
ম্যাচের পর

ফেরান্দো: দুর্ভাগ্যবশত আজ আমাদের খেলোয়াড়রা প্রথমার্ধে তরতাজা ছিল না। সব সময় যদি ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয়, শুধু অনুশীলনে যাওয়া ছাড়া আর কোথাও যেতে না পারে, তা হলে এ রকম হবেই। (হ্যাটট্রিকের নায়ক) কিয়ানের জন্য আমি খুশি। ও অনুশীলনে খুবই পরিশ্রম করে, উন্নতিও করেছে অনেক। ম্যাচটা যখন বেশ কঠিন জায়গায় চলে যাচ্ছিল, তখন আমরা সিস্টেম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিই। কিয়ানকে নাম্বার নাইনের মতো ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। ও যে সফল হয়েছে, সে জন্য আমি খুবই খুশি।
রিভেরা: দলের ছেলেদের পারফরম্যান্সে আমি গর্বিত। প্রচুর লড়াই করেছে ওরা। ম্যাচটা আমরা জিততেও পারতাম। যে রকম চেয়েছিলাম, সে রকমই খেলেছে ওরা। শুরুতেই একজন খেলোয়াড়ের চোট হয়ে যাওয়ায় আমরা সমস্যায় পড়ে যাই। ওরা এত দ্রুত গোল করে দিল যে আমরা ঠিকমতো দলে পরিবর্তন এনে সেই অবস্থাটা সামলাতে পারলাম না।