আল্ট্রাজের সঙ্গে নতুন গ্যালারি-সংস্কৃতি গড়ে তোলার কাজে ব্রতী ‘লাল-হলুদ প্রেমিকা’ নন্দিনী
ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান, কোনও দলের সমর্থক হতেই হবে, এমন চাপ তাঁর ছোট থেকে কখনওই ছিল না। বরং পরিবারে বিশ্ব ফুটবল নিয়ে উৎসাহ ছিল অনেক বেশি।

প্রথম দেখায় প্রেম—এ আর নতুন কী? যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, এই প্রথা। কিন্তু প্রথম দেখায় ক্লাব-প্রেম, এর মধ্যে নতুনত্ব আছে বই কি!
এ হল এক লাল-হলুদ সমর্থকের গল্প। ডার্বি ম্যাচ দেখতে বসে মোহনবাগানের সবুজ-মেরুন জার্সির চেয়ে ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ জার্সিই তাঁকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। সেই লাল-হলুদের ঝলসানিই তাঁকে করে তোলে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। তিনি ইস্টবেঙ্গলের আদ্যান্ত সমর্থক নন্দিনী রায়চৌধুরি। যিনি ক্লাবের হয়ে গলা ফাটাতে দেশের বাইরেও গিয়েছিলেন।
বাঙালি হয়ে জন্মানো মানেই হয় তাকে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক হতে হবে, নয় মোহনবাগানের, এটাই প্রথা। এটা বাঙালির মজ্জাগত ব্যাপার। বাংলার ঘরে কোনও শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় থেকেই যে কোনও এক শিবিরের সদস্য হয়ে যায়। তার পরিবার কোনদিক ঘেঁষা, কোন শতাব্দী-প্রাচীন ক্লাবকে সমর্থন করে, মূলত তার ওপরই নির্ভর করে সদ্য জন্মানো শিশুটি ভবিষ্যতে কাদের হবে।
কিন্তু ব্যতিক্রমও কি হয় না? আলবাত হয়। জন্ম ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের পরিবারে, অথচ মাঠে গিয়ে গলা ফাটানোর বেলায় মোহনবাগান অথবা এর ঠিক উল্টোটা, এমনও হয়। কিন্তু নন্দিনীর বেলায় তেমন কিছুই ছিল না। ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান, কোনও দলের সমর্থক হতেই হবে, এমন চাপ তাঁর ছোট থেকে কখনওই ছিল না। বরং পরিবারে বিশ্ব ফুটবল নিয়ে উৎসাহ ছিল অনেক বেশি। কাঁপুনি দিয়ে সেই জ্বর আসত বিশ্বকাপের সময়।
লাল-হলুদেই আকর্ষণ!
সেই গল্প নন্দিনীর মুখ থেকেই শোনা যাক। “আমার গল্পটা খুব সাদামাটা। সাধারণত, আমাদের, বাঙালিদের মধ্যে ছোট থেকে দুই শতাব্দী-প্রাচীন ক্লাবের সমর্থক হয়ে ওঠার চলই বেশি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম ছিল। আমার কাকু ফুটবল খেলতেন। উনিই আমাকে ফুটবলের নিয়মকানুন শিখিয়েছিলেন। বিশেষ করে যখন বিশ্বকাপ হত। ওই সময় তো বাংলার মানুষ ফুটবল-পাগল হয়ে ওঠে। প্রত্যেকেই তাদের পছন্দের দল খুঁজে নিয়ে তাদের সমর্থন করে”, আইেসএলের নিজস্ব ওয়েবসাইট ও অ্যাপ indiansuperleague.com -এর প্রতিনিধির সঙ্গে এক আড্ডায় কথাগুলি বলেন লাল-হলুদের তরুণী সমর্থক।
বিশ্ব ফুটবল-গ্রহের মোহ কাটিয়ে বাংলায় ফিরে আসা নিয়ে তিনি বলেন, “ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখতে দেখতে মোহনবাগানের জার্সির চেয়ে ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ জার্সিকে আমার অনেক বেশি উজ্জ্বল লেগেছিল। ইস্টবেঙ্গল নামটাও আমার বেশি পছন্দের ছিল। ‘বেঙ্গল’ কথাটা যে নামের মধ্যে আছে বাঙালি হিসেবে, সেই নামটাই বেশি মন কাড়ে আমার। তা ছাড়া ক্লাবের ইতিহাস, ঐতিহ্য তো বিশাল। সে সব নিয়েও চর্চা করেছি। সব মিলিয়ে ইস্টবেঙ্গলেকেই বেশি পছন্দ করা শুরু করি এবং সেই থেকেই আমার লাল-হলুদ প্রেম শুরু”।
এখন ‘ফ্যানগিরি’-তে তিনি নিবেদিত প্রাণ। ১০-১২ বছর ধরে ইস্টবেঙ্গলের প্রতি ম্যাচে গ্যালারিতে থাকা, তাদের দুঃসময়ে উৎসাহ জোগানো, সাফল্যে উল্লাসে ফেটে পড়া, মাঠের মধ্যে এবং মাঠের বাইরেও ফুটবলারদের উদ্দেশ্যে স্লোগান দেওয়া এ সবই এখন তাঁর হবি। এই নেশাটা আরও বেড়ে যায়, যখন তিনি ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাজ-এ যোগ দেন। এ দেশের ফুটবলে আল্ট্রাজ সংস্কৃতি শুরু করার পিছনে এই গোষ্ঠীর অবদান যথেষ্ট। মাঠের মধ্যে রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করা, বিভিন্ন উপায়ে প্রিয় ফুটবলারদের উৎসাহ জুগিয়ে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করা, এগুলোতে তাদের জুড়ি মেলা ভার।
— Indian Super League (@IndSuperLeague) June 16, 2025
আল্ট্রাজ বিপ্লবে সক্রিয় ভূমিকা
গ্যালারিতে বসে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সর্বক্ষণ কটূ মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া, তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ার থেকে এগুলো অনেক বেশি ইতিবাচক ও ফলদায়ক। ফুটবল মাঠে সুস্থ সংস্কৃতির ধারা বয়ে আনার পক্ষেও এগুলো অনেক কার্যকরী। সেই কারণেই ভারতীয় ফুটবলে আল্ট্রাজ বিপ্লবের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নন্দিনী সেই বিপ্লবীদেরই একজন হয়ে উঠেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “আল্ট্রাজের আগে আমাদের ফুটবলে গ্যালারিতে তেমন গঠনমূলক কিছুই হত না। তখন রিয়াল মাদ্রিদকে সমর্থন করতাম। ওদের আল্ট্রাজ-দের দেখতাম এবং তখন মনে হত, আমাদের গ্যালারিতেও এমনই হলে কতই না ভাল হত। যখন শুনতাম ডর্টমুন্ড আর লিভারপুলের সমর্থকেরা গাইছে ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’ (চলার পথে তোমরা কখনও একা হবে না), তখন দারুন লাগত। বারবার মনে হত, কলকাতার গ্যালারিতে যদি আমরা প্রতিপক্ষের সমর্থকদের সর্বক্ষণ গালিগালাজ না করে এ ভাবেই প্রিয় দলের জন্য একসাথে গাইতে পারতাম, কত ভাল হত। এই স্বপ্নকেই বাস্তব করে তোলে আল্ট্রাজ”।
আল্ট্রাজ নিয়ে নন্দিনী আরও বলেন, “প্রথমে আমাদের মতো সমান মানসিকতার সমর্থকদের এক ছাতার তলায় নিয়ে আসে আল্ট্রাজ। আমরা আমাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে এসে সেগুলোকে বাস্তবায়িত করে তোলার কাজ শুরু করি। একদিন সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবও হয়ে ওঠে। ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাজ-ই ভারতে প্রথম গ্যালারিতে টিফো টাঙানো শুরু করে। এটাও আমার একটা স্বপ্ন ছিল, যা একদিন সত্যি হয়। এখন আমরা আমাদের মাতৃসম ক্লাবের জন্য গানও গাই। এই জন্যই তো আল্ট্রাজে যোগ দিয়েছিলাম। বরাবরই এ রকম কিছু করার ইচ্ছে ছিল আমার। স্বপ্ন দেখতাম, আমরাও একদিন বিদেশের ফুটবল গ্যালারির মতো হয়ে উঠব”।
আল্ট্রাজে কঠিন অভিযান
তবে আলট্রাজ-দের যাত্রাপথের শুরুটা সহজ ছিল না। প্রথম দিকে তাদের অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। এমনকী, অন্যান্য সমর্থকদেরও নিন্দা-মন্দ শুনতে হয়েছে। কারণ, এই ধরণের সমর্থনের প্রথা কলকাতা ফুটবলের প্রচলিত রীতিনীতির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। কিন্তু অনেক পরিশ্রম করে এবং অনেক ধৈর্য্য ধরে তারা তা বাস্তবে রূপ দিয়েছে। ধীরে ধীরে তাদের আবেগ ও নিষ্ঠা মানুষের প্রশংসা অর্জন করতে শুরু করে এবং অনেকেই তাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতেও শুরু করেছে।
“শুরুতে আমরা সত্যিই অনেক সমালোচনার মুখে পড়েছিলাম। তবে বছরের পর বছর ধরে মানুষ আমাদের কর্মকাণ্ড দেখেছে। মানুষ আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। যখন তারা আমাদের কর্মকাণ্ড দেখতে শুরু করে, যেমন ২০১৭-য় আই-লিগ ম্যাচে আমরা একটি থ্রি-ডি টিফো তৈরি করেছিলাম। আলট্রাজের মতো একটা ফ্যানবেস থাকলে ম্যাচে অনেক কিছুই সম্ভব। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের কাজও তারা অনেক কঠিন করে তুলতে পারে,” বলছিলেন নন্দিনী।
তাঁদের কর্মকাণ্ডকে দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে ক্রমশ বিদেশেও বিস্তৃত করার কাজ শুরু করেছেন নন্দিনীরা। ইস্টবেঙ্গল এফসি সম্প্রতি যখন এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে গ্রুপ পর্বের ম্যাচ খেলতে ভূটান গিয়েছিল, তখন তারাও সেখানে গিয়েছিল প্রিয় দলকে সমর্থন করতে। সেই সফরের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে নন্দিনী বলেন, “আমাদের দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয়, যখন আমাদের ক্লাব ভূটানে যায় এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে খেলতে। তখন আমাদের জনা ৫০-এর একটা দলও সেখানে গিয়েছিলাম। যখন থেকে আমরা এই বিপ্লবে যোগ দিয়েছি, তখন থেকেই আমরা বিদেশ-যাত্রার স্বপ্ন দেখতাম। গত বছর অক্টোবরে, সেই স্বপ্ন সত্যি হয়”।
এখন আর বাধা নেই
নন্দিনীর ধারণা, বাংলার মেয়েরা এখন অনেক বেশি স্টেডিয়ামে যাচ্ছে এবং সক্রিয়ভাবে ক্লাবকে সমর্থন করছে। দু-এক দশক আগেও যেখানে গ্যালারিতে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল খুবই বিরল, এখন পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। মেয়েরা এখন মাঠে এসে খেলা দেখতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং সব বয়সের মেয়েরাই ফ্যান কালচারের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন— যা অবশ্যই এক বড়সড় সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
এই প্রসঙ্গে নন্দিনী রায়চৌধুরীর বক্তব্য “আমি নিজেকে একজন মেয়ে হিসেবে আলাদা করে দেখি না। হ্যাঁ, অবশ্যই তখনকার পরিস্থিতি অন্য রকম ছিল। ২০ বছর আগে স্টেডিয়ামে শুধু পুরুষদের ভিড় থাকত, নারীদের দেখা যেত না, এবং পরিবেশটাও তখন নিরাপদ মনে হত না। আমি যখন বড় হয়ে ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে যেতে শুরু করলাম, তখন থেকে ছবিটা বদলাতে শুরু করে।
“এখন তো মেয়েরা নিয়মিত স্টেডিয়ামে আসে। এখন পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও স্টেডিয়ামে আসে। আমি বলতে চাই, সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে। হ্যাঁ, কিছু মানুষ এখনও দ্বিধায় ভোগে। কারণ, ফুটবল স্টেডিয়ামে গালাগালি, অশ্রাব্য শব্দ ভেসে বেড়ায়। কিন্তু আমি নিজে দেখেছি, ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বাবা-মায়েরাও এখন স্টেডিয়ামে আসেন এবং সবাই একসঙ্গে বসে খেলা উপভোগ করেন। তাই এখন সত্যিই অনেক কিছু বদলে গিয়েছে”।
এক নতুন, ভিন্ন সংস্কৃতি
তাঁর মতে, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও আসছেন খেলা দেখতে। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে খেলা উপভোগ করছেন। এটাই তো ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে ঐক্যের দুর্দান্ত এক প্রতিচ্ছবি। “আমি মনে করি, আমরা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে সবাই নিজেদের এই সংস্কৃতির অংশ বলে মনে করেন। শুধু ছেলে-মেয়েরা নয়, বাবা-মা ও তাদের সন্তানরাও এই সংস্কৃতির মধ্যে থাকার চেষ্টা করে। সংখ্যাটা এতটাই বেড়েছে যে, এখন ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে স্টেডিয়ামে আসে”।
নন্দিনী রায়চৌধুরীর এই কাহিনী ফুটবল আবেগের শৃঙ্গ স্পর্শ করে—যেখানে আছে নিঃস্বার্থ ভালবাসা, অবিচল আনুগত্য ও নিরন্তর একনিষ্ঠতা, যা দলকে অনুপ্রাণিত করে। এই অনুপ্রেরণাই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ব্যর্থতার সমস্ত মেঘ সরিয়ে ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে সাফল্যের উজ্জ্বল দিন দেখাবে।