আইএসএলে কলকাতার ক্লাবে স্মরণীয় অভিষেক হয়েছে যাঁদের
কলকাতার ক্লাবগুলিতে যোগ দিয়ে যেমন একাধিক ভারতীয় ফুটবলারের পারফরম্যান্সে এসেছে আমূল উন্নতি, তেমনই ভারতে পা রেখে প্রথম কলকাতার ক্লাবে সই করেই মন জয় করে নিয়েছেন একাধিক বিদেশি।

ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) এমন এক মঞ্চ, যেখানে প্রতিভা, আকাঙ্ক্ষা ও নিখুঁত ফুটবল দক্ষতা একত্রিত হয়ে উদীয়মান ফুটবলারদের ভবিষ্যতের তারকা গড়ে তোলে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই লিগ বহু নতুন প্রতিভার উদয় দেখেছে, যাঁরা বিভিন্ন ক্লাবে পা রেখেই ঝড় তুলেছে।
তাঁরা প্রায়ই প্রত্যাশার সীমানা পেরিয়ে গিয়েছেন, ট্রফি জয়ের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ফুটবলপ্রেমীদের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। গোলস্কোরিং বিস্ময়, মাঝমাঠের ইঞ্জিন কিংবা রক্ষণভাগের প্রাচীর – আইএসএলে এমন বহু খেলোয়াড় এসেছেন, যাঁদের কাছে নির্দিষ্ট একটি ক্লাব রীতিমতো পয়া হয়ে উঠেছে।
এটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং দলের ভাগ্য পরিবর্তনে তাদের প্রভাবের ব্যাপার। ব্যক্তিগত পুরস্কার জিতুন বা না জিতুন, তাঁরা যেভাবে খেলায় রোমাঞ্চ এনেছেন এবং তাদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মাধ্যমে যে ভাবে সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন, এটাই তাঁদের আসল অবদান।
এই বিশেষ প্রতিবেদনে দেখে নেওয়া যাক এমন কিছু অসাধারণ অভিষেক মরশুম, যা কলকাতার ক্লাবগুলির সমর্থকদের বহুকাল মনে থাকবে।
দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট) ২০২২-২৩
হাই প্রোফাইল সাইনিং হিসেবে কলকাতায় আসা দিমিত্রিয়স পেট্রাটস এখন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কিংবদন্তি। ২০২২-২৩ মরশুমে কঠিন সময়ে ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সমর্থকদের সবচেয়ে প্রিয়, পেট্রাটস শুধুমাত্র একজন ফুটবলার নন – মেরিনারদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন “দিমি-গড”।
ফুটবলের শহরে আগমনের পরই তিনি জোরালো প্রভাব ফেলেন এবং তার সামগ্রিক প্রভাব ছিল অসাধারণ। অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড তাঁর প্রথম মরশুমেই ১২টি গোল ও ৭টি অ্যাসিস্ট করেন, এবং মোহনবাগানের প্রথম আইএসএল কাপ জয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ২০২২-২৩ মরশুমে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতার সন্মানও অর্জন করে নেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত "স্টেনগান" উদযাপন, দুর্দান্ত পরিসংখ্যান, বড় ম্যাচে পারফর্ম করার ক্ষমতা, বিভিন্ন পজিশনে খেলার ক্ষমতা এবং সবুজ-মেরুন বাহিনীর সঙ্গে তাঁর চলমান যাত্রা – সব মিলিয়ে এক রূপকথার মতো গল্প। যা সারা জীবন মনে থাকবে তাঁর ও তাঁর ভক্তদের।
জেসন কামিংস (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট) ২০২৩-২৪
পেট্রাটসের মতোই, জেসন কামিংসও তাঁর অভিষেক মরশুমে যথেষ্ট উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। ধারাবাহিকভাবে গোল করার দক্ষতা এবং প্রতিপক্ষের বক্সে উপস্থিতির জন্য পরিচিত কামিংস, মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের পারফরম্যান্সে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেন।
২০২৩-২৪ মরশুমে তিনি ১২টি গোল করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। দুর্দান্ত গোল স্কোরিং রেকর্ড নিয়ে আসা এই অস্ট্রেলিয়ান আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়, আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের পরিকল্পনায় নিখুঁতভাবে মানিয়ে নেন এবং ক্লাবের প্রথম লিগ শিল্ড জয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ‘আরাম সে’ গোল করা থেকে শুরু করে হাজারো সমর্থকদের মাতিয়ে তোলা – তাঁর ছটফটে চরিত্র মেরিনারদের হৃদয়ে বিশেষ জায়গা করে নেয়।
রয় কৃষ্ণা (এটিকে এফসি) ২০১৯-২০
ফিজিয়ান স্ট্রাইকার রয় কৃষ্ণা আইএসএলের অন্যতম সেরা বিদেশি ফরোয়ার্ড, যিনি তাঁর ক্ষিপ্র গতি, গোল করার দক্ষতা এবং লড়াকু মানসিকতার জন্য বিখ্যাত। তিনি ২০১৯-২০ মরশুমে এটিকে এফসি-র হয়ে খেলতে প্রথম ভারতে আসেন এবং ক্লাবকে লিগ জিততে সাহায্য করেন। ব্যক্তিগত ভাবেও আইএসএলে সে বার দারুণ প্রভাব ফেলেন তিনি। সে বার গোটা মরশুমে ক্লাবের অন্যতম প্রধান গোলদাতা ছিলেন। মোট ১৫ গোল করেছিলেন তিনি। তাঁর গোল স্কোরিং ধারাবাহিকতা এবং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পারফর্ম করার ক্ষমতা তাঁকে সমর্থকদের চোখে কিংবদন্তি বানিয়ে তোলে।
ডেভিড উইলিয়ামস (এটিকে এফসি) ২০১৯-২০
রয় কৃষ্ণার দুর্দান্ত পার্টনার হিসেবে পরিচিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড ডেভিড উইলিয়ামস। তিনি শুধু গোলদাতা নন, বরং খেলার গতি বদলে দেওয়ার মতো ফুটবলারও ছিলেন। তাঁর ড্রিবলিং, পজিশনিং ও অ্যাসিস্ট করার দক্ষতা তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে। ২০১৯-২০-তে ভারতে এসে এটিকে এফসি-র জার্সিতে তিনি একাধিক স্মরণীয় গোল করেন এবং একাধিক মরশুমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, বিশেষ করে প্লে-অফের মত বড় মঞ্চে। আইএসএলে তাঁর প্রথম বছরে ডেভিড সাতটি গোল করেন ও পাঁচটি করান। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে এটিকে ৩-১-এ বেঙ্গালুরু এফসি-কে হারিয়ে যে ফাইনালে ওঠে, তার প্রধান স্থপতি ছিলেন তিনি। তিনটি গোলের মধ্যে দু’টিই করেছিলেন তিনি। ফাইনালে চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে ৩-১ জয়ে একটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন।
মনবীর সিং (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট) ২০২০-২১
ভারতীয় ফরোয়ার্ড মনবীর সিং শক্তিশালী শরীরের গঠন, গতি ও ড্রিবলিং দক্ষতার জন্য পরিচিত। তিনি প্রথমে এফসি গোয়ার হয়ে আইএসএলে নজরে পড়েন এবং পরে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দেন। ২০২০-তে কলকাতার দলে যোগ দেওয়ার পরই তাঁর পারফরম্যান্সে আমূল উন্নতি হয়। এফসি গোয়ার হয়ে তিন মরশুমে যত (৩) গোল করেছিলেন তিনি, শুধু ২০-২১ মরশুমে সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে তার দ্বিগুন, ছ’টি গোল করেন মনবীর। পরের মরশুমেও সমসংখ্যক গোল করেন তিনি। সবুজ-মেরুন বাহিনীতে তিনি মূলত উইঙ্গার হিসেবে খেলে গোল ও অ্যাসিস্ট দুটোতেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
আইএসএলে মোট আটটি মরশুমে ২৬ গোল করেছেন তিনি। ১৯টি গোলে অ্যাসিস্টও করেছেন। যার বেশিরভাগই কলকাতার দলের হয়ে। আইএসএলে তাঁর পারফরম্যান্সের জন্যই মনবীর জাতীয় দলে ডাক পান এবং ক্লাব ও দেশের জার্সিতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে গোল করেছেন। তাঁর উন্নত ফিনিশিং ও অফ দ্য বল মুভমেন্ট তাঁকে ভবিষ্যতের একজন নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
লিস্টন কোলাসো (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট) ২০২১-২২
লিস্টন কোলাসো যে ভারতের সবচেয়ে প্রতিভাবান উইঙ্গারদের অন্যতম, তা তিনি প্রমাণ করেন ২০২১-এ মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দেওয়ার পর। দুর্দান্ত স্পিড, ড্রিবলিং এবং মাপা দূরপাল্লার কার্লিং শট নেওয়ার দক্ষতার জন্য তিনি নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠেন। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হয়ে তিনি বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন গোল করেছেন। কলকাতার ক্লাবে প্রথম মরশুমে, ২০২১-২২-এ তিনি আটটি গোল করেন ও পাঁচটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন। আইএসএলে সেটিই সবুজ-মেরুন বাহিনীর হয়ে প্রথম মরশুম তাঁর এবং লিগে সেটিই ছিল তাঁর সেরা মরশুম।
তার আগের দু’টি মরশুমে তিনি চার গোল করেছিলেন। কিন্তু কলকাতার ক্লাবে অভিষেকেই জ্বলে ওঠেন তিনি। আইএসএলে সব মিলিয়ে ২০টি গোল ও ১৮টি অ্যাসিস্ট রয়েছে তাঁর। তিনি মাঝেমধ্যেই দূর থেকে থান্ডারবোল্ট গোল করে থাকেন এবং তাঁর সৃজনশীলতা দলের আক্রমণকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। লিস্টন ইতিমধ্যে জাতীয় দলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
লেইন হিউম (এটিকে এফসি) ২০১৪-১৫
কানাডিয়ান ফরোয়ার্ড লেইন হিউম ছিলেন আইএসএলের শুরুর দিকের অন্যতম জনপ্রিয় বিদেশি ফুটবলার। তিনি প্রথম বছরেই এটিকে-র হয়ে খেলেন এবং লড়াকু মনোভাব, গোল করার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১৪-য় তিনি পাঁচ গোল করে ও তিনটি অ্যাসিস্ট করে দলের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরের মরশুমে তিনি ১১টি গোল করেন চারটি করান। হিউম ছিলেন এমন এক ফুটবলার, যিনি মাঠে সব সময় নিজের একশো শতাংশ দিতেন এবং তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য ছিলেন অনুপ্রেরণা। তিনি আইএসএলে পাঁচটি মরশুমে খেলে ২৯ গোল করেন ও সাতটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন।