আগামী কয়েক মাস খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে: ইগর স্টিমাচ
“আমাদের কী করতে হবে, আমরা জানি। ম্যাচটা যে রকম কঠিন, সেই অনুযায়ী মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই। ম্যাচের আগে একটা ট্রেনিং সেশন পাব। সুতরাং বাধা-সমস্যা থাকবেই। কিন্তু আমরা জানি আমরা কতটা, কী পারি”।
সামনেই ২০২৬ বিশ্বকাপ ও ২০২৭ এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে ভারতের খেলা কুয়েত ও কাতারের বিরুদ্ধে। এই দুই ম্যাচের আগে ভারতীয় দলের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। সে জন্য দেশের এক নম্বর ফুটবলের আসর ইন্ডিয়ান সুপার লিগও সাময়িক ভাবে স্থগিত। যাতে আইএসএলে খেলা দেশের সেরা ফুটবলার ভারতের হয়ে মাঠে নামতে পারে ও তার আগে প্রস্তুতিও নিতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। জানুয়ারিতে ভারত যখন এশিয়ান কাপে খেলতে নামবে, তখনও একই ভাবে লিগ বন্ধ থাকবে দেশের সেরা ফুটবলাররা যাতে দেশের জার্সি গায়ে নিশ্চিন্তে মাঠে নামতে পারেন।
এশীয় বাছাই পর্বের গ্রুপ ‘এ’-তে রয়েছে ভারত। তাদের প্রথম ম্যাচটি হবে কুয়েত সিটিতে জাবের আল আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। এই ম্যাচের পরে ভারতীয় দল দেশে ফিরে আসবে ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে কাতারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচটি খেলার জন্য। এই দুই ম্যাচের জন্য ভারতীয় দলের প্রস্তুতি শিবির হয়েছে দুবাইয়ে।
এ বারের বাছাই পর্বে ভারতের গ্রুপে তাদের চেয়ে ক্রমতালিকায় ওপরে থাকা একমাত্র দল কাতার। বাকি দু’টি দল ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে নীচে রয়েছে। প্রতি গ্রুপ থেকে দুটি করে দল তৃতীয় রাউন্ডে উঠবে। ফলে ভারতের তৃতীয় রাউন্ডে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। বাছাই পর্বে ভারতের লড়াই শুরু হবে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে যেখানে মোট ৩৬টি দলকে ৯টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। প্রতি গ্রুপে থাকবে চারটি দল। যেমন ‘এ’ গ্রুপে আছে কাতার, কুয়েত, ভারত এবং আফগানিস্তান। প্রতি দল হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে ছ’টি করে ম্যাচ খেলার পর প্রতি গ্রুপের সেরা দু’টি দল পৌঁছবে তৃতীয় রাউন্ডে। ভারত সেরা দুইয়ের মধ্যে থাকতে পারলে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবে।
গতবার ‘ই’ গ্রুপে থাকা ভারত আটটির মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচে জিতেছিল ও চারটিতে ড্র করেছিল। তারা ছিল গ্রুপের তিন নম্বরে। ফলে তৃতীয় রাউন্ডে উঠতে পারেনি। এ বার নভেম্বরের এই দুই ম্যাচের পর আগামী বছর মার্চে (২১ ও ২৬) ভারত টানা দু’বার আফগানিস্তানের মুখোমুখি হবে। জুনে (৬ ও ১১) কুয়েত ও কাতারের সঙ্গে আবার দেখা হবে তাদের। তার আগে জানুয়ারিতে এশিয়ান কাপে আরও কঠিন পরীক্ষা তাদের। খেলতে হবে অস্ট্রেলিয়া, উজবেকিস্তান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে। সেই কঠিন পরীক্ষার আগে বাচাই পর্বের পরীক্ষাও কম কঠিন নয়। অন্তত সেরকমই মনে করছেন ভারতীয় দলের হেড কোচ ইগর স্টিমাচ, যিনি দাভর সুকেরের ক্রোয়েশিয়া দলের হয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছিলেন ১৯৯২-এ।
বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের অভিযান শুরুর আগে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ভারতীয় দলের হেড কোচ, তারই নির্বাচিত কিছু অংশ এখানে তুলে দেওয়া হল, যা ভারতীয় দলের সম্ভাবনা ও দলের ফুটবলারদের সম্পর্কে তাঁর মনোভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
‘সামনে কঠিন সময়’
প্রস্তুতির নতুন পর্বে প্রবেশ করেছি আমরা। এ বার কাজটা দলের ফুটবলারদের কাছে আরও কঠিন হতে চলেছে। আমরা আশাবাদী। আগামী কয়েক মাস, মানে মার্চ পর্যন্ত, আমাদের খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অনেক সমস্যা আসবে। আমি আশাবাদী যে, এখন যারা নেই, তখন তাদেরও পাব এবং সবাই মিলে একটা শক্তিশালী দল তৈরি করতে পারব, সে যাদের বিরুদ্ধেই খেলি না কেন। প্রথম এগারোয় যারা এখন নেই, যেমন আশিক কুরুনিয়ান, আনোয়ার আলি, জিকসন সিং, তারা আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ওরা দলকে বাড়তি শক্তি জুগিয়েছে। আমাদের এ বার নতুন করে একটা ভারসাম্যযুক্ত এবং শক্তিশালী দল তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে রক্ষণে। ইদানীং আমরা অনেক গোল খেয়েছি। যদিও কয়েকটা গোল খেয়েছি রেফারিদের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে। তবে আমি খুশি যে আমাদের ছেলেরা নিয়মিত আইএসএলে খেলছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করছে। এটা জাতীয় দলের পক্ষে ভাল।
‘বাছাই পর্বে কঠিন গ্রুপ’
আমাদের গ্রুপে (বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে) কোনও সহজ প্রতিপক্ষ নেই। প্রত্যেকেই সেরা দল। তবে আমাদের প্রতি ম্যাচ ধরে ধরে এগোতে হবে। আমার যা অভিজ্ঞতা, তাতে বলতে পারি নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কঠিন সময় যাবে। আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে আমরা গ্রুপে অন্তত দ্বিতীয় স্থানে থেকে পরবর্তী রাউন্ডে উঠতে পারি।
ম্যাচের আগে প্রস্তুতি
কুয়েতের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে কয়েক দিনের প্রস্তুতি শিবির করার প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। এটা আমরা অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। কুয়েতের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ বলেই আরও বেশি দরকার ছিল এটার। আমাদের কী করতে হবে আমরা জানি। ম্যাচটা যে রকম কঠিন, সেই অনুযায়ী মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই। ম্যাচের আগে একটা ট্রেনিং সেশন পাব। সুতরাং বাধা-সমস্যা থাকবেই। কিন্তু আমরা জানি আমরা কতটা, কী পারি। আমরা জানি কী ভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হয়। তবে আমাদের মনসংযোগ বজায় রাখতে হবে।
প্রতিপক্ষ কুয়েত
ওরা খুবই ভাল দল। তার প্রমাণ আমরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে পেয়েছি। ফিফা ক্রমতালিকায় ওদের অবস্থান কিন্তু ওদের আসল চেহারার প্রতিফলন নয়। সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর বিরুদ্ধে ম্যাচের পর বোঝা গিয়েছে, ওরা যে কোনও দলকে হারাতে পারে। তাই আমাদের মনসংযোগ বজায় রাখতে হবে। আসল প্রশ্নটা হল আমাদের ছেলেরা কতটা আন্তর্জাতিক মোডে নিজেদের নিয়ে যেতে পারবে। তবে এই মাসে আমাদের হাতে অনেক সময় আছে ঘরোয়া থেকে আন্তর্জাতিক মোডে যাওয়ার, ঠিক কী করতে হবে তাদের, সেই সম্পর্কে জানার। এবং আমরা তাদের সাহায্য করতে তৈরি।
ঘরের মাঠ ও বাইরের মাঠ
ঘরের মাঠের তুলনায় বিদেশের মাঠে আমাদের পারফরম্যান্স ভাল হয়নি ঠিকই। কিন্তু গত দুই টুর্নামেন্টেই আমরা রেফারির ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছি। ইরাকের বিরুদ্ধে আমাদের খেলায় কিছু গলদ ছিল। তবে ছেলেরা খুবই ভাল খেলেছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি। দুবার আমরা এগিয়ে গিয়েছি। তারপরই রেফারির ভুল সিদ্ধান্ত, যা আমাদের পেনাল্টি শুট আউটে নিয়ে যায়। ইরাক ও মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে রেপারিদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ক্রমতালিকায় আমরা সাত-আট ধাপ পিছনে চলে গেলাম। এ তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সে জন্যই সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে অনুরোধ করি যে, যত বেশি সম্ভব হোম ম্যাচ আয়োজন করুন।
নাওরেম মহেশ সিং প্রসঙ্গে
ও নিজের ফুটবলকে খুব উপভোগ করে। ওর জন্য আমি খুশি। মহেশ খুবই প্রতিভাবান। গেলকিপারের সামনে গিয়ে ঘাবড়ে যায় না বা অন্য কোনও সমস্যায় পড়ে না। প্রতিপক্ষের গোলের সামনে ওর সহজ ও স্বাভাবিক থাকার গুণ দলকে বাড়তি শক্তি জোগায়। মহেশের মতো ফুটবলরাই চাই আমাদের। যাতে সামগ্রিক ভাবে দলের পাসিং, বল ধরে রাখার, সুযোগ তৈরি করার এবং গোলের পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষতা আরও বাড়ে।
গতবার এবং এ বারের বাছাই পর্ব
গতবার যখন আমরা বাছাই পর্বে খেলা শুরু করেছিলাম, তখন আমরা দল তৈরির প্রক্রিয়াটা সবে শুরু করেছি। একাধিক নতুন খেলোয়াড়কে নিয়ে নতুন করে দলের উন্নতি করা সবে শুরু করেছিলাম। তখনকার সেই একঝাঁক খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকে ১৫ জনকে বেছে নিয়ে যে দলটা তৈরি হয়েছে, সেটাই এখন খেলছে। এখন আমাদের দল যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রত্যেকেই পরীক্ষিত খেলোয়াড়, যারা প্রথম এগারোয় থাকতেই পারে। এ ছাড়াও তাদের মতোই আরও ১৩ জন রয়েছে, যারা রিজার্ভ বেঞ্চে থাকে। প্রস্তুতির দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই পর্বে চোট-আঘাত সমস্যা রয়েছে। কয়েক মাস আগেও আমাদের একটা নির্দিষ্ট দল ছিল। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে তিনজনকে আমরা পাচ্ছি না।
জিকসনের স্থিতিশীল ফর্ম, আক্রমণ তৈরিতে ওর অবদান ও সামনের খেলোয়াড়দের কভার করার যে দক্ষতা ওর আছে, তার ফলে ও দলের এক স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এখন ওর সামনে জাতীয় দলে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। ফিরে এসে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ। আশা করি, যে ওর জায়গায় খেলবে, সে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মাঠে নামবে এবং দলকে বাড়তি শক্তি জোগাবে।
আত্মবিশ্বাসী, বাস্তবাদী কোচ
আমি সব সময়ই আত্মবিশ্বাসী থাকি। একজন কোচের কাছে এ ছাড়া কোনও উপায়ও নেই। তবে আমি বাস্তববাদীও। কোন কোন জায়গায় আমাদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে এবং কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, তা খুঁজে খুঁজে বার করি আমি। কারণ, দলের সবারই জানা দরকার কতটা কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে আমাদের। এটাই সেরা উপায়। বাস্তববাদী হও, কিন্তু ইতিবাচকও হও, সব সময়। আমরা ম্যাচ জেতার জন্য অল আউট যাব। এটা সত্যিই হবে কি না জানি না। কিন্তু সেই প্রবণতা অবশ্যই থাকবে। কাতারের বিরুদ্ধেও একই প্রবণতা থাকবে। কাতারের বিরুদ্ধে ঘরের বিরুদ্ধে জিততে হবে আমাদের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, যারা দেশের হয়ে খেলতে নামবে, তারা যেন মাঠে সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে দেয়।













