দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত জয়! দু-এক বছর আগে হলেও এমনটা হওয়ার কথা ভাবতে পারতেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা? বোধহয় না। কিন্তু এখন ভাবতে পারছেন। এমন অসাধ্য সাধন করার কথা ভাবতে যিনি সাহায্য করেছেন তাঁদের, তাঁর নাম কার্লস কুয়াদ্রাত।

ইস্টবেঙ্গলে তাঁর যোগ দেওয়ার খবর শুনে ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার ক্লেটন সিলভা মন্তব্য করেছিলেন, “কুয়াদ্রাতের যা অভিজ্ঞতা, তাতে ইস্টবেঙ্গল এফসি খুবই লাভবান হবে। ভারতে উনি যথেষ্ট সফল। আর এখানকার ফুটবল সম্পর্কে ওঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোচের এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে”।

সত্যিই কতটা কাজে লাগছে তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা, তা তো এখন চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। মঙ্গলবার দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও শেষ কুড়ি মিনিটে দু’গোল দিয়ে যে ভাবে সমতা এনে এবং পেনাল্টি শুট আউটে ম্যাচ জিতে নিল ইস্টবেঙ্গল এফসি, তা ঐতিহ্যবাহী ডুরান্ড কাপের ইতিহাসে বিরল। ডুরান্ড সেমিফাইনালে এই অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে লাল-হলুদ বাহিনীর নাম লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে।

নির্ধারিত সময়ে ২-২ থাকার পরে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কে টাইব্রেকারে ৫-৩-এ হারিয়ে ১৯ বছর পরে ডুরান্ডের ফাইনালে উঠল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। যা গত তিন বছর ধরে দেখতে পায়নি লাল-হলুদ জনতা। অনেকেরই প্রশ্ন কী এমন হল, কী এমন করলেন কুয়াদ্রাত, যার ছোঁয়ায় এমন ম্যাজিকের মতো জেগে উঠল গোটা দলটা?

ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বয়ং কোচ কুয়াদ্রাতই, ২০১৮-য় প্রধান কোচ হিসেবে বেঙ্গালুরু এফসি-র দায়িত্ব নিয়ে যিনি প্রথম মরশুমেই (২০১৮-১৯) দলকে প্রথম হিরো আইএসএল চ্যাম্পিয়ন করেন। সেই তিনিই মঙ্গলবার ম্যাচের পর বলেন, “আমাদের দলের ছেলেদের হার না মানার জেদই তাদের উজ্জীবিত করেছে। এই প্রথম আমরা কোনও ম্যাচে পিছিয়ে যাই। কিন্তু ছেলেরা প্রমাণ করেছে ওদের হার না মানা মানসিকতা কতটা অদম্য। নিজেদের ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেছি আমরা”।

৭৫ মিনিট পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে রীতিমতো দমিয়ে রেখে দু’গোলে এগিয়ে ছিল নর্থইস্ট ইউনাইটেড। ম্যাচের বেশিরভাগ সময়ে আগোছালো ও দিশাহীন ফুটবল খেলা ইস্টবেঙ্গল শেষ দশ মিনিটে আক্রমণের ঝড় তোলে এবং ৭৭ মিনিটের মাথায় মহেশ সিংয়ের শট দীনেশ সিংয়ের পায়ে লেগে গোলে ঢুকে যায়। আট মিনিটের বাড়তি সময়ের একেবারে শেষে, ৯৭ মিনিটের মাথায় হেডে সমতা এনে ফেলেন মরশুমের প্রথম কলকাতা ডার্বির নায়ক নন্দকুমার শেখর। এর পর টাইব্রেকার, পার্থিব গগৈয়ের মিস্ এবং লাল-হলুদ বাহিনীর জয়।

দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও জেতা, তাও আবার নর্থইস্ট ইউনাইটেডের মতো উজ্জীবিত, ফর্মে থাকা দলের বিরুদ্ধে! কীভাবে সম্ভব হল? এই প্রশ্নেরও উত্তর আছে স্প্যানিশ কোচের কাছে। “ফুটবল খুব কম ব্যবধানের খেলা। আমরা ২-১ করার পরে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার জন্য সিস্টেম বদলে ৩-৫-২-এ চলে আসি। শেষ যে ফ্রি কিকটা পাই, তা থেকেই সমতা আনি। এর আগেও আমি আপনাদের বলেছি, আমরা এমন একটা দল হতে চাই, যাদের হারানো কঠিন। এখন পর্যন্ত পাঁচটা ম্যাচ খেলেছি আমরা। তিনটে ম্যাচে কম ব্যবধানে জিতেছি এবং দুটো ড্র করেছি। ফুটবলারদের হার না মানার মানসিকতা না থাকলে এ সম্ভব নয়”, বলেন কুয়াদ্রাত।

এই ম্যাচে দু’টি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামিয়েছিলেন কুয়াদ্রাত। হুয়ান পার্দো ও মন্দার রাও দেশাইকে রেখেছিলেন প্রথম এগারোয়। বিরতির পর আক্রমণে তীব্রতা বাড়ানোর জন্য বোরহা হেরেরা ও শৌভিক চক্রবর্তীকে নামান তিনি। এই কৌশলী সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত কাজে লেগে যায়। কোচ বলেন, “এই ধরনের ম্যাচে একটা গোল শোধ করার পরই আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। ০-২-এ পিছিয়ে যাওয়ার পর একটু নতুন কিছু করার চেষ্টা করি। ক্লেটন সিলভা ও হাভিয়ে সিভেরিওর একটা জুটি গড়ে তুলি। ক্লেটন পুরো ফিট ছিল না। তবু ওকে নামানোর ঝুঁকি নিই এবং সমতাও এনে ফেলতে পারি”।

এ বার তো তাঁদের সামনে ফাইনালে, সেখানে প্রতিপক্ষ হবে হয় মোহনবাগান, নয় এফসি গোয়া। বৃহস্পতিবার সেই ম্যাচ কলকাতায়। যে ভাবে হারা ম্যাচ নিজেদের দিকে নিয়ে চলে এসেছে, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই মোহনবাগানের ওপর চাপ অনেক বেড়ে গিয়েছে। প্রত্যাশার চাপ। চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্লাব অসাধ্য সাধন করে যেখানে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছে, তখন তাদেরও ফাইনালে উঠতে হবে, সমর্থকদের এমন প্রত্যাশা থাকবেই।

এই প্রসঙ্গে লাল-হলুদ কোচ বলছেন, “১৯ বছর পর এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠায় ক্লাবের জন্য আমি খুশি। এত বছর পরে ফাইনালে উঠতে পেরে সত্যিই দারুন লাগছে। এ বার আমাদের বিশ্রাম নিয়ে ফাইনালের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে”। বৃহস্পতিবার সেমিফাইনালে মোহনবাগান এসজি জিততে পারলে রবিবার খেতাবী লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে দুই প্রধান। অর্থাৎ আবার একটা ডার্বি।

ষোলো বার করে ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুই ক্লাবই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে দুই প্রধান মুখোমুখি হয়েছে এগারোবার। পাঁচবার জিতেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী ও চারবার লাল-হলুদ ব্রিগেড। দু’বার অমীমাংসিত ভাবে ফাইনাল শেষ হওয়ায় যুগ্মজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয় দুই দলকেই। এ বার ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দীদের হারাবার সুযোগ ইস্টবেঙ্গল পাবে কি না, তা বোঝা যাবে বৃহস্পতিবারই।