যে পরিকল্পনা নিয়ে সিরিয়ার বিরুদ্ধে এএফসি এশিয়ান কাপের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ খেলতে নেমেছিল তাঁর দল, সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি বলেই হার দিয়ে প্রতিযোগিতা শেষ করতে হল ভারতকে। মঙ্গলবার কাতারে সিরিয়ার কাছে ০-১-এ হারের পর এমনই ব্যাখ্যা দিলেন ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ।

মঙ্গলবারের এই হারের পর অনেক আশা জাগিয়ে কাতারে যাওয়া ভারতকে খালি হাতেই দেশে ফিরতে হচ্ছে। শুধু জয়হীন নয়, এই টুর্নামেন্টে ভারত কোনও গোলও করতে পারেনি। ম্যাচের পর আল খোরের আল বায়েত স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ক্রোয়েশিয়ার কোচ বলেন, “আজ আমাদের পরিকল্পনা ছিল গোল না খেয়ে ম্যাচটাকে ৬০ মিনিট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া ও শেষ ৩০ মিনিটে পরিবর্ত খেলোয়াড়দের নামিয়ে ইতিবাচক কিছু পাওয়া। কিন্তু সেটা হয়নি”।

এ দিন ৭৬ মিনিট পর্যন্ত খেলার ফল গোলশূন্য থাকার পর জয়সূচক গোলটি করেন সিরিয়ার ২৯ বথর বয়সী ফরোয়ার্ড ওমর খ্রবিন। সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর ক্লাব আল ওয়াহদায় খেলা এই ফুটবলার বক্সের বাঁ দিক থেকে হেসারের ক্রসে বল পেয়ে গোলে শট নেন, যা ভারতের গোলকিপার গুরপ্রীত সিং সান্ধুর ডানদিক দিয়ে মাটি ঘেঁষে জালে জড়িয়ে যায়।

এ দিন ম্যাচের ৬০ মিনিটের পর রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামেন সুরেশ ওয়াংজাম, সহাল আব্দুল সামাদ ও অনিরুদ্ধ থাপা। কিন্তু যে উদ্দেস্যে তাঁদের নামানো হয়, সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেননি তাঁরা। ডাগ আউট থেকে নামা একমাত্র উদান্ত সিংয়ের প্রশংসা করেন কোচ। বলেন, “একমাত্র উদান্ত এই সময় নেমে ভাল কিছু করতে পেরেছে। বাকিরা তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এতেই আমরা শেষ হয়ে যাই”। বিরতির পরই নাওরেম মহেশ সিংয়ের জায়গায় উদান্তকে নামান স্টিমাচ।

এই প্রথম এএফসি এশিয়ান কাপের মূলপর্বে কোনও গোল করতে পারল না ভারত। ২০১১-য় তিন গোল করেছিল ভারতীয় দল। ২০১৯-এ চার গোল করেছিল। কিন্তু এ বার সুনীল ছেত্রীদের গোলের সংখ্যা শূন্য। ২০১৯-এ একটি ম্যাচে জেতে তারা। চারটি গোল দিয়ে চারটি গোল খায়। গোল পার্থক্য ছিল শূন্য। ২০১১-য় গোলপার্থক্য ছিল -১০। সেবার ১৩ গোল খেয়েছিল তারা। কোনও ম্যাচ জিততে পারেনি। কিন্তু এ বার এক ঝাঁক গোলের সুযোগ তৈরি করা সত্ত্বেও একটিও গোল করতে না পারায় ভারতীয় ফুটবলে এক নতুন সমস্যা উঠে এল।

গোল করার দক্ষতার অভাবের কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়ে ভারতের কোচ স্টিমাচ বলেন, “এই টুর্নামেন্টে আমরা অনেক কিছু শিখলাম। তিনটে ম্যাচে আমরা প্রমাণ করেছি আমরা এই স্তরের প্রতিযোগিতায় ভাল খেলতে পারি। শুধু একটা জায়গায় আমাদের খামতি থেকে গিয়েছে, তা হল গোল করার দক্ষতা। প্রতিপক্ষের গোলের সামনে আত্মবিশ্বাসের অভাব। ফাইনাল থার্ডে সিরিয়া আমাদের চেয়ে অনেক মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলেছে। এ জন্যই ওরা জিতেছে। আশা করি, এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাদের পরের এশিয়ান কাপে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।”

কিন্তু সারা টুর্নামেন্টে কেন একটিও গোল করতে পারলেন না তাঁর দলের ফুটবলাররা? এই প্রশ্নের উত্তরে স্টিমাচ বলেন, “দল কিন্তু যথেষ্ট গোলের সুযোগ তৈরি করেছে। আমরা জানি আমাদের ছেলেরা কেন আন্তর্জাতিক স্তরে গোল করতে পারছে না। ভারতের ফুটবলাররা যখন আরও বেশি করে সেন্টার ফরোয়ার্ডের জায়গায় খেলবে, তখন তারা আরও বেশি গোল করতে পারবে”।

এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “আমাদের দল যে অস্ট্রেলিয়া, উজবেকিস্তান, সিরিয়ার মতো উচ্চ মানের দলের বিরুদ্ধে গোলের সুযোগ তৈরি করতে পেরেছে, এটাই আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এ বার আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে। সামনে আমাদের বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব আছে। সে দিকে মনোনিবেশ করতে হবে”।

মঙ্গলবারের ম্যাচে দলের রক্ষণের প্রশংসা করে কোচ বলেন, “ঝিঙ্গন বেরিয়ে যাওয়ার পরও আমাদের রক্ষণ দুর্বল হয়ে পড়েনি। কারণ, (রাহুল) ভেকে ও শুভাশিস (বোস) আজ যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেছে। খেলার শুরুতেই ভেকে কার্ড দেখায় ওর পক্ষে কাজটা কঠিন হয়ে যায়। তবু ও যতটা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলেছে, তা খুশি হওয়ার মতোই। ঝিঙ্গনকে ছাড়াও ওরা ভালভাবেই সব কিছু সামলেছে”।

রেফারিরও সমালোচনা করে প্রাক্তন বিশ্বকাপার বলেন, “আমাদের প্রতি রেফারি আজ একটু বেশিই নির্দয় ছিলেন। আমাদের ফুটবলারদের অকারণ কার্ড দেখানো হয়েছে। অথচ আমাদের খেলোয়াড়কে বল ছাড়াই আঘাত করেও ওরা পার পেয়ে গিয়েছে, লাল কার্ড দেখানো হয়নি। কিছু রেফারি অনেক স্বাধীনতা দেন, কড়া ট্যাকল করলেও খেলা চালিয়ে যান। আবার কিছু রেফারি একটু এদিক ওদিক হলেই বাঁশি বাজিয়ে দেন, কার্ড দেখান। এই নিয়মগুলো নির্দিষ্ট হওয়ার দরকার”।

সামনে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচ। ভারতের গ্রুপে কাতার ও কুয়েত ছাড়াও রয়েছে আফগানিস্তান। ভারতের গ্রুপে তাদের চেয়ে ক্রমতালিকায় ওপরে থাকা একমাত্র দল কাতার। বাকি দু’টি দল ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে নীচে। প্রতি গ্রুপ থেকে দুটি করে দল তৃতীয় রাউন্ডে উঠবে। ফলে ভারতের তৃতীয় রাউন্ডে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ রকম হলে ভারতীয় ফুটবলে বেনজির ঘটনা ঘটবে। গত বিশ্বকাপ ও আসন্ন এশিয়ান কাপের আয়োজক কাতার এখন বিশ্ব ক্রমতালিকায় ৬১ নম্বরে রয়েছে। ভারত রয়েছে ১০২ নম্বরে। কুয়েত ১৩৬-এ এবং আফগানিস্তান ১৬০ নম্বরে রয়েছে।

গত নভেম্বরে কুয়েতের মাঠে রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে কুয়েতকেই হারিয়ে বাছাই পর্বের অভিযান শুরু করে ভারত। শুরুতেই ১-০-য় জিতে প্রথম ম্যাচেই তিন পয়েন্ট অর্জন করে তারা। তবে তার সপ্তাহ খানেক পর ঘরের মাঠে কাতারের বিরুদ্ধে কোনও ইতিবাচক ফল পায়নি ভারত। বিশ্বের ৬১ নম্বর ফুটবলখেলিয়ে দেশের কাছে সুনীল ছেত্রীরা হারেন ০-৩-এ। মার্চে ভারত হোম ও অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলবে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। এরপর জুনে কুয়েতের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে খেলার পর কাতারে যাবে ভারতীয় দল।

এ বার সেই চ্যালেঞ্জের দিকে তাকিয়ে আত্মবিশ্বাসী স্টিমাচ বলেন, “আগামী ১২ মাসে আমি ভারতকে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ডে নিয়ে যাব, সেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমি তো জাদুকর নই। আমি একজন পরিশ্রমী ফুটবলকর্মী, যে সবাইকে ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ করে। ফুটবলে রাতরাতি কোনও উন্নতি সম্ভব না। বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ডে ওঠার পর দেশের ফুটবলে উন্নতির গতি বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ চাই, ফুটবল অ্যাকাডেমিগুলোয় বিদেশি কোচ আনতে হবে। শিশু, কিশোর ফুটবলারদের জন্য আরও প্রতিযোগিতা চালু করতে হবে”।

এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “অনূর্ধ্ব ১৮, ২০, ২৩ এশিয়ান কাপের মূলপর্বে আমরা কোনও দিনই যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। তা হলে সিনিয়র এশিয়ান কাপেই বা কী করে ভাল ফল আশা করব? ক্রমোন্নতি, কোচিং, ভাল পরিকাঠোমোয় বিনিয়োগ, দূরপাল্লার পরিকল্পনা এগুলো আমদের ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই জরুরি। এগুলো না করলে আর চলবে না”।