লিগের প্রথম ম্যাচে যে ভাবে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে চাপে রেখেছিল তারা, মঙ্গলবার তাদের দ্বিতীয় মুখোমুখিতেও সে ভাবেই সবুজ-মেরুন বাহিনীকে চাপে রাখল চেন্নাইন এফসি। সেবার খেলার শেষ দিকে জেসন কামিংসের গোলে বাগান-বাহিনী জিতলেও এ বার কিন্তু তারা কোনও গোল করতে দিল না কামিংসদের। ম্যাচ গোলশূন্য রেখে ঘরের মাঠ ছাড়ে আওয়েন কোইলের দল। ফলে পরপর দুই ম্যাচে চার পয়েন্ট খোয়াল গতবারের শিল্ডজয়ীরা, যা লিগের শেষ পর্যায়ে তাদের চাপে ফেলতে পারে। চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে আইএসএলে কখনও লিগ ডাবল করতে পারেনি মোহনবাগান। এ বারও সেই নজির অক্ষত রইল।

টানা তিন ম্যাচে ড্র করে পয়েন্ট টেবলের দশ নম্বরেই রয়ে গেল চেন্নাইন এফসি। এগারো নম্বরে থাকা ইস্টবেঙ্গল শুক্রবার তাদের পরের ম্যাচে কেরালা ব্লাস্টার্সকে হারাতে পারলে চাপে পড়ে যাবেন প্রীতম কোটালরা। তিনি চেন্নাইয়ের দলে যোগ দেওয়ায় যে চেন্নাইন রক্ষণে শক্তি বেড়েছে, তা এ দিনের ম্যাচেই বোঝা যায়। তবে সবুজ-মেরুন বাহিনী যে তাদের সেরা ছন্দে ছিল না, ক্লান্তির ছাপ ছিল তাদের পারফরম্যান্সে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

সারা ম্যাচে আটটি গোলের সুযোগ তৈরি করে মোহনবাগান ও ছ’টি চেন্নাইন এফসি। প্রতিপক্ষের বক্সে চেন্নাইন ১৩ বার বল ধরে ও ১৫বার বল ধরে বাগান-বাহিনী। ফাইনাল থার্ডে পেট্রাটসরা যেখানে ৬১বার প্রবেশ করেন, সেখানে উইলমার জর্ডনরা ৪৭বার ঢোকেন। এই পরিসংখ্যানগুলি থেকেই বোঝাই যাচ্ছে, কোনও দলই এ দিন তেমন আক্রমণের মেজাজে ছিল না। চেন্নাইন নিজেদের রক্ষণের সমস্যা দূর করতে ব্যস্ত ছিল। মোহনবাগান তাদের দ্বিতীয় সারির আক্রমণ কতটা সফল হতে পারে, সেই গবেষণায় ব্যস্ত ছিল।

প্রথম দলের দুই নিয়মিত উইঙ্গার লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংকে বিশ্রাম দেওয়ায় বোধহয় এই ছন্দপতন হল বাগান-বাহিনীর। সুহেল ভাট, অভিষেক সূর্যবংশীরা প্রথম দলে খেলার মতো জায়গায় এসেছেন কিনা, তা বোধহয় এ দিন পরখ করতে চেয়েছিলেন তাদের কোচ হোসে মোলিনা। কিন্তু সেই তাঁর সেই পরীক্ষা সফল হয়নি। ফর্মে থাকা ফরোয়ার্ড জেমি ম্যাকলারেনকেও ও দিন রিজার্ভ বেঞ্চে রেখে দেন বাগান-কোচ। নামান পেট্রাটসকে। জেসন কামিংসের জায়গায় শুরু থেকে নামেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তগুলিও ক্লিক করেনি এ দিন।

যদিও লিগ টেবলে এখনও তারা শীর্ষে এবং দু’নম্বর দল এফসি গোয়ার চেয়ে সাত পয়েন্ট এগিয়ে। তবে তাদের চেয়ে একটি ম্যাচ কম খেলেছে। তবে শনিবার এই চেন্নাইন এফসি-কেই তারা ঘরের মাঠে হারাতে পারলে ব্যবধানটা কমে দাঁড়াবে চার। তবে চেন্নাইন এফসি যে রকম ক্রমশ উন্নতি করছে এবং প্রীতমকে নিয়ে এসে রক্ষণেও যথেষ্ট উন্নতি করেছে, তাতে এফসি গোয়ার কাজ তারা কঠিন করে তুলতে পারে এবং নিশ্চয়ই সেটাই চাইবে মোহনবাগান এসজি।

পাঁচ দিনে দু’টি ম্যাচ খেলতে হচ্ছে বলে এ দিন দলের আক্রমণ বিভাগে ঢালাও পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামান মোহনবাগান কোচ হোসে মোলিনা। ম্যাকলারেন, কামিংসকে বিশ্রাম দিয়ে স্টুয়ার্ট, পেট্রাটসকে নামান তিনি। দুই উইঙ্গার লিস্টন ও মনবীরের জায়গায় আনেন দুই অনিয়মিত সদস্য অভিষেক সূর্যবংশী ও সুহেল ভাটকে। মাঝমাঠকে দু’ভাগে ভেঙে খেলান মোলিনা। যার ফলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছেই ছিল। ........

চেন্নাইয়ের মাঠে খেলাটা হলেও ম্যাচের প্রথম আধ ঘণ্টায় কলকাতার দলের আধিপত্যই ছিল বেশি। প্রায় ৭৭ শতাংশ বল ছিল তাদের দখলে। চেন্নাইনের চেয়ে প্রায় চার গুন বেশি পাস খেলে তারা। তবে কোনও পক্ষই বেশি শট নিতে পারেনি। প্রথমার্ধে মোহনবাগান যেখানে দু’টি শট গোলে রাখে, সেখানে চেন্নাইনের একটি শট ছিল লক্ষ্যে।

মোহনবাগানের তিন প্রাক্তনী প্রীতম কোটাল, কিয়ান নাসিরি ও লালরিনলিয়ানা হ্নামতেকে খেলিয়েও লিগ টেবলের শীর্ষে থাকা দলকে সে ভাবে কাবু করতে পারেনি চেন্নাইন। প্রথম মিনিটেই উইলমার জর্ডনের গোলমুখী শট বিশাল কয়েথ বাঁচালেও তার পর থেকে আধ ঘণ্টা উল্টে তারাই চাপে ছিল।

ম্যাচের ১৫ মিনিটের মাথায় দীপক টাঙরি ও ২৭ মিনিটের মাথায় অভিষেক সূর্যবংশীর দূরপাল্লার গোলমুখী শট দুর্দান্ত সেভ করেন মহম্মদ নাওয়াজ। ৪৩ মিনিটে বক্সের মাথা থেকে সুহেলের জোরালো শট অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। অন্যদিকে, প্রথম মিনিটে গোলের চেষ্টা ছাড়াও এ দিন উইলমার জর্ডন একাধিক সুযোগ পান প্রথমার্ধে। ২১ মিনিটের মাথায় তাঁর শট দুর্দান্ত ব্লক করেন টম অলড্রেড, ৩৫ মিনিটের মাথায় তাঁর শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে পজেশন বাড়িয়ে খেলার নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে চেন্নাইন এফসি। তবে মিনিট দশেক পর থেকে ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে আক্রমণে তীব্রতা বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে মোহনবাগান। প্রথমার্ধের ছবিটাই ফিরিয়ে আনতে চাইছিল তারা। শুরুর দিকে পেট্রাটসের দুটি শট গোলের ওপর ও বাইরে দিয়ে চলে যায়। ৬১ মিনিটের মাথায় সুহেল ভাট গোলের সামনে সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি। সুহেল এ দিন প্রচুর দৌড়লেও কোনও সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। প্রতিপক্ষের বক্সে দু’বার বল ধরতে পেরেছেন তিনি। একটি শট নেন। তবে তা লক্ষ্যে ছিল না।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার মিনিট কুড়ি আগে তাঁকে তুলে লিস্টন কোলাসোকে নামান বাগান-কোচ মোলিনা। দীপক টাঙরিকে তুলে মনবীর সিংকেও নামান তিনি। জয়ের গোলটি তুলে নেওয়াই ছিল তাঁর এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য। যথারীতি বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণ হানেন লিস্টন। ডানদিক দিয়ে মনবীর। তাঁরা মাঠে আসার আগে মোহনবাগানের খেলায় উইং প্লে তেমন দেখা যায়নি। কিন্তু দুই নির্ভরযোগ্য উইঙ্গার চলে আসায় উইং দিয়ে আক্রমণ শুরু হয় তাদের। ফলে চেন্নাইনের রক্ষণের কাজ আরও কঠিন হয়ে ওঠে।

আক্রমণে আরও ধার বাড়াতে ৭৭ মিনিটের মাথায় পেট্রাটসের জায়গায় নামেন জেমি ম্যাকলারেন। চলতি লিগে শেষ কোয়ার্টারেই সবচেয়ে বেশি ১১টি গোল খেয়েছে চেন্নাইন এফসি। গত দু’টি ম্যাচেও তারা ম্যাচের শেষ দিকেই গোল খেয়েছে, এই কথা মাথায় রেখেই শেষ ১৫ মিনিটে আক্রমণ বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে কলকাতার দল। তবে অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার প্রীতম কোটাল এই ম্যাচে চেন্নাইেনের হয়ে খেলা শুরু করায় তা হতে দেননি।

লিস্টন, মনবীর, ম্যাকাকে মাঠে নামিয়েও তেমন কোনও লাভ হচ্ছে না দেখে ৮৭ মিনিটের মাথায় জেসন কামিংস ও সহাল আব্দুল সামাদকেও নামান মোলিনা। তবে তাঁরা যে ক্লান্ত, সে ইঙ্গিত তাঁদের পারফরম্যান্সেই ছিল। বরং ৯০ মিনিটের মাথায় কোনর শিল্ডসের মাপা ফ্রিকিকে হেড করে গোলের সুযোগ পান রায়ান এডওয়ার্ডস, যা পোস্টের বাইরে চলে যায়। ৯৫ মিনিটের মাথায় ডানদিকে দিয়ে বক্সে ঢুকে মনবীর কাটব্যাক করে গোলের পাস বাড়ানোর চেষ্টা করলেও তা আটকে দেন গোলকিপার নাওয়াজ। এর পরে আর আক্রমণে উঠতে পারেনি সবুজ-মেরুণ বাহিনী।

মোহনবাগান এসজি দল (৪-২-৩-১): বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, টম অলড্রেড, আলবার্তো রড্রিগেজ, শুভাশিস বোস, দীপক টাঙরি (মনবীর সিং-৭০), আপুইয়া, গ্রেগ স্টুয়ার্ট (জেসন কামিংস-৮৭), অভিষেক সূর্যবংশী (সহাল আব্দুল সামাদ-৮৭), দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (জেমি ম্যাকলারেন-৭৭), সুহেল ভাট (লিস্টন কোলাসো-৭০)।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: - চেন্নাইন এফসি ২৯.৯% - মোহনবাগান এসজি ৭০.১%, সফল পাসের হার: ৬৬%-৮৭%, গোলে শট: ১-২, ফাউল: ১০-১৭, ইন্টারসেপশন: ১০-৬, ক্রস: ১৮-১৭, কর্নার: ৩-৩, হলুদ কার্ড: ১-৪।

ম্যাচের সেরা: ইরফান ইয়াডওয়াড (চেন্নাইন এফসি)