ডুরান্ড কাপের প্রথম ম্যাচে ভাল ও খারাপ— দু’রকম খবরই পেলেন সবুজ-মেরুন সমর্থকেরা। খারাপ খবর, লাল কার্ড দেখে জাতীয় ক্লাব মরশুম শুরু করলেন তাদের প্রিয় তারকা আপুইয়া এবং সুখবর, জিতে মরশুমের সূচনা করল তাদের প্রিয় দল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডুরান্ড কাপের কলকাতা ডার্বি ৩-১-এ জিতে নিল আইএসএলের জোড়া খেতাবজয়ীরা।

এ দিন বিদেশিহীন মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করে জয় পায়। প্রথমার্ধের শেষ দিকে তারকা মিডিও আপুইয়া লাল কার্ড দেখায় প্রায় অর্ধেক ম্যাচই দশ জনে খেলে তারা। তা সত্ত্বেও এই ব্যবধানে জিতে বাগান-বাহিনী ইঙ্গিত দিতে রাখল, এ বারের ডুরান্ড কাপও জিততেই নেমেছে তারা। মহমেডানের লড়াইয়ের প্রশংসাও করতেই হবে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের রক্ষণে একাধিকবার চিড় ধরিয়ে তাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করে সাদা-কালো বাহিনী।

এই জয়ের ফলে গ্রুপ ‘বি’-র শীর্ষস্থানে জায়গা করে নিল তারা। অর্জিত পয়েন্ট (৩) সমান হলেও গোলপার্থক্যে ডায়মন্ড হারবার এফসি-র (+১) চেয়ে এগিয়ে রইল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট (+২)। অন্যদিকে, দুই ম্যাচেও কোনও পয়েন্ট অর্জন করতে না পারায় টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেওয়ার পথে এগিয়ে গেল মহমেডান এসসি। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের তারকা উইঙ্গার লিস্টন কোলাসো এ দিন জোড়া গোল করেন ও একটি গোল দেন সুহেল ভাট। একটি গোল শোধ করেন মহমেডানের তরুণ ফরোয়ার্ড অ্যাশলে আলবান কোলি।

এ দিন শুরু থেকেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। বিদেশিহীন সবুজ-মেরুন বাহিনীর তরুণ ভারতীয় খেলোয়াড়রাই এ দিন শুরু থেকে আধিপত্য বিস্তার করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামেন।

আক্রমণে সুহেল ভাট ও কিয়ান নাসিরি, মাঝমাঠে অনিরুদ্ধ থাপা, অভিষেক সূর্যবংশী, দীপক টাঙরি, আপুইয়া ও লিস্টন কোলাসো এবং রক্ষণে অভিষেক সিং, দীপেন্দু বিশ্বাস ও আশিস রাইকে নিয়ে শুরু করে তারা। রিজার্ভ বেঞ্চেও কোনও বিদেশিকে দেখা যায়নি এ দিন।

মহমেডান এসসি লালথানকিমা, অ্যাডিসন সিংদের মতো তরুণ ফরোয়ার্ডদের নিয়ে মাঠে নামে। মাঝমাঠ সামলান সজল বাগ, যশ চিকরোরা। তবে সবচেয়ে বেশি চাপ নিতে দেখা যায় ডিফেন্ডার দীনেশ মিতেই, সিঙসন, সাজাদ পারে-দের। কারণ, মোহনবাগান সুপার জায়ান্টই ম্যাচের বেশির ভাগ সময় প্রতিপক্ষের রক্ষণকে পরীক্ষার মুখে ফেলে।

আইএসএল চ্যাম্পিয়ন দলের ভারতীয়রাই এ দিন মাঠ মাতিয়ে দেন এবং প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করে তারা। সুহেলের একটি শট বারে লেগে ফিরেও আসে। ২৩ মিনিটের মাথায় ফ্রি কিক থেকে লিস্টন কোলাসোর সিগনেচার গোলে এগিয়ে যায় বাগান-বাহিনী।

তিন ডিফেন্ডারকে ধোঁকা দিয়ে বক্সে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে অবৈধ ভাবে বাধা পান গোয়ানিজ তারকা। ফলে বক্সের সামনেই ফ্রি কিক পায় তারা। কোলাসোর চেনা ফ্রি কিক মানবপ্রাচীরের ওপর দিয়ে সোজা গোলে ঢুকে পড়ে। গোলকিপার শুভজিৎ ভট্টাচার্য বলের নাগালও পাননি (১-০)।

গোল খাওয়ার পর তা শোধ করার চেষ্টা শুরু করে মহমেডান। তবে মোহনবাগান রক্ষণে চিড় ধরানোর মতো ধার তাদের আক্রমণে ছিল না। তবে আবার গোল না খাওয়ার পর নিজেদের এলাকায় গুটিয়ে থাকেনি তারা। পাল্টা আক্রমণে উঠে গোলের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করে তারা।

মোহনবাগান সুপার জায়ান্টও ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। ক্রমশ চাপ বাড়াতে শুরু করে তারা। তাদের সামলানোর জন্য মাঝে মাঝেই পা চালাচ্ছিলেন সাদা-কালো বাহিনীর খেলোয়াড়রা। এমনই এক আক্রমণে ওঠার সময় আপুইয়াকে পিছন থেকে ফাউল করে মাটিতে ফেলে দেন মিডফিল্ডার তাঙভা রাগুই। উত্তেজিত হয়ে তাঁকে পাল্টা ধাক্কা মারেন বাগান মিডিও। অধিনায়ক দীনেশ মিতেইকেও ধাক্কা মারেন তিনি। প্রথমার্ধের শেষ দিকের এই ঘটনার জ্ন্য রেফারি আপুইয়াকে লাল কার্ড দেখান এবং তখন থেকেই দশ জনে খেলা শুরু করে সবুজ-মেরুন বাহিনী।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই কোলাসোর পাসে গোলের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান থাপা। কিন্তু ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসে অসাধারণ ভাবে দলকে বাঁচান গোলকিপার শুভজিৎ। মহমেডান অবশ্য প্রতিপক্ষের শুরুর এই আক্রমণেই দমে যায়নি। তারা পাল্টা আক্রমণ হানে এবং ৪৯ মিনিটের মাথায় সমতা এনে ফেলে।

ডান উইং থেকে প্রথমে দূরপাল্লার শট নেন লালথান কিমা। তাঁর গোলমুখী শট ডাইভ দিয়ে আটকে দেন বাগান গোলকিপার বিশাল কয়েথ। কিন্তু তাঁর হাত থেকে ছিটকে আসা বল গিয়ে পড়ে বক্সের বাঁদিকে থাকা অ্যাশলে আলবান কোলির পায়ে। তিনি এগিয়ে এসে বাঁ পায়ের আউটস্টেপ দিয়ে বল গোলে জালে জড়িয়ে দেন (১-১)। দশ জনে খেলা মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের মাঝমাঠের দুর্বলতাকে অসাধারণ ভাবে কাজে লাগিয়ে নেয় তারা।

আপুইয়ার লাল কার্ড ও গোল খাওয়া— এই দুই ঘটনার জেরে বেশ কিছুটা আগোছালো হয়ে পড়ে সবুজ-মেরুন বাহিনী এবং সেই সুযোগে আক্রমণের ধার বাড়ায় মহমেডান এসসি। ৫৬ মিনিটের মাথায় সজলের দূরপাল্লার শট আটকাতে গিয়ে ফের বল ফস্কান বিশাল। সেই বল অনুসরণ করে দৌড়ে যাওয়া অ্যাডিসন সিংকে আটকাতে ফের সামনে ডাইভ দিয়ে বলের দখল নেন তিনি। কিন্তু সে জন্য অ্যাডিসন ও দীপেন্দু দুজনেরই বুট বিশালের মাথায় লাগে। তবে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ফের কিপিং চালিয়ে যান তিনি।

ওই সময়ে ফের ব্যবধান তৈরি করাই ছিল মোহনবাগানের একমাত্র লক্ষ্য এবং ৬৩ মিনিটের মাথায় সেই লক্ষ্যপূরণ করে ফেলেন সুহেল। বাঁ উইং দিয়ে বল নিয়ে ওঠা কোলাসোকে বক্সের সামনে ঘিরে ধরেন তিন ডিফেন্ডার। তিনি ব্যাকহিল করে বল পাঠান বক্সের বাঁদিকে ফাঁকায় থাকা সুহেলকে। তিনি কোণাকুনি শট নেন গোলে, যা অসাধারণ দক্ষতায় আটকে দেন গোলকিপার। ফিরতি বলে ফের গোলে শট নেন কাশ্মীরি ফরোয়ার্ড। এ বার আর তা বাঁচাতে পারেননি শুভজিৎ (২-১)।

এই গোলের মিনিট দুয়েক আগেই একই ভাবে কোণাকুনি শটে গোলের চেষ্টা করেন সুহেল। কিন্তু সে বার লক্ষ্যভ্রষ্ট হন তিনি। এই গোলের মিনিট তিনেক পর কিয়ানের পাস থেকে ফের গোলের সুযোগ পান সুহেল। এ বারও গোলে বল রাখতে পারেননি তিনি। দশ জনে খেললেও ফের এগিয়ে যাওয়ার পর খেলায় তীব্রতা বাড়ায় বাগান-বাহিনী। আপুইয়ার অনুপস্থিতিতে তাদের রক্ষণ ও মাঝমাঠে যে আগোছালো ভাব দেখা গিয়েছিল, ক্রমশ তা শুধরে নেন কোলাসোরা। তবে হাল ছাড়েননি মহমেডান ফুটবলাররা। তাঁরা ফের সমতা আনার চেষ্টা শুরু করেন। তবে এ বার বাগান-ডিফেন্সে ফাটল ধরানো মোটেই সোজা কাজ ছিল না।

ম্যাচের শেষ কোয়ার্টারে প্রতিপক্ষকে গোল এরিয়ার মধ্যে ঢুকতে না দেওয়াই ছিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কৌশল। মহমেডান ফুটবলারদের মাঝমাঠেই নিষ্ক্রীয় করার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। প্রতি আক্রমণেও ওঠার চেষ্টা চলছিল অবশ্য। তবে গোলের জন্য মরিয়া ভাব দেখা যায়নি। দশজনে খেলা দলটি একেবারেই বাড়তি ঝুঁকি নেওয়ার মেজাজে ছিল না। ফলে মহমেডান এসসি-র ফের সমতা আনার যাবতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

উল্টে সংযুক্ত সময়ে গোলমুখী কোলাসোকে বক্সের মধ্যে ফাউল করে প্রতিপক্ষকে পেনাল্টি ‘উপহার’ দেন মহমেডান অধিনায়ক দীনেশ মিতেই। সেই পেনাল্টি থেকে জয় সুনিশ্চিত করেন কোলাসো (৩-১)। এই গোলের পর আর কিছু করার সময়ও পায়নি মহমেডান এসসি।