বিশ্লেষণ: মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কোথায় শক্তি, দুর্বলতাই বা কোথায়?
শনিবারের ফাইনালে কেন ফেভারিট মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, ফুটবল বিশেষজ্ঞরা তার অনেক কারণ দেখাতে পারেন। তবে তাদের যে দুর্বলতাগুলির জন্য ফাইনালে তাদের সমস্যায় পড়তেও হতে পারে।

মাঝে আর তিন দিন। তার পরেই কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের গ্যালারি উপছে পড়বে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ ২০২৪-২৫-এর ফাইনালে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ও বেঙ্গালুরু এফসি-র মধ্যে জমজমাট ফাইনালের সাক্ষী হতে।
টানা তিনবার ফাইনালে ওঠা মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ঘরের মাঠে বরাবরই ফেভারিট। এ মরশুমে একটিও হোম ম্যাচে হারেনি কলকাতার দল। মরশুমের প্রথম ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-র সঙ্গে ড্র করার পরে যুবভারতীতে টানা ১২টি ম্যাচে জিতেছে তারা।
অন্যদিকে, বেঙ্গালুরু এফসি ফাইনালে উঠলেও তারা যে টানা সাফল্য পেয়ে এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে, এমন কথা বলা যায় না। গত দশটি ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতে জিততে পেরেছে তারা। এমনকী এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগেও হেরে যায় তারা। প্রথম লেগে ২-০-য় জিতে থাকায় এই ম্যাচে হেরেও ফাইনালে ওঠেন সুনীল ছেত্রীরা। লিগ তালিকায় তিন নম্বরে থেকে প্লে অফে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা।
শনিবারের ফাইনালে কেন ফেভারিট মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, ফুটবল বিশেষজ্ঞরা তার অনেক কারণ দেখাতে পারেন। তবে তাদের যে দুর্বলতাগুলি এখনও রয়ে গিয়েছে, সেগুলির জন্য ফাইনালে তাদের সমস্যায় পড়তেও হতে পারে। সবুজ-মেরুন বাহিনীর কোথায় শক্তি আর দুর্বল জায়গাগুলিই বা কী, এই প্রতিবদনে সেগুলিই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
শক্তি
ইতিবাচক কোচ
বরাবরই নিজের দল নিয়ে ইতিবাচক থেকেছেন। বরাবরই তিনি বলে এসেছেন দলের খেলোয়াড়দের ওপর ভরসা আছে। যখন যিনি দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, তাঁর পাশে থেকেছেন। প্রথম তিনটি ম্যাচের মধ্যে যখন একটিতে জয় পায় তারা, তখনও বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখা যায়নি কোচকে। বলেছিলেন, ভরসা রাখুন, এই দলই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখাবে। তিনি যে ঠিকই বলেছিলেন, তা পরবর্তীকালে প্রমাণ করে তাঁর দল। একের পর এক নজির গড়ে, রেকর্ড পয়েন্ট পেয়ে লিগ শীর্ষে থেকে প্লে অফে সবার আগে জায়গা পাকা করে নেয় তারা। প্রথম এগারো বাছাইয়েও বরাবরই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন কোচ।
প্রতিভাবান খেলোয়াড়
এ মরশুমে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট যে সেরা দল গড়েছে, তা তাদের পারফরম্যান্সেই স্পষ্ট। দলের যারা নিয়মিত খেলোয়াড়, তাঁদের বেশিরভাগই লিগের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট ভাল ফর্মে ছিলেন। যাঁরা রিজার্ভ বেঞ্চে ছিলেন তাঁরাও প্রয়োজনে দারুন ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। দলে গোলদাতার সংখ্যা ১১। ডিফেন্ডাররা ১৪টি গোল করেছেন। এর চেয়ে ভাল আর কীই বা হতে পারে একটা দলে?
শক্তিশালী রিজার্ভ বেঞ্চ
একটা ভাল ফুটবল দলের রিজার্ভ বেঞ্চও সাধারণত শক্তিশালী হয়। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ক্ষেত্রেও তাই। জেসন কামিংস, গ্রেগ স্টুয়ার্ট এমনকী জেমি ম্যাকলারেনও তাদের রিজার্ভ বেঞ্চে থাকেন। দীপেন্দু বিশ্বাসের মতো প্রতিভাবান, তরুণ ডিফেন্ডারকেও মাঠের পাশে দেখা যায় মাঝে মাঝে। সহাল আব্দুল সামাদ, আশিক কুরুনিয়ান, দীপক টাঙরিদের মতো ভারতীয় দলের হয়ে খেলা মিডফিল্ডার এবং দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের মতো বিপজ্জনক স্ট্রাইকারও থাকেন বেঞ্চে। তাই প্রতি ম্যাচে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ১৬ জন প্রথম দলে খেলার যোগ্য ফুটবলারকে পায়। যা অন্য কোনও দল পায় বলে মনে হয় না।
দলগত ফুটবল ও আত্মবিশ্বাস
এই দলটার সবচেয়ে বড় গুণ হল তারা দল হিসেবে খেলে। কোনও খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল নয় তারা। কোচের কথায়, ‘আমরা আক্রমণেও উঠি দল হিসেবে এবং ডিফেন্সও করি দল হিসেবে। দু-একজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করে থাকি না’। গোল করার জন্য যেমন অ্যাটাকারদের দায়িত্বই সব নয়, তেমনই গোল আটকানোর জন্য ডিফেন্ডাররাই পুরোপুরি দায়ী নয়। প্রয়োজনে মনবীর সিং, লিস্টন কোলাসোদেরও রক্ষণে নেমে আসতে দেখা যায়। আবার শুভাশিস বোস, আলবার্তো রড্রিগেজদেরও উঠে গিয়ে গোল করতে দেখা যায়। মাঝমাঠে শক্ত খুঁটি আপুইয়া যেমন গত ম্যাচে গোল করে দলকে জেতালেন, তেমনই প্রতিপক্ষের বহু অবধারিত গোলে বাধা দিয়েছেন তিনি।
ঘরের মাঠে ধারাবাহিকতা
ঘরের মাঠে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের। যুবভারতীতে প্রথম ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ২-২ ড্র করেছিল তারা। তার পর থেকে টানা ১২টি হোম ম্যাচে জিতেছে তারা। ঘরের মাঠে খেলার অভ্যাস ও সমর্থকদের চিৎকারকে ভরপুর কাজে লাগিয়েছেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর ফুটবলাররা। ফাইনালও হবে ঘরের মাঠে। তাই শনিবারও এই দুই বাড়তি সুবিধাকে একশো শতাংশ কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট।
সমর্থকদের সাহায্য
ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ সমর্থক। আধুনিক যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সবার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগও থাকে ফুটবলার, কোচেদের। তাই তাদের মোটিভেশন জোগানোর মতো লক্ষ লক্ষ বার্তা, শুভেচ্ছা সব কিছুই পৌঁছে যায় ফুটবলারদের কাছে। আর মাঠে থাকা হাজার যাটেক সমর্থকের গগনভেদী চিৎকার তো আছেই। কোচ মোলিনা নিজেই বলেছেন, ‘ঘরের মাঠে সমর্থকেরাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। ওদের জন্যই আমাদের ফুটবলাররা বাড়তি তাগিদ, সাহস ও শক্তি নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে’। সেমিফাইনালে প্রথম লেগে হারার পর ঘরের মাঠে দ্বিতীয় লেগে যে ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতে ফাইনালে ওঠে সবুজ-মেরুন বাহিনী, তাতেই প্রমাণ হয়েছে ঘরের মাঠে তারাই রাজা।
দুর্বলতা
গোলের সুযোগ নষ্ট
প্রচুর গোল যেমন করেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, তেমনই গোলের সুযোগ তৈরি করেও তা হাতছাড়া করেছে প্রচুর। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২৬টি ম্যাচে ৫০টি গোল করেছে তারা। কিন্তু সুযোগ তৈরি করেছে ২৮৮টি। অর্থাৎ, মাত্র ১৭.৩৬ শতাংশ সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছে তারা। এ পর্যন্ত ১৫১টি শট তারা লক্ষ্যে রেখেছে এবং তার প্রায় ৩৩ শতাংশ থেকে গোল পেয়েছে। আর লক্ষ্যভ্রষ্ট শটের সংখ্যা ২৬৫। এতগুলি গোলের সুযোগ, শটের সংখ্যার পরও গোলের সংখ্যা ৫০, ভাবলে অবাকই লাগে।
রক্ষণে ধারাবাহিকতার অভাব
সবচেয়ে বেশি ম্যাচে গোল অক্ষত রাখার নজির অবশ্যই মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের। ১৬টি ম্যাচে ক্লিন শিট রেখেছে তারা। সবচেয়ে কম গোল খেয়েছেও, ১৮টি। কিন্তু কবে যে তাদের রক্ষণ দুর্বল হয়ে পড়বে, তার কোনও ঠিক নেই। যেমন সেমিফাইনালের প্রথম ম্যাচে শুরুতেই গোল খেয়ে যায় তারা। ম্যাচ যখন প্রায় ১-১ ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছে, ঠিক তখনই শেষ মুহূর্তের গোলে ১-২-এ হেরে যায় তারা। শুরুর দিকে টানা তিনটি ম্যাচে গোল অক্ষত রাখে তারা। তার পরে ওডিশার বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে। ফের তিনটি ম্যাচে কোনও গোল খায়নি তারা। চলতি বছরের শুরুতে টানা ছ’টি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রাখে তারা। কিন্তু গত চারটি ম্যাচের মধ্যে দুটিতে কোনও গোল খায়নি সবুজ-মেরুন বাহিনী। কিন্তু বাকি দু’টি ম্যাচে দু’টি করে গোল খায়।
বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে স্বচ্ছন্দ নয়
এই লিগে বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে দুই ম্যাচের কোনওটিতেই খুব একটা স্বাচ্ছন্দে খেলতে পারেনি মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। সারা লিগে যে দু’টি ম্যাচে তারা খেলে, তার মধ্যে একটি ছিল বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে তাদের ঘরের মাঠে। সেই ম্যাচে তিন গোলে হারে তারা। রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে সে দিন সবুজ-মেরুন বাহিনীকে হারিয়েছিল ছেত্রী-বাহিনী। সেই ম্যাচে হেরে ছ’নম্বরে নেমে যায় শিল্ডজয়ীরা আর বেঙ্গালুরু জিতে উঠে যায় লিগ টেবলের শীর্ষে। ঘরের মাঠে ১-০-য় জিতলেও যে অনায়াসে জিতেছে তারা, তাও নয়। ম্যাচের একমাত্র গোলটি পেতে ৭৪ মিনিট অপেক্ষা করতে হয় তাদের। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে বেঙ্গালুরুর দলের বিরুদ্ধে এ বার খুব একটা আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট।
পেট্রাটস, স্টুয়ার্ট ধারাবাহিক নয়
অন্যরা ভাল খেললেও মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের গত দু’বারের সেরা গোলদাতা দিমিত্রিয়স পেট্রাটস এ বার তেমন ফর্মে নেই। ২৩টি ম্যাচে মাত্র চারটি গোল ও তিনটি অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। গতবার এই দিমিই ২৩ ম্যাচে দশটি গোল ও সাতটি অ্যাসিস্ট করেছেন। প্রথমবার ২৩ ম্যাচে ১২ গোল ও সাতটি অ্যাসিস্ট দিয়েছিলেন। গ্রেগ স্টুয়ার্টের অবস্থাও প্রায় সে রকমই। এ বার তিনটির বেশি গোল করতে পারেননি তিনি। পাঁচটি অ্যাসিস্ট করেছেন অবশ্য। গতবারও পাঁচটি গোলে অবদান ছিল তাঁর। দু’টি গোল করেছিলেন। প্রথম মরশুমের তুলনায় (১১ গোল ও ১০ অ্যাসিস্ট) ক্রমশ যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছেন গ্রেগ। এই দু’জন ফর্মে থাকলে সবুজ-মেরুন আক্রমণ আরও ধারালো হয়ে উঠত।