৭৭ পয়েন্টে পিছিয়ে। ১৯তম স্থানে। হাতে মাত্র কয়েকটি ম্যাচউইক— এই পরিস্থিতিতে অন্য কেউ হলে হয়তো হাল ছেড়েই দিত। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। আর হাল ছেড়ে দেননি বলেই আইএসএল ২০২৪-২৫ ফ্যান্টাসির বিজয়ীর খেতাব পেয়েছেন উইলসন। কারণ, তাঁর চিন্তা-ভাবনা ছিল একেবারে অন্য ধরনের।

তিরুচিরাপল্লির বাসিন্দা এবং চেন্নাইন এফসি-র একনিষ্ঠ সমর্থক উইলসনের এই ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী রিতীমতো নাটকীয়। ম্যাচসপ্তাহ ২৬-এ এসে তিনি ক্রমতালিকায় সবার ওপরে উঠে আসেন। শেষ ম্যাচসপ্তাহের জন্য ‘ট্রিপল ক্যাপ্টেন’ বুস্টারটি জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সেই সাহসী সিদ্ধান্তই হয়ে ওঠে তাঁর বিজয়ের চাবিকাঠি। ফ্যান্টাসি লিগের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তিনি পেয়েছেন একটি PS5, একটি গিফট কার্ড এবং আরও অনেক উপহার।

২০১৫ আইএসএল ফাইনাল থেকে লিগ অনুসরণ করা উইলসন জানান, তিনি পুরস্কারের জন্য খেলেননি—তাঁর লক্ষ্য ছিল এক নম্বরে শেষ করা।

"আমি পুরস্কারের জন্য খেলিনি। আমি শুধু খেলেছি প্রথম স্থানে শেষ করার জন্য," বলেন উইলসন। "জেতার পর আমি মা ও বোনকে খবরটা জানাই এবং ওরা খুব খুশি হয় ও অবাকও হয়। আমি ওদের আগে কিছু জানাইনি। কারণ, ওদের মনে আশা তৈরি হোক সেটা আমি চাইনি," যোগ করেন তিনি।

ধীর গতির আরোহন

দুই মরশুম ধরে আইএসএল ফ্যান্টাসি গেম খেলছেন উইলসন। ২০২৩-২৪ মরশুমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ম্যাচসপ্তাহ ১ বিজয়ীর একটি পোস্ট দেখে খেলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। সেই মরশুমে তিনি ৫৩ নম্বরে ছিলেন। ২০২৪-২৫ মরশুমের শুরু থেকেই তাঁর কৌশল ছিল স্পষ্ট। নতুন স্কোরিং সিস্টেমে প্রতি ১৫টি সফল পাস বা ২টি ইন্টারসেপশনের জন্য এক পয়েন্ট দেওয়া হচ্ছিল, যা উইলসনের কৌশলের সঙ্গে একেবারে মিলে যায়। তিনি বলের দখলে দক্ষ খেলোয়াড়দের দিকে মনোনিবেশ করেন।

"এই মরশুমের পয়েন্ট সিস্টেম দেখে, বিশেষ করে পাসের পয়েন্ট দেখে আমি বুঝেছিলাম, এ বার আমিই জিততে পারি, কারণ বেশিরভাগই গোলস্কোরারদের নেবে," বলেন তিনি।

উইলসন আক্রমণভাগের পরিবর্তে মাঝমাঠ ও রক্ষণে এমন খেলোয়াড়দের বেছে নেন, যাঁরা বেশি পাস দেন। ওডিশা এফসি-র আহমেদ জাহু, মুম্বই সিটি এফসি-র মিডফিল্ডার ইয়োল ভ্যান নিফ তাঁর দলের মূল অংশে ছিলেন। এর সঙ্গে ছিলেন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের শুভাশিস বোস, যিনি গত মরশুমে সর্বোচ্চ পয়েন্ট পেয়েছেন। এ ছাড়াও ছিলেন বেঙ্গালুরু এফসি-র রাহুল ভেকে এবং মুম্বই সিটির সেন্টার-ব্যাক তিরি।

"আমি সাধারণত ফরোয়ার্ডদের নিইনি। বেশিরভাগ সময় আমি এমন মিডফিল্ডার ও ডিফেন্ডার নিয়েছি যারা অনেক পাস দেয়," জানান উইলসন। গত মরশুমের সেরা ফরোয়ার্ড আলাদিন আজারেই, যিনি একাধিক রেকর্ড ভেঙেছেন, তিনি উইলসনের দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন। কিন্তু অধিনায়কত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বেশিরভাগ সময়ই ডিফেন্ডার বা মিডফিল্ডারদের বেছে নেন।

"আমি ফরোয়ার্ডদের মধ্যে উইলমার জর্ডান গিলকে ডাবল ম্যাচউইকে এবং দু'বার আলাদিনকে ক্যাপ্টেন করেছিলাম, বাকি সময় সব সময়ই মিডফিল্ডার বা ডিফেন্ডারদের দিয়েছি," বলেন তিনি।

বড় ধাক্কার পর দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন

ম্যাচসপ্তাহ ২২-এ উইলসন বড়সড় ধাক্কা খান। মরশুমের অধিকাংশ সময় ২ নম্বরে থাকা উইলসন হঠাৎ করে ১৯তম স্থানে নেমে যান। লিডারের থেকে পিছিয়ে পড়েন ৭৭ পয়েন্টে। তবে ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল। ম্যাচসপ্তাহ ২৩-এ আইএসএল ফ্যান্টাসিতে ঘোষণা হয় ‘আনলিমিটেড ট্রান্সফার উইন্ডো’। সেটাই ছিল মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত।

উইলসন বলেন, "আমি ভাবলাম, এই সুযোগ মিস করা যাবে না। আমি আমার দল গুছিয়ে নিই এবং আমার কাছে তখন দুটি বুস্টার ছিল—‘বেঞ্চ বুস্ট’ ও ‘ট্রিপল ক্যাপ্টেন’"। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল বেঙ্গালুরু এফসি-র ফরোয়ার্ড রায়ান উইলিয়ামসকে নেওয়া, যাঁকে তখন খুব কম ম্যানেজারই দলে রেখেছিলেন। এই খেলোয়াড় দুর্দান্ত পারফর্ম করেন এবং বেঙ্গালুরুকে প্লে-অফে তুলতে বড় ভূমিকা নেন।

শেষ ম্যাচসপ্তাহে উইলসন মাথা ঠাণ্ডা রেখে ‘ট্রিপল ক্যাপ্টেন’ ব্যবহার করেন তিরির ওপর। মুম্বই সিটি এফসি-র সেই ম্যাচে বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে জিততেই হত এবং সেটি ছিল অ্যাওয়ে ম্যাচ। সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে উইলসন তিরিকে ক্যাপ্টেন করেন এবং সেটি সফল হয়—মুম্বই ম্যাচ জেতে ও ক্লিন শিট রাখে। এই সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত তাঁকে কয়েক পয়েন্টের ব্যবধানে চ্যাম্পিয়ন করে তোলে। "আমি ট্রিপল ক্যাপ্টেন শেষ ম্যাচসপ্তাহের জন্য রেখেছিলাম। কারণ, আমি অন্য ম্যানেজারদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবি। তিরি ৯ পয়েন্ট পায় এবং অতিরিক্ত পয়েন্ট আমাকে জোগায়," জানান তিনি।

ভবিষ্যতের জন্য বার্তা

যারা তাঁর পথ অনুসরণ করতে চায়, তাদের জন্য উইলসনের বার্তা স্পষ্ট— সবগুলো ম্যাচ দেখো এবং নিজের অন্তরের নির্দেশ অনুসরণ করো। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমি ম্যানেজারদের বলব, আইএসএলের সব ম্যাচ দেখো। প্লেয়ারের ইনজুরি বা সাসপেনশনের কারণে কে খেলবে না সেটা জানা আমাদের দায়িত্ব। আর নিজের সিদ্ধান্তে ভরসা রাখো—অন্যদের দেখে নিজের দলে পরিবর্তন কোরো না"।

এই সাফল্যের পরও আবেগে ভেসে যেতে চান না উইলসন। তিনি আগামী মরসুমেও খেলবেন বলে জানিয়েছেন। একমুখ হাসি নিয়ে তিনি বলেন, "আমি আগামী মরশুমেও খেলব এবং আবারও চ্যাম্পিয়ন হতে চেষ্টা করব। যদিও এখন সবাই আমার কৌশল জেনে ফেলেছে"। পরের বার ফের তাঁকে নতুন কৌশলের উদ্ভাবন করতে হবে।