লাল-হলুদ পরিবার থেকে উঠে আসা সবুজ-মেরুন সমর্থক প্রসেনজিত
মোহনবাগান গোল করতেই লাফিয়ে ওঠে দশ বছরের ছেলেটি। রান্নাঘর থেকে থালা নিয়ে এসে তা সর্বশক্তি দিয়ে পেটাতে শুরু করে সে।

‘ঘরশত্রু বিভীষণ’ বা ‘কুলাঙ্গার’ বলে তাঁকে দাগিয়েই দিতে পারতেন তাঁর দাদু! গোটা পরিবার যেখানে আদ্যোপান্ত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, সেখানে এমন এক ব্যতিক্রমের উদয় হল কী ভাবে, এই নিয়ে নিশ্চয়ই তিনি ভেবেছেন অনেক। কুলকিনারা খুঁজে পেয়েছেন কি?
আসলে ফুটবল-পাগলরা এমনই হয়। ফুটবল-প্রেম অনেক সময়ই যুক্তির ধার ধারে না। তাই প্রসেনজিৎ সরকারের দাদু তাঁর নাতির মোহনবাগান-প্রীতি নিয়ে কখনও আপত্তি, অভিযোগ করেননি। এই একটা জায়গায় দাদু-নাতির সম্পর্ক সাপে-নেউলের মতো হলেও বাকি সব কিছুতেই তাঁদের রসায়ন একেবারে জলের মতো স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক ছিল। এখন দাদু অতীত। কিন্তু পরিবারে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের উত্তরসূরী রেখে গিয়েছেন। কলকাতা ডার্বি এলে একটু ঠোকাঠুকি হয় হয়তো। তার বেশি কিছু নয়।
কিন্তু ঘটি-বাঙালের ফুটবল সম্পর্ক তো আর স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এই সম্পর্কের তিক্ততা অতীতে এমন পর্যায়েও উঠেছে, যার জেরে ঝরেছে রক্ত, চলে গিয়েছে প্রাণও। ৪৪ বছর আগে এক ১৬ অগাস্টে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মধ্যে এক ফুটবল দ্বৈরথকে কেন্দ্র করে প্রাণ দিতে হয়েছিল ১৬জন নিষ্পাপ মানুষকে। এখন রক্ত না ঝরলেও একে অপরকে রক্তচক্ষু দেখানোর চিরকালীন প্রথা তো রয়েই গিয়েছে।
অথচ শ্যামনগরের সরকার পরিবারে একই ছাদের তলায় পতপত করে ওড়ে লাল-হলুদ ও সবুজ-মেরুন পতাকা। একদিকে যেমন জ্বলন্ত মশালের আগুন, অন্যদিকে তেমন পালতোলা নৌকার পতাকা। সবই যেন মিলেমিশে একাকার! এও কি সম্ভব?
কিন্তু জ্ঞান হওয়া থেকে ‘আমাগো ইস্টবেঙ্গল’ ধ্বনী শুনতে অভ্যস্ত প্রসেনজিৎ কী করে এমন ব্যতিক্রমী হয়ে উঠলেন? ইস্টবেঙ্গল জিতলেই যাঁর দাদু সবাইকে ডেকে ইলিশ উৎসব পালন করতেন, তাঁর নাতি হয়ে কী করে মোহনবাগানী হয়ে গেলেন তিনি?
বছর দশেক বয়স তখন তাঁর। ১৯৯৭ সাল। বাড়িতে কলকাতা ডার্বি দেখার জন্য টিভির সামনে বসে প্রায় গোটা পরিবার। খেলা শুরু হতেই বারবার ধারাভাষ্যকারের মুখ থেকে শোনা ‘মোহনবাগান’ নামটাই তাঁর মন কেড়ে নিয়েছিল। মোহনবাগান গোল করতেই লাফিয়ে ওঠে দশ বছরের ছেলেটি। রান্নাঘর থেকে থালা নিয়ে এসে তা সর্বশক্তি দিয়ে পেটাতে শুরু করে সে। ইস্টবেঙ্গলের গোল খাওয়া দেখে পরিবারের বাকি সদস্যেরা যতটা না চমকে গিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি তাদের ধাক্কা দিয়েছিল প্রসেনজিতের এই কাণ্ড।
“এখানে কেউ তার প্রিয় দল বাছে না। দলই বেছে নেয় তাকে। আমার আর মোহনবাগানের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে”, বলেন সবুজ-মেরুন জনতার অন্যতম মুখ, যিনি এখন মোহনবাগান সমর্থকদের অন্যতম বিখ্যাত সংগঠন ‘মেরিনার্স বেস ক্যাম্প - আল্ট্রাজ মোহনবাগান’-এর অন্যতম প্রধান সদস্য, যাঁকে সমর্থকেরা সবাই এক ডাকে চেনেন।
ইউরোপের ফুটবলে আল্ট্রাজ বিপ্লবে উজ্জীবিত হয়ে এ দেশে যে সংগঠন তৈরি হয়েছিল, সেই সংগঠনের ‘ক্যাপো’ এই প্রসেনজিৎ। প্রিয় দলের জন্য গলা ফাটানো, স্লোগান দেওয়া, গান গাওয়া, টিফো তৈরি করে তা তুলে ধরাই এঁদের কাজ, যাতে সবুজ-মেরুন ফুটবলাররা উজ্জীবিত হয়ে মাঠে নামেন এবং দলকে সাফল্য এনে দিতে পারেন। প্রসেনজিতের গলাতেই গলা মেলান সমর্থকেরা। তাতেই সরগরম হয়ে ওঠে গ্যালারি। ‘আমরা কারা? মোহনবাগান’ ধ্বনীতে মুখরিত হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস।
স্কুলে ফুটবল দলের গোলকিপার ছিলেন প্রসেনজিৎ। হেমন্ত ডোরা, সংগ্রাম মুখার্জির অন্ধ ভক্ত ছিলেন। শ্যামনগর থেকে নিয়মিত খেলা দেখতে আসাটা যে কোনও কিশোরের পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। প্রথম প্রথম সে জন্য অনেক বকা-ঝকাও খেয়েছেন।
২০০৬-এ যখন একদিন ছোটবেলার বন্ধু সৌম্যেন চাকিকে নিয়ে কলেজ থেকে পালিয়ে ডার্বি দেখতে যুবভারতীতে যান, সেই দিনটাই ছিল ফুটবল-ভক্ত প্রসেনজিতের জীবনের মোড়। এক লক্ষ ২০ হাজার মানুষের সমুদ্রে কার্যত সাঁতার কাটার সেই নেশাই তাঁকে বারবার টেনে নিয়ে আসে মাঠে।
কলেজ জীবনে প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মোহনবাগানের ম্যাচ দেখতে দৌড়েছেন হয় বারাসাতে, না হয় কল্যাণীতে অথবা মোহনবাগান মাঠে। ক্লাবে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে। কিন্তু প্রসেনজিৎ সরকার বরাবরই মোহনবাগান-অন্ত প্রাণ। তাঁর সবুজ-মেরুণ প্রীতি কেউ কমাতে পারেনি। বরং ক্রমশ তা বেড়েছে।
২০১৫-র আই লিগে প্রায় ১৩ বছর পর যখন মোহনবাগান কোনও জাতীয় স্তরের খেতাব জেতে, সে-ই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। শুধু মোহনবাগান নয়, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডেরও অন্ধ সমর্থক সে দেশের ফুটবলপ্রেমীদের আল্ট্রাজ বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতেও সেই প্রথা আনার পরিকল্পনা শুরু করেন।
২০১৫-য় মোহনবাগানের আই লিগ জয়ের পর থেকে এক এক করে ছোট-বড় ফ্যান ক্লাবের উত্থান শুরু হয়। কিন্তু প্রসেনজিৎ আরও বড় কিছু করার কথা ভেবেছিলেন তখন। বন্ধু সমর্থকদের নিয়ে তৈরি করেন ‘লিভ গ্রিন, ব্লিড মেরুন’ সংগঠন। সেই সংগঠনই পরে পরিণত হয় ‘মেরিনার্স বেস ক্যাম্প - আল্ট্রাজ মোহনবাগান’-এ। বন্ধু তরুণ বসুর সাহায্য নিয়ে একাধিক ফ্যান ক্লাবকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসেন তাঁরা। সেই জন্য একে ‘বেস ক্যাম্প’ বলা হয়। বর্তমানে ২৭টি ফ্যান ক্লাব এই সংগঠনের অন্তর্গত, যা এই দেশে বিরল।
এই ব্যাপারে প্রসেনজিৎ বলেন, “সব সমর্থকদের একই ছাতার তলায় আনাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য, যাতে সবাই মিলে এক বিশাল সংগঠন তৈরি করা যায় এবং দলের প্রতি ম্যাচে আমাদের উপস্থিতি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে”। যখন শুরু করেছিলেন, তখন এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিল একশোরও কম। কিন্তু এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৮০০। প্রসেনজিতের মতো কোর গ্রুপ সদস্য রয়েছেন ষোলোজন।
সমর্থকদের জন্য গানও বেঁধেছেন প্রসেনজিৎ। এখন পর্যন্ত গোটা পাঁচেক গান লিখেছেন তিনি। বিভিন্ন ডার্বিতে বিভিন্ন রকমের মনোমুগ্ধকর টিফোও বানিয়েছেন। ফুটবলের বাইরেও বিভিন্ন দুঃসময়ে ঐক্য ও সাম্যের বার্তা দিয়েও টিফো তৈরি করেছে ‘আল্ট্রাজ’। অনেক সামাজিক কাজও করে থাকেন তাঁরা। সুপার সাইক্লোন আমফানে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আড়াই লক্ষ টাকা, খাবার, বস্ত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। লকডাউনের প্রবল বাধা অতিক্রম করেই নিজেদের কর্তব্য পালন করেছিলেন তাঁরা।
২০১৩-য় শিক্ষকের চাকরি নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে যান প্রসেনজিৎ। কলকাতা থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে চলে যাওয়ায় তাঁর নিয়মিত এ শহরে এসে খেলা দেখাটা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। তবু স্লোগান লেখা, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট চালানো এবং মাঝে মাঝে সপ্তাহান্তে ম্যাচ দেখতে আসার কাজ তিনি। শুরুর দিকে তাঁর শিলিগুড়ির স্কুলের ছাত্ররা তাদের ‘স্যার’-এর এমন ফুটবল-পাগলামির কথা জানত না। কিন্তু পরে ক্রমশ সে সব জানতে পারে তারা। মোহনবাগানের জন্য যে তিনি পাগল, সে কথা জানতে তাদের বেশি সময় লাগেনি।
কিন্তু দুটো দিক বজায় রাখা প্রসেনজিতের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। সেই সময় তাঁর মা এবং স্ত্রী অরুন্ধতী পুরোপুরি ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ান। মজার ব্যাপার জানলে আরও অবাক হবেন, অরুন্ধতী আবার আদ্যান্ত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। কিন্তু স্বামীর মোহনবাগান-প্রীতি নিয়ে কোনও দিন কোনও আপত্তি জানাননি। এই দুই মহিলাই প্রসেনজিতের কাজ কিছুটা হলেও সহজ করে দেন সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়ে। শুধু মোহনবাগান আর শিক্ষকতা নিয়েই যাতে থাকতে পারেন তিনি, তার সব ব্যবস্থাই করেন তাঁরা।
স্ত্রী-র এই ভূমিকার ভূয়ষী প্রশংসা করে প্রসেনজিৎ বলেন, “অরুন্ধতী পুরোপুরি ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। কিন্তু আমার জন্য নিজের উচ্ছ্বাস বা হতাশা কোনওটাই বেশি প্রকাশ করে না। এই যা করছি, সে সব ওর সাহায্য ছাড়া কখনওই করতে পারতাম না”।
প্রসেনজিতের আরও একটা চিন্তা, ক্যাপোদের গড় বয়স সাধারণত ২৭-২৮ হওয়াই উচিত। ৩৬ বয়সে ক্যাপোর ভূমিকা পালন করাটা তাঁর কাছে একটু বাড়তি চাপই হয়ে উঠছে। তবু নিজের কাজটা যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গেই করে যান তিনি। হন্যে হয়ে একজন উত্তরসূরী খুঁজে চলেছেন। তবে যতদিন না কাউকে পাচ্ছেন, ততদিন তাঁকেই ফুটবল-ভক্তদের এই ‘বিপ্লব’ চালিয়ে যেতে হবে।
এ সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিজেকে কী ভাবে শারীরিক ভাবে সব সময় তরতাজা রাখেন? সব শেষে এই প্রশ্ন করায় প্রসেনজিৎ বলেন, “এই অক্সিজেনের নাম মোহনবাগান, যা আমার হৃদযন্ত্রকে চালু রাখে”। এর পরে তাঁকে নিয়ে নতুন করে আর কীই বা বলার থাকতে পারে?