শতবর্ষের উৎসবের মধ্যে যে আশা নিয়ে এ বছর দেশের সেরা ফুটবল লিগ হিরো আইএসএলে যোগ দিয়েছিল এসসি ইস্টবেঙ্গল, তা পূরণ হয়নি একেবারেই। বরং এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায় ক্লাব, যে পরিস্থিতির মধ্যে তাদের কখনও পড়তে হয়নি। ২০০৯-১০ মরশুমে আই লিগে তারা ১৪ দলের মধ্যে ন’নম্বরে ছিল এবং ১৯৯৯-২০০০ জাতীয় লিগ মরশুমে তারা সাত নম্বরে ছিল। কিন্তু ১১ দলের হিরো আইএসএলে ন’নম্বরে থাকাটা সম্ভবত তাদের কাছে সবচেয়ে খারাপ ফল।

কখনও খুশি, কখনও আক্ষেপ

লিগের শেষে যেমন টানা তিন ম্যাচে হারে তারা, তেমনই শুরুতেও টানা তিন ম্যাচ হারতে হয় তাদের। মাঝের ১৪টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিনটিতে জয় পায় তারা। আটটি ম্যাচে ড্র করে ও আরও তিনটি ম্যাচে হারতে হয় লাল-হলুদ বাহিনীকে। ২২টি গোল দিলেও ৩৩টি গোল খায় তারা। ২০ ম্যাচে মাত্র ১৭ পয়েন্ট পেয়ে ন’নম্বরেই থেকে যায় তারা। কেরালা ব্লাস্টার্স ও ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে।

সেমিফাইনালে ওঠা তিন দল এটিকে মোহনবাগান, মুম্বই সিটি এফসি ও নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র কাছে প্রথম তিনটি ম্যাচে হেরে চতুর্থ ম্যাচে জামশেদপুর এফসি-র সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে প্রথম পয়েন্ট পায় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের প্রাক্তন তারকা ফরোয়ার্ড রবি ফাউলারের প্রশিক্ষণাধীন এসসি ইস্টবেঙ্গল। পাঁচ নম্বর ম্যাচে গিয়ে তারা হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে প্রথম গোল পেলেও জয় অধরাই থেকে যায়। জাক মাঘোমার গোলে এগিয়ে গিয়েও দ্বিতীয়ার্ধে ১৪ মিনিটের মধ্যে তিনটি গোল খায় তারা। শেষে মাঘোমা আর একটি গোল করলেও হার বাঁচাতে পারেননি।

এই হারের পরে টানা সাতটি ম্যাচে অপরাজিত ছিল লাল-হলুদ ব্রিগেড। এর মধ্যেই তাদের প্রথম জয় আসে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে, ৩-১-এ। অ্যান্থনি পিলকিংটন, মাঘোমা ও ব্রাইট ইনোবাখারে গোল করেন। চেন্নাইন এফসি-র সঙ্গে দুই লেগেই ড্র করে তারা। ড্র করে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে প্রথম লেগের ম্যাচেও। বেঙ্গালুরু এফসি-কে ১-০ গোলে হারায় তারা। এই ফলগুলোই সমর্থকদের মনে আশা জাগিয়েছিল, হয়তো ক্রমশ প্রথম চারের দিকে এগিয়ে যাবে তাদের দল। কিন্তু বেঙ্গালুরুকে হারানোর পরে লিগের শেষ দশ ম্যাচে মাত্র একটিতে জেতায় ও পাঁচটিতে হেরে যাওয়ায় সেই আশা আর পূরণ হয়নি তাদের। 

ব্যর্থতার ময়না-তদন্ত

আসলে হিরো আইএসএলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় তাদের প্রস্তুতিতেও ভাটা পড়ে। যেখানে অন্য দলগুলি অন্তত পাঁচ ছয় সপ্তাহের প্রস্তুতি শিবির করেছে, সেখানে তারা মাত্র দুই সপ্তাহ অনুশীলন করেই মাঠে নামে। এই ঘাটতিটা পূরণ করতেই তাদের আরও কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। আর এই কয়েক সপ্তাহেই তারা অন্য দলগুলির চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। তা ছাড়া তাড়াহুড়োতে দল বাছাইয়েও অনেক ফাঁকফোকর থেকে যায়।

কোচ রবি ফাউলার সে কথা স্বীকার করে বলেন, “অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু আসল কথা হল, আমরা মাত্র দু’সপ্তাহ প্রস্তুতির সুযোগ পেয়েছি। তা ছাড়া আমাদের দলটা তৈরি হয়েছিল আই লিগের কথা ভেবে। আমি কোনও অজুহাত দিচ্ছি না বা কারও ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছি না। কেন আমরা সফল হতে পারিনি, আমি তার কারণগুলো বলছি। সব দলই মরশুমে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের অনেকটা সময়ই খারাপ গিয়েছে। কারণ, অনেকগুলো সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে যায়নি। প্রতি ম্যাচেই আমরা সবচেয়ে আমাদের হাতে থাকা শক্তিশালী দলই নামিয়েছি। (নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে) ব্রাইট, পিলকিংটন খেলতে পারেনি চোটের জন্য। যাদের নামিয়েছিলাম, তারাই তখন আমাদের হাতে থাকা সেরা ফুটবলার”।

তা সত্ত্বেও অবশ্য সে ভাবে সাফল্যের মুখ দেখতে পায়নি দলটা। ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন তারকা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মনে করেন, টিমগেমের অভাব, ফিটনেসের অভাব ও বিদেশিদের পারফরম্যান্স ভাল না হওয়ায় দলটা এই মরশুমে সাফল্য পেল না। বাংলা দৈনিক ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ তিনি লিখেছেন, “এসসি ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে কোনও টিমগেমই দেখতে পেলাম না। কোনও সময় মনে হয়নি দলটার মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। কয়েকটা ম্যাচে দারুণ পারফরর্ম করেছে ওরা। কিন্তু অধিনাংশ সময়ে লাল-হলুদ দলটাকে মনে হচ্ছিল ছন্নছাড়া একটা টিম, যারা কেউ কাউকে চেনে না”।

ফিটনেস নিয়ে ইস্টবেঙ্গলের ‘ঘরের ছেলে’ বলে পরিচিত মনোরঞ্জনের বক্তব্য, “খুব বেশি দিন প্রস্তুতির সময় পায়নি লাল-হলুদ। তা ছাড়া লক ডাউনের জন্য অনেক ফুটবলারই অনেক দিন বাদে ফুটবল মাঠে নেমেছিল। ফলে এসসি ইস্টবেঙ্গলকে দেখে মনে হচ্ছিল দলটা ফিটনেসের অভাবে ভুগছে। অনেক ম্যাচেই দেখছিলাম দ্বিতীয়ার্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে লাল-হলুদ ফুটবলাররা। আর ফুটবলাররা একশো শতাংশ ফিট না হলে আইএসএলে দারুণ কিছু করা মুশকিল”।

বিদেশিদের নিয়ে এই ক্লাবের প্রাক্তন কোচ ও খেলোয়াড় মনোরঞ্জনের মত, “একমাত্র বাইট ইনোবাখারেই যা দুর্দান্ত কিছু পারফরম্যান্স দিল। অ্যান্থনি পিলকিংটন প্রিমিয়ার লিগে চুটিয়ে খেলেছে। ড্যানি ফক্সের সিভিও দারুণ। কিন্তু ফক্স-পিলকিংটনরা কেউই কিছু করতে পারল না। পরের মরশুমে তাই অর্ধেক বিদেশি পাল্টানো দরকার। কিন্তু ব্রাইটের মতো প্রতিভাকে ছাড়া উচিত নয়”। এ ছাড়া কোচের কৌশলেও গলদ ছিল বলে মনে করেন মনোরঞ্জন।

আর এক প্রাক্তন ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত মনে করেন, “দু-আড়াই মাসের লম্বা লিগে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির সুযোগ পাওয়া বা বোঝাপড়া গড়ে না ওঠার যুক্তি খাটে না। দল দিনের পর দিন এগিয়ে থেকে ম্যাচ হেরেছে বা ড্র করেছে। শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে ম্যাচ ড্র বা হেরে যাওয়াটা বারবার মেনে নেওয়া যায় না”। বাংলা দৈনিক ‘আজকাল’-এ এমনই লিখেছেন সুরজিৎ।

কী থেকে কী হল?

জানুয়ারির দলবদলে একাধিক ভাল ফুটবলার দলে নিয়ে আসে লাল-হলুদ শিবির, যাঁরা আসার ফলে দলটার চেহারা অনেকটাই বদলায়। নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ব্রাইট ইনোবাখারে, ডিফেন্ডার রাজু গায়কোয়াড়, অঙ্কিত মুখার্জির পর দ্বিতীয় দফায় আসেন গোলকিপার সুব্রত পাল, ডিফেন্ডার সার্থক গলুই ও মিডফিল্ডার সৌরভ দাস। এঁরা আসায় দলের রক্ষণ ও মাঝমাঠ অনেক শক্তিশালী হয়। পিলকিংটন, জাক মাঘোমার সঙ্গে ব্রাইট আক্রমণেও শক্তি বাড়ান। তা সত্ত্বেও সাফল্য তাদের হাতে ধরা দেয়নি।

জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধে দলে ছ-ছ’টি পরিবর্তন করে একেবারে অন্য এসসি ইস্টবেঙ্গলকে খুঁজে পাওয়া যায়। রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করে সেই ম্যাচে ২-১ জয় পায় তারা। শুরুতেই ম্যাটি স্টাইনমানের গোলে এগিয়ে যায় দল। ৬৮ মিনিটে স্টাইনমানের অ্যাসিস্টেই ব্যবধান বাড়ান পিলকিংটন। ওই ম্যাচে সারাক্ষণই লাল-হলুদ বাহিনীর দাপট ছিল অব্যহত। লিগ টেবলে ছয় নম্বরে থাকা জামশেদপুর এফসি-কে একবারের জন্যও ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েনি তারা।

পরের ম্যাচে হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এগিয়ে থাকার পর ১-১ ড্র করে তারা। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে প্রায় হাতের মুঠোয় আসা তিন পয়েন্ট হাতছাড়া করে মাঠ ছাড়তে হল লাল-হলুদ বাহিনীকে। কিন্তু কলকাতা ডার্বির দ্বিতীয় লেগে ১-৩ গোলে হারই তাদের মেরুদন্ড প্রায় ভেঙে দেয়। আর জয়ের মুখ দেখা হয়নি তাদের।