ফাইনাল ম্যাচটা যুবভারতীতে হলে বোধহয় ৬০ হাজার মানুষের চিৎকারে চারদিকের বাড়িগুলির দেওয়ালে ফাটল ধরে যেত। সুদূর মারগাওয়ে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে কুড়ি হাজার মানুষের চিৎকারই যেরকম তুঙ্গে ওঠে, তাতেই বোঝা যায়, সে দিন গোয়ার স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে কত সবুজ-মেরুন সমর্থক ছিলেন।

আসলে মুহূর্তটাই ছিল সে রকম। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলায় ১৪ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। প্রথমার্ধের একেবারে শেষ মিনিটে পেনাল্টি থেকেই গোল শোধ করেন সুনীল ছেত্রী। ৭৮ মিনিটে কর্নারে হেড করে দলকে এগিয়ে দেন প্রাক্তন সবুজ-মেরুন তারকা রয় কৃষ্ণা। কিন্তু ৮৫ মিনিটের মাথায় ফের পেনাল্টি পায় এটিকে মোহনবাগান ও তা থেকে ফের সমতা আনেন পেট্রাটস। ২-২ হওয়ার পরেও জয়সূচক গোলের একাধিক সুযোগ হাতছাড়া করে তারা।

অতিরিক্ত সময় গোলশূন্য থাকার পরে ম্যাচ পেনাল্টি শুট আউটে গড়ায়। এটিকে মোহনবাগানের দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, লিস্টন কোলাসো, কিয়ান নাসিরি ও মনবীর সিং একের পর এক গোল করে চলে যান। তাঁদের গোলকিপার গোল্ডেন গ্লাভজয়ী বিশাল কয়েথ প্রথমে বেঙ্গালুরুর ব্রুনো সিলভার শট আটকাতেই জয়ের উল্লাস শুরু হয় গ্যালারিতে। শেষে সুনীল ছেত্রীর দলের মিডফিল্ডার পাবলো পেরেজ বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দিতেই প্রায় শব্দের বিষ্ফোরণ ঘটে জওহরলাল নেহরু স্টেডেয়ামে। এ রকম একটা কষ্টার্জিত অথচ অনিশ্চয়তায় ভরা জয়ের পর এমন প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। আর বঙ্গ ফুটবলপ্রেমীরা যে ফুটবলের জন্য পাগল, সে তো সারা দুনিয়া জানে।

 নয় মরশুমে এই নিয়ে চারবার হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের খেতাব এল কলকাতায়। ২০১৪-য় প্রথমবার, ২০১৬ ও ২০১৯-২০-তে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এটিকে এফসি। দুই মরশুম অপেক্ষার পর ফের কলকাতা তাদের প্রিয় দল এটিকে মোহনবাগানকেও চ্যাম্পিয়ন হতে দেখে নিল। তাই এই উল্লাস একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। ফতোরদা স্টেডিয়ামে শুধু নয়, সারা বাংলা, ভারত জুড়ে আনাচে কানাচে সর্বত্র সে দিন সবুজ-মেরুন বাহিনীর সাফল্য উদযাপন করেন এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের সমর্থকেরা।

লিগ পর্বের চড়াই-উতরাই

এ বারের লিগের শেষটা যে রকম রোমহর্ষক ও ধারাবাহিক সাফল্য দিয়ে করেছে চ্যাম্পিয়ন এটিকে মোহনবাগান, লিগ পর্বে তাদের চলার পথ কিন্তু এতটা মসৃণ ছিল না। এমনকী প্লে অফ পর্বেও ফাইনালের আগে তাদের পারফরম্যান্স সমর্থকদের বেশ চিন্তায় রেখেছিল। কেন চিন্তায় রাখবে না? দুই সেমিফাইনালের একটিতেও নির্ধারিত সময়ে কোনও গোল করতে পারেনি তারা। হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে প্রথম লেগে ০-০ করার পরে দ্বিতীয় লেগেও একই ফলে শেষ করে তারা। অতিরিক্ত সময়েও কোনও গোল করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পেনাল্টি শুট আউটে ৪-৩ জিতে ফাইনালে ওঠে তারা।

একটা সময় যে রকম গোলখরা দেখা গিয়েছিল এটিকে মোহনবাগান শিবিরে, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল আদৌও তারা প্লে-অফ পর্বে উঠতে পারবে কি না। কিন্তু লিগের শেষ বেলায় সঠিক ছন্দ ও ফর্মে ফিরে আসায় অবশেষে বাজিমাত করেন পেট্রাটস, হুগো বুমৌসরা। তাদের লিগপর্বের দৌড় সমর্থকদের কখনওই খুব একটা স্বস্তি দেয়নি। এই জয় তো এই হার, এই কার্ড সমস্যা তো এই চোট-আঘাত। দুই বিদেশি ফুটবলার জনি কাউকো ও ফ্লেরোন্তিন পোগবাকে চোটের জন্য দেশে ফেরতও পাঠিয়ে দিতে হয়। ফলে ধারাবাহিকতার অভাব খুব বেশি রকমই ছিল তাদের।

মুম্বই সিটি এফসি যেমন লিগপর্বে টানা ১৮টি ম্যাচে অপরাজিত (১৪টি জয় ও চারটি ড্র) থাকার পর শেষ দুই ম্যাচে হারে, এটিকে মোহনবাগান তার ধারকাছ দিয়েও যায়নি। লিগে দু’বার টানা চারটি করে ম্যাচে অপরাজিত থাকে তারা। এটাই এবারের লিগে তাদের সবচেয়ে ধারাবাহিক হওয়ার নমুনা। ঘরের মাঠে চেন্নাইন এফসি-র কাছে ১-২-এ হার দিয়ে শুরু করে তারা। তবে পরের ম্যাচেই দুর্দান্ত ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় তারা এবং কোচিতে গিয়ে কেরালা ব্লাস্টার্সকে ৫-২-এ হারিয়ে আসে।

এই দুর্দান্ত জয়ের আত্মবিশ্বাসই তাদের পরের তিনটি ম্যাচেও অপরাজিত থাকতে সাহায্য করে। যার মধ্যে চিরপ্রতিদ্বন্দী ইস্টবেঙ্গল এফসি-র বিরুদ্ধে জয় ও মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ড্র-ও ছিল। এফসি গোয়ার কাছে ০-৩ হারটা ছিল তাদের দ্বিতীয় অ্যালার্ম বেল। পরের তিনটি ম্যাচে তারা ফের জেতে এবং চতুর্থটিতে ড্র করে। হায়দরাবাদ এফসি, বেঙ্গালুরু এফসি ও জামশেদপুর এফসি-কে হারায় তারা। ড্র করে ওডিশার বিরুদ্ধে। ফের একটা ধাক্কা আসে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে। তাদের কাছে হারেন প্রীতম কোটালরা।

এর পরের ন’টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র চারটিতে জেতে তারা। দুটিতে ড্র ও তিনটিতে হার। হায়দরাবাদে গিয়ে ফিরতি লিগে হারের পর তাদের সামনে শেষ দুই ম্যাচ (ফিরতি ডার্বি-সহ) হয়ে ওঠে নক আউটের মতো। জিততে পারলে প্লে অফে উঠতে পারবে তারা, না পারলে ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই ছিল। সেই জায়গা থেকে প্লে অফে পৌঁছে চ্যাম্পিয়নের ট্রফিও জিতে নেয় তারা। এই অভিযান সত্যিই মনে রাখার মতো।

শক্তি যখন রক্ষণ, দুর্বলতা আক্রমণ 

শুরুর দিকে খুব একটা শক্তিশালী না হলেও ক্রমশ ইস্পাতকঠিন হয়ে ওঠে সবুজ-মেরুন রক্ষণ। লিগ পর্বে সবচেয়ে কম গোল খাওয়ার দিক থেকে তারা ছিল দুই নম্বরে, হায়দরাবাদ এফসি-র পরেই। গতবারের চ্যাম্পিয়নরা যেখানে ১৬টি গোল খেয়েছিল, সেখানে এ বারের চ্যাম্পিয়নরা খায় ১৭টি। ১২টি ম্যাচে তারা কোনও গোলই খায়নি। লিগে ন’টি ও প্লে-অফে তিনটি ক্লিনশিট-সহ শেষ করে তারা। মাত্র একটি ম্যাচে দুইয়ের বেশি গোল খেয়েছিল, গোয়ার বিরুদ্ধে ০-৩ হারে।

খামতি একটা নয়, একাধিক। আগামী মরশুমে বেশ কয়েকটি ব্যাপারে নিজেদের শোধরাতে হবে সবুজ-মেরুন শিবিরকে। দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও হুগো বুমৌসের মতো গোলস্কোরার থাকতেও এ বারের হিরো আইএসএলে সব মিলিয়ে ২৪টির বেশি গোল করতে পারেনি এটিকে মোহনবাগান। লিগ পর্বে গোল করার দিক থেকে ইস্টবেঙ্গল এফসি, জামশেদপুর এফসি ও নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র ওপরে, আট নম্বরে ছিল তারা।

এই মরশুমে দলের ২৮টি গোলে অবদান রাখেন দলের আক্রমণ বিভাগের দুই প্রধান স্তম্ভ পেট্রাটস ও বুমৌস। তাঁরা ১৭টি গোল করেন ও ১১টি করান। মোট ন’টি ম্যাচে কোনও গোলই করতে পারেনি এটিকে মোহনবাগান। আসলে গতবারে সফল হওয়া লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংরা এ বার ব্যর্থ হওয়ায় দলের গোলের সংখ্যা অনেক কমে যায়। আশিক কুরুনিয়ান, কিয়ান নাসিরি, ফেদরিকো গায়েগোরাও গোল করতে পারেননি, যা গোলের সংখ্যার দিক থেকে তাদের অনেক নীচে টেনে নামিয়ে আনে।

এমন নয় যে আক্রমণে উঠতে পারেনি বা গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি তারা। বরং প্রচুর সুযোগ তৈরি করেছেন কোলাসোরা। এই ব্যাপারে মুম্বই সিটি এফসি-র পরেই দু’নম্বরে তাদের জায়গা। মোট ২৬০টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছে তারা। কিন্তু সেই সুযোগগুলোকে গোলে পরিণত করার দিক থেকে আট নম্বরে। মাত্র ২৮টি গোল ছিল তাদের ঝুলিতে। শুরুর দিকে ফেরান্দোর আশা ছিল, গোলের সুযোগ যখন তাঁর দলের ছেলেরা পাচ্ছেন, তখন গোল আসতে শুরু করবেই, কোলাসোরাও গোল পাবেন। কিন্তু সে আর হল না। ফলে পুরো চাপটাই এসে পড়ে পেট্রাটস, বুমৌসদের ওপর। আগামী মরশুমে দুই তারকার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাতে হবে সবুজ-মেরুন বাহিনীকে। গোলের কনভারশন রেট ও গোলের সংখ্যাও বাড়াতে হবে তাদের।

সেরা তারকা

বিশাল কয়েথ, গোলকিপার

গত মরশুমের পর চেন্নাইন এফসি থেকে বিশালকে গোলকিপার হিসেবে নিয়ে আসে সবুজ-মেরুন বাহিনী। এ মরশুমে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখান তিনি। ধারাবাহিক ভাবে টানা ভাল খেলে যান তিনি। গোলের নীচে অতন্দ্র প্রহরায় ছিলেন তিনি। একাধিক অবধারিত গোল বাঁচিয়ে যেমন দলকে বহু হারের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তিনি, তেমনই একাধিক পেনাল্টি সেভ করেছেন। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ও ফাইনালে দলের জয়ে তাঁর ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। টাই ব্রেকারে তিনি সেভ করে দলক জিতিয়ে দেন। নজির সৃষ্টিকারী এক ডজন ক্লিন শিট রেখে গোল্ডেন গ্লাভও জেতেন তিনি। ফুটবল জীবনে তাঁর সেরা মরশুমে মোট বিপক্ষের মোট ৮৬টি গোলমুখী শটের মধ্যে ৬৭টি সেভ করেছেন তিনি। সেভের সংখ্যায় বেঙ্গালুরু এফসি-র গোলকিপার গুরপ্রীত সিং সান্ধুর (৭১) পরেই তিনি। সেভ পার্সেন্টেজের (৮২%) দিক থেকেও বিশাল দু’নম্বরে, হায়দরাবাদের গুরমিত সিংয়ের পরেই।

সেরা উঠতি তারকা

লালরিনলিয়ানা হ্নামতে

প্রথম এগারোয় বেশি পরিবর্তনে বিশ্বাসী নন দলের কোচ হুয়ান ফেরান্দো। নিরুপায় না হলে ঘনঘন পরিবর্তন করেনও না তিনি। কিন্তু এ বার তাঁর রিজার্ভ বেঞ্চের একজনকে তিনি বারবার মাঠে নামিয়েছেন তাঁর প্রতিভাকে কাজে লাগানোর জন্য। এবং তাঁর এই সিদ্ধান্তের প্রতিদানও দিয়েছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার লালরিয়ানা হ্নামতে। ফাইনাল-সহ প্লে-অফের সব ম্যাচেই তাঁকে পরিবর্ত হিসেবে নামান ফেরান্দো। সব মিলিয়ে ১৩টি ম্যাচে ডাগ আউট থেকে তাঁকে নামান কোচ। হ্নামতের মধ্যে যে গতি রয়েছে, কখন কোথায় থাকতে হবে, তার জ্ঞান রয়েছে এবং ট্যাকল করার যে দক্ষতা রয়েছে, তা বেশ পছন্দ হয়েছে দলের কোচ ও ফুটবলপ্রেমীদের। মোট ২২৯ মিনিটের উপস্থিতিতে ১১টি ট্যাকল, সাতটি ইন্টারসেপশন ও ছ’টি ব্লক ও একটি ক্লিয়ারেন্স রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।

আগামী মরশুমে যা প্রয়োজন

এ মরশুমে যে ভাবে চোটে পেয়ে নির্ভরযোগ্য তারকারা ছিটকে যান দল থেকে এবং জানুয়ারির দলবদলের ওপর অনেকটাই নির্ভর করতে হয় এটিকে মোহনবাগানকে, তা মোটেই কাঙ্খিত ছিল না। চোট-আঘাতের বিষয়টি (ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট) আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। খেলোয়াড়রা অনর্থক অতিরিক্ত ঝুঁকি নিচ্ছেন কি না, সেই ব্যাপারে কোচকে খতিয়ে দেখতে হবে। তা ছাড়া মরশুমের শুরুতেই এমন দল গড়া দরকার, যার গভীরতা থাকবে এবং জানুয়ারির দলবদলের ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে না।

গোল করার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ স্ট্রাইকারও দরকার এই দলে। দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও হুগো বুমৌস জুটির ওপর বড্ড বেশি নির্ভরশীল গোটা দলটা। ২৮টি গোলের মধ্যে ২৪টিতে এই দুই তারকার অবদান রয়েছে। ফলে বোঝাই যায়, এঁদের ওপর প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই নির্ভরশীল সবুজ-মেরুন বাহিনী। এই বিষয়ে ম্যানেজমেন্টকে ভাবতে হবে। বুমৌস এ বার সব ম্যাচেই যে ভাল খেলেছেন, তা নয়। সেই সব ম্যাচে পেট্রাটসের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। আগামী মরশুমে পেট্রাটস সম্পর্কে আরও বিস্তারিত চর্চা করে নামবে অন্য দলগুলি। ফলে তাঁকে আটকানোর উপায়ও পেয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে দলের আক্রমণে কোনও নতুন সদস্য দরকার, যার ব্যাপারে বেশি জানা নেই প্রতিপক্ষদের।