ছবি: এটিকে মোহনবাগানের টুইটার হ্যান্ডলের সৌজন্যে

স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের সামনে যেমন তৃতীয় হিরো আইএসএল খেতাব জয়ের হাতছানি, তেমনই প্রথম মরশুমকে স্মরণীয় করে রাখার সুযোগ এটিকে মোহনবাগানের সামনে। যে ফুটবলারদের নিয়ে দল প্রস্তুত করছেন হাবাস, তাতে সেই লক্ষ্য পূরণ হওয়া বোধহয় অসম্ভব নয়। তবে তাদের যে এ বার কঠিন পরীক্ষার সামনে পড়তে হবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, গত মরশুমে চ্যাম্পিয়ন দলের ফুটবলারদের পারফরম্যান্স নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তাতে তাঁদের শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে জানতে আর কিছু বাকি নেই।

হিরো আইএসএল ৭-এর প্রথম ম্যাচে তারা কেরালা ব্লাস্টার্সের মুখোমুখি হবে আগামী শুক্রবার। তার আগে সব জায়গাগুলো শক্তপোক্ত করে নিচ্ছে এটিকে মোহনবাগান শিবির। গতবার এটিকে এফসি দলে যাঁরা খেলেছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগই এ বার এই দলে রয়েছেন। বদল এসেছে মাত্র কয়েকটা জায়গায়।

রক্ষণেই বেশিরভাগ বদল এসেছে। তিন বছর পরে কলকাতার দলে ফিরেছেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার তিরি। হিরো আইএসএলে যাঁর এ পর্যন্ত ৭২টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে। যাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ৭৫ শতাংশ। প্রথম দুই মরশুমে এটিকে এফসি-র হয়ে খেলেছিলেন। ২০১৬-য় দলকে চ্যাম্পিয়নও করেন। তার পরে চলে গিয়েছিলেন জামশেদপুরে। সেখান থেকে এ বার কলকাতায় ফিরে এসেছেন হাবাসের তত্ত্বাবধানে খেলার জন্য।

হিরো আইএসএলের আর এক অভিজ্ঞ তারকা সন্দেশ ঝিঙ্গন। কেরালা ব্লাস্টার্সে ছ’বছর কাটানোর পরে গত মে মাসে তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে তাঁর। চোটের জন্য গত মরশুমে খেলতেই পারেননি তিনি। টানা ছ’বছর কেরালার ক্লাবের হয়ে মাঠে নেমেছেন। পাশপাশি ভারতীয় দলেরও নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১৬-র হিরো আইএসএলে দলকে ফাইনালেও তুলেছিলেন তিনি। তবে এটিকে এফসি-র কাছে হেরে যান। ২০১৭-১৮ সালে দলের অধিনায়ক ঘোষণা করা হয় তাঁকে। কেরালা ব্লাস্টার্সের রক্ষণে রীতিমতো দুর্ভেদ্য দেওয়াল হয়ে ওঠেন তিনি। সে বার তাঁর দল মাত্র ২২টি গোল খেয়েছিল, হেরেছিল মাত্র পাঁচটি ম্যাচে। গত মরশুমে কেরালার দল তাঁর অনুপস্থিতিতে ৩২ গোল খেয়ে লিগ তালিকায় সাত নম্বর জায়গাটা নেয়। এ বার সেই ঝিঙ্গন চোট সারিয়ে ফিরছেন কলকাতার দলে।  

মোহনবাগানের প্রাক্তনী শুভাশিস বসুও গত দু’বছর মুম্বই সিটি এফসি-তে খেলার পরে এ বার ফিরে আসছেন তাঁর পুরনো জার্সিতে। শুভাশিস হিরো আইএসএলে তাঁর অভিযান শুরু করেন বেঙ্গালুরুর এফসি-র সঙ্গে। ২০১৭-১৮ মরশুমে তিনি হিরো আইএসএল ফাইনাল-সহ ১৮টি ম্যাচে খেলেন। পরের বছর শুভাশিসকে ডেকে নেয় মুম্বই সিটি এফসি। তাদের হয়ে দু’বছরে ৩৪টি ম্যাচ খেলেন শুভাশিস। তিন বছর বাইরে থাকার পরে এ বার বাংলায় ফিরে আসছেন তিনি।

অর্থাৎ, প্রবীর দাস, প্রীতম কোটাল, অরিন্দম ভট্টাচার্য, প্রণয় হালদারের পাশাপাশি এটিকে মোহনবাগান দলে যোগ দিলেন আর এক সফল বাঙালি ফুটবলার। বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এর চেয়ে ভাল খবর আর কীই বা হতে পারে? নতুনদের পাশাপাশি গতবারে এটিকে এফসি দলে থাকা প্রীতম, সুমিত রাঠি, প্রবীর দাসরা তো রয়েছেনই। তাই গত বারের চেয়ে এ বার এটিকে মোহনবাগানের ডিফেন্স অনেক বেশি মজবুত হবে বলেই আশা করা যায়।

গতবার যাঁরা হাবাসের দলের মাঝমাঠ সামলেছিলেন, সেই এডু গার্সিয়া, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ, কার্ল ম্যাকহিউ, জয়েশ রানে, মাইকেল সুসাইরাজ, রেজিন মাইকেল, প্রণয় হালদারদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন অস্ট্রেলীয় তারকা ব্র্যাডেন ইনম্যান। মাঝমাঠে তিনি বেশ ক্ষিপ্র ও কার্যকর ফুটবলার। এ বার তিনি এটিকে মোহনবাগানের মাঝমাঠে থাকলে দলের চেহারা অনেক বদলে যেতে পারে।

গত আই লিগে চার্চিল ব্রাদার্সের হয়ে খেলা মিডফিল্ডার গ্ল্যান মার্টিন্সও এ বার কলকাতার দলে নতুন। অন্য দিকে গত আই লিগে মোহনবাগানের হয়ে খেলা শেখ শাহিলও এ বার এটিকে মোহনবাগানের মাঝমাঠে অন্যতম অঙ্গ। রক্ষণের মতো মাঝমাঠেও একের পর এক প্রতিভাবান, অসাধারণ খেলোয়াড়। একদিকে, হাবাসকে যেমন প্রথম এগারো বাছতে প্রতি ম্যাচে যথেষ্ট বেগ পেতে হতে পারে, অন্যদিকে, তাঁর রিজার্ভ বেঞ্চও এতটাই শক্তিশালী থাকবে যে, চোট-আঘাত না থাকলে পরিবর্ত খেলোয়াড় নিয়ে তাঁকে একেবারেই চিন্তায় থাকতে হবে না।

হাবাস অবশ্য বলে থাকেন, “এমন ভাবে আমি দলকে তৈরি করার চেষ্টা করি, প্রত্যেক খেলোয়াড়ই যাতে সুযোগ পেলে নিজের সেরাটা মেলে ধরতে পারে এবং দলের কাছে কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে। দীর্ঘ লিগে চোট-আঘাত, কার্ড সমস্যা থাকবেই। ফলে সব পজিশনে যোগ্যতম পরিবর্ত খেলোয়াড় রাখা খুবই জরুরি। কারও ছেড়ে যাওয়া জায়গা যাতে অন্য কেউ এসে পুরোপুরি ভাবে ভরাট করে দিতে পারে, সেটাই মাথায় রেখে ছেলেদের প্রস্তুত করি আমি”।  

রয় কৃষ্ণা ও ডেভিড উইলিয়ামসের স্ট্রাইকার জুটি গত মরশুমে সুপারহিট হয়ে গিয়েছিল। এ বার তাঁরা এটিকে মোহনবাগানের জার্সি গায়ে মাঠ মাতাবেন, এমন আশা করাই যায়। গতবার এটিকে এফসি-র দুই স্ট্রাইকারকে দুই উইং ব্যাক প্রবীর ও সুসাইরাজ এতটাই ভাল সহায়তা দিয়েছিলেন যে মাঝমাঠে গার্সিয়া, হার্নান্ডেজরা অনেকটাই চাপমুক্ত হয়ে খেলতে পেরেছিলেন। এ বারও সে রকমই হতে পারে।

রয়, ডেভিডরা সঙ্গে পাচ্ছেন এক প্রতিভাবান স্ট্রাইকার মনবীর সিংকে। তিন বছর এফসি গোয়ার হয়ে খেলার পরে এ বার পঞ্জাবের মনবীর যোগ দিয়েছেন এটিকে মোহনবাগানে। ২০১৬-১৭ মরশুমে তিনি মহমেডান স্পোর্টিংয়ের হয়ে খেলেছিলেন। সে বার বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিও খেলেন তিনি। এবং ফাইনালে গোল করে বাংলাকে চ্যাম্পিয়নও করেন। গত মরশুমে হিরো আইএসএলে ১৯টি ম্যাচ খেলেন এবং দু’টি খুব গুরুত্বপূর্ণ গোল করে গোয়ার দলকে লিগ তালিকায় সবার উপরে থাকতে সাহায্য করেন। এ বার সেই মনবীরকে পাচ্ছে এটিকে মোহনবাগান। রয়-ডেভিডের সঙ্গে যিনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আক্রমণে উঠতে পারেন বলে অনেকের বিশ্বাস।

গোলপ্রহরী অরিন্দম ভট্টাচার্য গতবার ফাইনাল-সহ একাধিক ম্যাচে এটিকে এফসি-র জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ বার এটিকে মোহনবাগানে তাঁর সামনে আরও দুর্ভেদ্য ডিফেন্স থাকায় তাঁর কাজটা কিছুটা হলেও সোজা হয়ে উঠতে পারে।

সব মিলিয়ে দুর্দান্ত একটা দল নিয়ে এ বারের হিরো আইএসএলে নামছেন হাবাস। তবে গতবারের চ্যাম্পিয়ন দলের ফুটবলারদের নিয়ে যে বিপক্ষরা বাড়তি হোমওয়ার্ক করেই মাঠে নামবে, এমনটা ধরে নেওয়াই যায়। তাই এ বার তাদের পক্ষে কাজটা আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

স্কোয়াড:

গোলকিপার: অরিন্দম ভট্টাচার্য, ধীরজ সিং, অভিলাষ পাল, আর্শ শেখ, আরিয়ান নিরজ লাম্বা

ডিফেন্ডার: তিরি, প্রীতম কোটাল, প্রবীর দাস, সন্দেশ ঝিঙ্গন, শুভাশিস বসু, সুমিত রাঠি

মিডফিল্ডার: প্রণয় হালদার, ব্র্যাডেন ইনম্যান, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ, এডু গার্সিয়া, কার্ল ম্যাকহিউ, গ্ল্যান মার্টিন্স, জয়েশ রানে, মাইকেল সুসাইরাজ, বরিস সিং, রেজিন মাইকেল, শেখ সাহিল, এন ইংসন সিং

ফরোয়ার্ড: ডেভিড উইলিয়ামস, রয় কৃষ্ণা, মনবীর সিং, মহম্মদ ফারদিন আলি মোল্লা   

ক্রীড়াসূচি:

বনাম কেরালা এফসি – ২০ নভেম্বর

বনাম এসসি ইস্টবেঙ্গল – ২৭ নভেম্বর

বনাম ওডিশা এফসি – ৩ ডিসেম্বর

বনাম জামশেদপুর এফসি – ৭ ডিসেম্বর

বনাম হায়দ্রাবাদ এফসি – ১১ ডিসেম্বর

বনাম এফসি গোয়া – ১৬ ডিসেম্বর

বনাম বেঙ্গালুরু এফসি – ২১ ডিসেম্বর

বনাম চেন্নাইন এফসি – ২৯ ডিসেম্বর

বনাম নর্থইস্ট ইউনাইটেড – ৩ জানুয়ারি

বনাম মুম্বই সিটি এফসি – ১১ জানুয়ারি