এ মরশুমে ১৩৪তম বছরে পা রাখতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী ডুরান্ড কাপ, যা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে রয়ে যাবে চিরকাল। আর এমন এক প্রাচীন টুর্নামেন্টের সঙ্গে যে কলকাতার তিন ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের সম্পর্কও বহু দিনের, এ কথা আলাদা করে না বলে দিলেও চলে।

আগে রাজধানী দিল্লির সবচেয়ে বড় ফুটবল উৎসব ছিল দেশের সেনাবাহিনী দ্বারা আয়োজিত এই টুর্নামেন্ট। কিন্তু টুর্নামেন্টের আয়তন বৃদ্ধি করার উদ্দেশে দিল্লির গণ্ডী ছাড়িয়ে ক্রমশ তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন শহরে, বিশেষত পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে।

দেশের এই অংশ থেকে ক্রমশ এক ঝাঁক ফুটবলার উঠে আসছে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই সাফল্য পাচ্ছে। মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, আসাম, ওডিশায় ফুটবলের জনপ্রিয়তা যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর কলকাতা তো বরাবরই ডুরান্ড কাপের সঙ্গে ছিল, আছে এবং হয়তো থাকবেও।

স্বাধীনতার আগেই সাফল্য

ডুরান্ড কাপের আসরে সবচেয়ে বেশি সফল হলে কলকাতার দুই প্রধান মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ও ইস্টবেঙ্গল এফসি। ১৮৮৮ থেকে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্টে মোট ১৭ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী ও ১৬ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাল-হলুদ ব্রিগেড। তবে এই তথ্যটি পেয়ে অনেকে অবাক হতে পারেন যে এই দুই ক্লাবের ডুরান্ড জয়ের আগেই এই টুর্নামেন্টে সাফল্য পেয়েছিল মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই মহমেডানের সেই ডুরান্ড কাপ জয় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রভাব ফেলেছিল। সেই সময় ব্রিটিশদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দলকে নিয়েই হত এই টুর্নামেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে বহু সেনা চলে যাওয়ায় সে বার সেনাবাহিনীর বাইরের দলগুলিকেও এই টুর্নামেন্টে খেলার অনুমতি দেওয়া হয় এবং সে বারই প্রথম ডুরান্ড কাপে খেলে ফাইনালেও পৌঁছে যায় সাদা-কালো ব্রিগেড।

দিল্লির আরউইন অ্যাম্পিথিয়েটারে হওয়া সেই ফাইনালে রয়্যাল ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১-এ হারিয়ে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয় মহমেডান এসসি। ১৯১১-য় ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয়ের পরে পরাধীন ভারতে দেশীয় কোনও দলের সবচেয়ে বড় জয় ছিল সেটিই। তার পরে আরও পাঁচবার তারা ডুরান্ড কাপের ফাইনালে উঠেছিল। তবে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছিল একবারই, ২০১৩-য়।

তবে ১৯২৫-এ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সান্মানিক আমন্ত্রণ পেয়েছিল মোহনবাগান ক্লাব। ওই সময়ে ভারতীয় ফুটবলারদের নিয়ে গড়া কোনও অসামরিক দলকে খেলার অনুমতি দেওয়া হত না ডুরান্ড কাপে। মোহনবাগানই প্রথম এই ধরনের দল, যারা এই অভিজাত ফুটবলের আসরে খেলার আমন্ত্রণ পায়। রয়্যাল বার্কশায়ার রেজিমেন্ট, ইয়র্ক ল্যাঙ্কাস্টার রেজিমেন্ট এবং এসেক্স রেজিমেন্টকে হারিয়ে তারা সেমিফাইনালেও ওঠে। কিন্তু ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে শেরউড ফরেস্টের কাছে হেরে যায়।

স্বাধীনতার পর আধিপত্য

দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল ডুরান্ড কাপে নিয়মিত অংশ নিতে শুরু করে। ১৯৫০-এ কিংবদন্তি ফুটবলার তালিমেরেন আও, যাঁকে সবাই টি আও বলে চেনে, তিনি মোহনবাগানকে নেতৃত্ব দেন। সে বার ফাইনালে দলের গোলকিপার চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজেই গোলে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই ফাইনালে জিতে স্বাধীনতার পরে প্রথম ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল হায়দরাবাদ সিটি পুলিস, যাদের কোচ ছিলেন আর এক ফুটবল কিংবদন্তি সৈয়দ আব্দুল রহিম।

১৯৫৩-য় প্রথম এই খেতাব জেতে সবুজ-মেরুন বাহিনী। সে বার ফাইনালে ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিকে ৪-০-য় হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। তবে ইস্টবেঙ্গল প্রথম ডুরান্ড-সেরার শিরোপা অর্জন করে তারও আগে ১৯৫১-য়। পরের বছরেও সেই খেতাব ধরে রেখেছিল লাল-হলুদ বাহিনী। প্রথমবার রাজস্থান আর্মড কনস্টাবুলারিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। পরেরবার তারা হারায় হায়দরাবাদ সিটি পুলিশকে। ১৯৫৬-য় ফের তারা একই প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।

কলকাতার তিন প্রধানের মধ্যে চিরপ্রতিদ্বন্দিতার ইতিহাস সারা বিশ্বে বিখ্যাত। ডুরান্ড কাপেও বহুবার দেখা গিয়েছে সেই চিরকালীন কলকাতা ডার্বি। বিশেষ করে ফাইনালে। ১৯৫৯-এ মহমেডানকে হারিয়েই ডুরান্ড কাপ হাতে তোলে সবুজ-মেরুন বাহিনী। ১৯৮০-তেও মহমেডানকে হারিয়ে ডুরান্ড কাপ জয় করে সবুজ-মেরুন বাহিনী।

বহু ডার্বিতে খেতাবের ফয়সালা

১৯৬০-এর ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, যা বাঙাল-ঘটির লড়াই বলে বাংলার ফুটবলমহলে পরিচিত ছিল। তুমুল লড়াই হয় সেই ফাইনালে। দু’বার তারা মুখোমুখি হওয়ার পরও সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রথমবার ১-১ হওয়ার পর রিপ্লে হয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার গোলশূন্যই থেকে যায় ম্যাচ। তাই সেবার দুই ক্লাবকেই যুগ্মবিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১-এর আগে পর্যন্ত এই ফাইনালের রিপ্লে প্রথা ছিল। ১৯৭১ থেকে পেনাল্টি শুট আউট বা টাইব্রেকার প্রথা চালু হয়।

সেই ফাইনালের চার বছর পর, ১৯৬৪-তেও ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই প্রধান। সে বার ইস্টবেঙ্গলকে ২-০-য় হারিয়ে খেতাব জয় করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। সেই হারের বদলা ইস্টবেঙ্গল নিয়েছিল ১৯৭০-এর ফাইনালে বাগান-বাহিনীকে দু’গোলে হারিয়ে। এর পরে আরও ১২ বার (১৯৭২, ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৬, ১৯৮৯, ১৯৯৪, ১৯৮৬, ১৯৮৯, ১৯৯৪, ২০০৪ ও ২০২৩) ডুরান্ড কাপ ফাইনালে দেখা যায় সেই ঐতিহাসিক কলকাতা ডার্বি।

উত্তর-পূর্বে উজ্জ্বল অতীত, ভবিষ্যৎ

কলকাতার দলগুলির এই সাফল্যই সম্ভবত ডুরান্ড কাপের আয়োজকদের এই টুর্নামেন্ট দিল্লি থেকে সরিয়ে কলকাতায় আনার কথা ভাবার প্রেরণা জোগায়। ২০১৯-এ তাই কলকাতায় সরিয়ে আনা হয় ডুরান্ড কাপকে। ২০২২ থেকে পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের একাধিক শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এই ঐতিহাসিক টুর্নামেন্ট। কারণ, এই অঞ্চলে ফুটবলের জনপ্রিয়তা অপ্রত্যাশিত ভাবে বেড়ে চলেছে এবং এই অঞ্চল থেকেই উঠে আসছে ভারতীয় ফুটবলের নতুন তারকারা।

ভারতীয় দলের হয়ে খেলা লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, আপুইয়া, নাওরেম মহেশ সিং, উদান্ত সিং, নাওরেম রোশন সিং, জিকসন সিং, সুরেশ সিং, বিপিন সিং, চিঙলানসেনা সিং, আশিস রাই-রা সবাই উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকেই উঠে এসেছেন। আর ভারতীয় ফুটবলে তো বাংলার অবদান কেউ কখনও অস্বীকার করতে পারবে না। ডুরান্ড কাপের ইতিহাসও সেই কথাই বলে।

এই ঐতিহাসিক ফুটবলের আসরে মোট ৩০ বার ফাইনালে উঠেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। ইস্টবেঙ্গল উঠেছে ২৭ বার এবং মহমেডান এসসি ছ’বার ফাইনালে খেলেছে। প্রথম দুই ক্লাবেরই টানা তিনবার ডুরান্ড কাপ অর্জনের কৃতিত্ব রয়েছে। তবে মোহনবাগান যেখানে দু’বার খেতাব জয়ের হ্যাটট্রিক করেছে, সেখানে ইস্টবেঙ্গল সেই কৃতিত্ব অর্জন করেছে একবার।

কিংবদন্তি, তারকাদের জন্ম

এই ডুরান্ড কাপ বহু তারকারও জন্ম দিয়েছে। ১৯৭৬-এর ফাইনালে সবুজ-মেরুন শিবিরের তারকা নারায়ণস্বামী উলগানাথন অসাধারণ এক কাণ্ড ঘটান। জেসিটি-র বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে তিনি এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সেটিই ছিল ডুরান্ড কাপের প্রথম হ্যাটট্রিক। ১৯৯৩-এর ডুরান্ড কাপে বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে অসাধারণ এক বাইসাইকেল কিকে গোল করে তাঁর স্মরণীয় ফুটবল কেরিয়ার শুরু করেছিলেন বাইচুং ভুটিয়া। ২০০২-এ দিল্লির সিটি ক্লাবের হয়ে নেমে এই ডুরান্ড কাপেই এক অসাধারণ গোল করে ভারতীয় ফুটবলে তাঁর আগমন ঘোষণা করেন আর এক ফুটবল কিংবদন্তি সুনীল ছেত্রী।

ডুরান্ড কাপে আসর মাতিয়েছে কলকাতার তিন প্রধানই। ২০২০-তে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) কলকাতার দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব যোগ দেওয়ার পর থেকে ডুরান্ডের গুরুত্ব তাদের কাছে আরও বেড়ে গিয়েছে। মরশুমের শুরুতে এই টুর্নামেন্টের পরই শুরু হয়ে এসেছে আইএসএল। তার প্রস্তুতি হিসেবে এই টুর্নামেন্ট এখন প্রতি দলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। এই টুর্নামেন্টেই আইএসএলের ভরপুর প্রস্তুতি সেরে নেয় দেশের প্রথম সারির দলগুলি। তবে ঐতিহ্য, খ্যাতি ও আভিজাত্যের দিক দিয়ে এই টুর্নামেন্টের গুরুত্ব ভারতীয় ফুটবলে কোনওদিনই কমবে না।