ট্রফি জয় দিয়ে নতুন মরশুম শুরু করল আইএসএলের নক আউট চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। রবিবার কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে তারা চিরপ্রতিদ্বন্দী ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে ১-০-য় হারিয়ে জিতে নিল ডুরান্ড কাপের খেতাব। ম্যাচের শেষ ৪০ মিনিট দশ জনে খেলেও রীতিমতো লড়াকু জয় পেল তারা।

তিন সপ্তাহ আগে ডার্বিতে হেরে যায় তারা। সেই হারের বদলা নিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় ১৭তম ডুরান্ড কাপ জিতল ঐতিহ্যবাহী কলকাতার ক্লাব। গত ডার্বিতে হারের ফলে মোহনাবাগানের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিন্তু নিজেদের গোলসংখ্যা ও অন্য দলের ফলের ভিত্তিতে তারা নক আউটে পৌঁছয় এবং টানা চার ম্যাচে জিতে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতে নিল হুয়ান ফেরান্দোর দল।

এ দিন সারা ম্যাচে দুই দলই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। কোনও পক্ষই একে অপরকে নিজেদের গোল এলাকায় এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তেও রাজি ছিল না। ফলে প্রথমার্ধে কোনও দলই একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি। দ্বিতীয়ার্ধে দুই পক্ষই কৌশল বদলায়। যার ফলে ক্রমশ চাপ বাড়াতে শুরু করে গতবারের আইএসএল চ্যাম্পিয়নরা। ৬১ মিনিটের মাথায় মোহনবাগানের উইঙ্গার অনিরুদ্ধ থাপা দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়ে চলে যান। ফলে শেষ ৪০ মিনিট (বাড়তি সময় সহ) তাদের দশজনেই খেলতে হয়।

তবু লড়াই ছাড়েনি সবুজ-মেরুন বাহিনী। ৭১ মিনিটে একক দক্ষতায় দুর্দান্ত এক গোল করে দলকে এগিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। এই গোলেই শেষ পর্যন্ত ফাইনাল ম্যাচ জিতে নেয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। নির্ধারিত সময়ের পর আরও দশ মিনিট বাড়তি সময় পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল এফসি।

এ দিন বল দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা (৫২-৪৮) ও প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি শট গোলে রাখলেও (৩-১) একটিও শট জালে জড়াতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল এফসি। মোহনবাগান সারা ম্যাচে একটিই শট গোলে রাখে এবং সেটি থেকেই গোল করে ম্যাচ ও খেতাব জিতে নেয়। তবে জিততে না পারলেও সারা মরশুমে যে দুই প্রধান সমানে সমানে টক্কর দেবে, তার ইঙ্গিত প্রথম টুর্নামেন্টেই দিয়ে রাখল ইস্টবেঙ্গল

এই নিয়ে ১৭তম ডুরান্ড কাপ ঘরে তুলল সবুজ-মেরুন বাহিনী। দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ফুটবল টুর্নামেন্টে তারা শেষবার খেতাব জেতে ২০০০-এ। সেবার ফাইনালে মাহিন্দ্রা ইউনাইটেডকে গোল্ডেন গোলে হারিয়ে কাপ জেতে। তার পর তিন-তিনবার তারা ফাইনালে উঠেও হেরে যায়। ২০০৪-এ ইস্টবেঙ্গলের কাছে, ২০০৯-এ চার্চিল ব্রাদার্সের কাছে এবং ২০১৯-এ গোকুলাম কেরালা এফসি-র কাছে। ২৩ বছর পরে তারা ফের স্বমহিমায় ফিরল ডুরান্ড জয় করে।

এ দিন নিশু কুমারের জায়গায় মহম্মদ রকিপকে প্রথম এগারোয় রেখে দল নামায় ইস্টবেঙ্গল। অন্যদিকে, মোহনাবগানের প্রথম এগারোয় কিন্তু দেখা যায়নি জেসন কামিংসকে। প্রত্যাশামতোই দুই দলকেই এ দিন শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে পাওয়া যায়। শুরুতেই গোল করে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই যে নেমেছিল দু’পক্ষ, তা তাদের পারফরম্যান্স দেখেই বোঝা যায়।

যদিও আগ্রাসনের দিক থেকে প্রথম ১৫ মিনিটে মোহনবাগানই এগিয়ে ছিল। ফাইনাল থার্ডে তাদেরই দাপট ছিল বেশি। তবে প্রথম ৪৫ মিনিটে কোনও দলই প্রতিপক্ষের গোলে বল রাখতে পারেনি। দুই দলেরই রক্ষণ এতটাই সজাগ ও তৎপর ছিল। মূলত দুই বক্সের মাঝখানেই খেলাটা হয়। বক্সে ঢুকতে পারেননি কোনও দলের অ্যাটাকাররাই।

সল ক্রেসপো, বোরহা হেরেরা-দের যেমন কড়া নজরে রাখেন আনোয়ার আলি, হেক্টর ইউস্তেরা, তেমনই পেট্রাটস, সাদিকু, বুমৌসদের আটকাতে সজাগ ছিলেন খাবরা, চুঙনুঙ্গা, রকিপরা। ৩৫ মিনিটে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান লাল-হলুদ ডিফেন্ডার জর্ডন এলসি, তাঁর জায়গায় নামেন হোসে পার্দো। দুই উইং দিয়ে লাল-হলুদ শিবিরের মহেশ ও নন্দকুমার যতটা ক্ষিপ্র ছিলেন, ততটাই গতিময় ও তৎপর ছিলেন আশিক, সহাল, আশিস, থাপারাও।

প্রথমার্ধের প্রথম ইতিবাচক আক্রমণটি করতে ইস্টবেঙ্গলের লেগে যায় ৪৩ মিনিট, যখন মোহনবাগান বক্সের মধ্যে থেকেই গোলে জোরালো শট নেন সিভেরিও। কিন্তু তা বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। তার আগে বক্সের ডানদিক থেকে আক্রমণ তৈরি করেন রকিপ ও বোরহা। বোরহার গোলমুখী দূরপাল্লার শট ক্লিয়ার হওয়ার পর তা আসে সিভেরিওর পায়ে।

প্রথমার্ধের একেবারে শেষে সাদিকুকে আটকাতে তাঁর শর্টস টেনে ধরেন ক্রেসপো, যা নিয়ে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর জেরে হলুদ কার্ড দেখতে হয় ক্রেসপোকে। অযথা তর্ক করার জন্য বুমৌস ও বোরহাকেও কার্ড দেখান তিনি। পরবর্তী মিনিটেই সিভেরিওকে অবৈধ ভাবে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন থাপা।

মোহনবাগান এসজি-ও গোলের দুর্দান্ত সুযোগ পায় প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ে, যখন বক্সের সামনে বাঁদিক থেকে সহাল মাপা স্কোয়ার পাস করেন দিমিকে। তিনি দ্বিতীয় পোস্টের দিকে গোলের শট নিলেও তা অল্পের জন্য বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। প্রথম ৪৫ মিনিটে কোনও পক্ষই কোনও শট গোলে রাখতে পারেনি। বল দখলের লড়াইয়ে তখন কিছুটা হলেও এগিয়ে (৫৪-৪৬) ছিল মোহনবাগান এসজি, ম্যাচের শেষে যা বদলে যায়।

বিরতির পর দু’মিনিটের মধ্যেই ইস্টবেঙ্গলকে কার্যত গোলের সুযোগ তৈরি করে দেন আনোয়ার। গোলকিপার বিশালকে ব্যাক পাস করতে গিয়ে কার্যত সিভেরিওকে গোলের পাস দিয়ে দেন তিনি। কিন্তু বিশালের অনুমান ক্ষমতা এ যাত্রা বাঁচিয়ে দেয় দলকে। শুরুর দিকে বেশি চাপ ছিল মোহনবাগানের ওপরই। সেই চাপ আরও বাড়াতে ৫৭ মিনিটের মাথায় বোরহার জায়গায় ক্লেটন সিলভাকে নামায় ইস্টবেঙ্গল। এর মধ্যে রেফারির সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়ে হলুদ কার্ড দেখেন লাল-হলুদ কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতও। মোহনবাগান কোচও আক্রমণে শক্তি ও তীব্রতা বাড়াতে মনবীর সিংকে নামান। তবে তুলে নেন লেফট ব্যাক আশিস রাইকে! যার ফলে কার্যত তিন ব্যাকে চলে যায় তারা।

কিন্তু ৬২ মিনিটের মাথায় বড় ধাক্কা খায় মোহনবাগান শিবির। বল দখলের লড়াই করতে গিয়ে সিভেরিওর মুখে কার্যত পা দিয়ে আঘাত করেন থাপা। যার ফলে তাঁকে ম্যাচের দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। যার ফলে ম্যাচের শেষ ৪০ মিনিট (স্টপেজ টাইম-সহ) সবুজ-মেরুন বাহিনীকে দশ জনে খেলতে হয়।

আশিস ও থাপা প্রায় একই সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ায় দলের কৌশলে অনেকটাই পরিবর্তন করতে হয় ফেরান্দোকে। প্রতিপক্ষের রক্ষণের এই দূর্বলতা কাজে লাগিয়েই ইস্টবেঙ্গল আক্রমণের ধার বাড়াতে শুরু করে। ৬৫ মিনিটের মাথায় ডান উইং থেকে নন্দকুমারের বাড়ানো পাসে গোলে শট নেন মহেশ, যা অনায়াসে দখল করে নেন বিশাল। কারণ, শটে তেমন জোর ছিল না।

পাল্টা চাপ বাড়াতে মোহনবাগান এ বার তাঁকে মাঠে নামায়, যাঁকে এ দিন তুরূপের তাস হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন কোচ ফেরান্দো। ৬৮ মিনিটের মাথায় বুমৌসের জায়গায় কামিংসকে নামানো হয় এবং তার তিন মিনিটের মধ্যেই বহু আকাঙ্খিত গোলটি পান পেট্রাটস। ৭১ মিনিটের মাথায় মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে যখন বক্সের সামনে থেকে দূরের পোস্টের দিকে কোণাকুনি শট নেন অস্ট্রেলীয় তারকা, তখন অপ্রত্যাশিত ভাবে তাঁকে আটকাননি কোনও লাল-হলুদ ডিফেন্ডার। এই ভুলেরই খেসারত দিতে হয় ইস্টবেঙ্গলকে। অস্ট্রেলীয় তারকার বাঁ পায়ের শট প্রভসুখন গিলকে পরাস্ত করে সাদিকুর পায়ে লেগে সামান্য গতি বদলে জালে জড়িয়ে যায় এবং যুবভারতীর গ্যালারিতে তখন উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরণ ঘটে (১-০)। পেট্রাটস ছুটে যান গ্যালারির দিকে।

এই গোলের দু’মিনিট পরই তা শোধ করার দুর্দান্ত সুযোগ পান নন্দকুমার শেখর। বাঁ দিক থেকে মহেশের মাপা ক্রসে তিনি হেড করে গোলে বল রাখলেও তা সোজা বিশালের হাতে চলে যায়। ৭৮ মিনিটের মাথায় ইস্টবেঙ্গল এডুইন ভন্সপল, নিশু কুমার ও ভিপি সুহেরকে একসঙ্গে নামায়। মাঠে নেমেই সহালকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন সুহের।

শেষ দশ মিনিটে গোল শোধ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে লাল-হলুদ বাহিনী। ৮৬ মিনিটের মাথায় ভন্সপল ৬ গজের বক্সের সামনে থেকে গোলে শট নিলেও তা দুর্দান্ত ভাবে ব্লক করেন আনোয়ার। ন’মিনিটের বাড়তি সময় দেওয়া হয়, যা লড়াইয়ে ফেরার জন্য অনেকটাই। এই সময়টাকে কাজে লাগানোর চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে ইস্টবেঙ্গল। উত্তেজনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তাদের রিজার্ভ বেঞ্চও। যার জেরে সহকারী কোচ দিমাস দেলগাদোকে লাল কার্ড দেখান রেফারি।

এই সময়ে মোহনবাগান রক্ষণ রীতিমতো দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে। তাই বক্সের বাইরে থেকেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় লাল-হলুদ বাহিনী। ৯৭ মিনিটের মাথায় ক্রেসপোর পাস পেয়ে বক্সের সামনে থেকে গোলে শট নেন ক্লেটন, যা গোলের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। ৯৮ মিনিটে বক্সের সামনে থেকে মহেশের ফ্রি কিকে বল পেলেও নিশু কুমারকে আটকে রাখেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা। এই আক্রমণই ছিল তাদের ম্যাচে ফেরার শেষ সুযোগ। কারণ, ঠিক তার পরেই ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজান রেফারি।

ডুরান্ড কাপ ২০২৩ সন্মান:

সিমলা ট্রফি- মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট (চ্যাম্পিয়ন)

রানার্স-আপ ট্রফি- ইস্টবেঙ্গল এফসি (রানার্স)

গোল্ডেন গ্লাভ- বিশাল কয়েথ (মোহনবাগান এসজি)

গোল্ডেন বুট- ডেভিড লাল্লানসাঙ্গা (মহমেডান এসসি)

গোল্ডেন বল- নন্দকুমার শেখর (ইস্টবেঙ্গল এফসি)