সেরা তিনের মধ্যে দুই দলের লড়াই হলেও শনিবার সন্ধ্যায় কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে ম্যাচটা দেখে কিন্তু তেমন মনে না। যে ভাবে একাধিক গোলের সুযোগ হাতছাড়া করে গোলশূন্য ড্র করল ওডিশা এফসি ও মোহনবাগান এসজি, যে ভাবে তারা বিপক্ষকে ফাইনাল থার্ডে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখায় বেশি মনোনিবেশ করল, তাতে দর্শনীয় ফুটবল হল না। অথচ লিগের সেরা দুই দলের কাছ থেকে তুমুল লড়াই আশা করা হয়েছিল। একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করেও তা কাজে লাগাতে পারেনি মোহনবাগান। ওডিশাকেও কোনও বাড়তি ঝুঁকি নিতে দেখা গেল না।   

এ দিন এই গোলশূন্য ড্রয়ের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হল মুম্বই সিটি এফসি। কারণ, ওডিশা ১৬ ম্যাচে ৩২ পয়েন্ট নিয়ে প্লে অফের দৌড়ে সবার আগে থাকলেও তাদের ঘাড়েই নিঃশ্বাস ফেলছে মুম্বই সিটি এফসি, যারা আগের দিনই চেন্নাইন এফসি-কে হারিয়ে ১৫ ম্যাচে ৩১ পয়েন্ট নিয়ে উঠে আসে দু’নম্বরে। শনিবার জিতলে যারা এই দুই দলকে টপকে শীর্ষে পৌঁছতে পারত, সেই মোহনবাগান রয়ে গেল তিন নম্বরে, ১৫ ম্যাচে ৩০ পয়েন্ট অর্জন করে। ১৪ ম্যাচে ২৮ পয়েন্ট নিয়ে এফসি গোয়া আছে চারে। অর্থাৎ, সবুজ-মেরুন বাহিনীর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করল গোয়ার দল।

এ দিন পূর্ণশক্তির দল নিয়ে নামে মোহনবাগান এসজি। প্রথম দলে ফিরে আসেন আরমান্দো সাদিকু, আশিস রাই, দীপক টাঙরি ও আনোয়ার আলি। তিন ব্যাকেই খেলা শুরু করে তারা। তবে শুরু থেকেই তাদের আক্রমণে তেমন তীব্রতা ছিল না। প্রতিপক্ষকে পরখ করার প্রবণতাই বেশি দেখা যায় মোহনবাগান ফুটবলারদের মধ্যে। তা সত্ত্বেও অবশ্য পাঁচ মিনিটের মধ্যে বক্সের মধ্যে গোল করার মতো সুযোগ পেয়ে যান দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও আরমান্দো সাদিকু দু’জনেই।

অন্যদিকে, ৪-৩-৩-এ শুরু করা ওডিশা এ দিন আহমেদ জাহুর জায়গায় লেনি রড্রিগেজকে মাঝমাঠে রেখে দল নামায়। তারাও শুরু থেকে তীব্র আক্রমণে না গিয়ে ধীরে শুরু করে। যদিও তাদের তরুণ মিডফিল্ডার ইসাকা রালতে ১৫ মিনিটের মধ্যে দু-দু’টি গোলের সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেন। এর মধ্যে একটি শট ছিল লক্ষ্যে, যা আটকে দেন বিশাল কয়েথ। অন্যটিতে কয়েথের ভুল পাস কাজে লাগিয়ে নেন রালতে, যা গোলের বাইরে চলে যায়।

কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে লিগের অন্যতম দুই সেরা দলের দ্বৈরথে শুরুর দিকে বলের দখল বেশি ছিল অতিথি দলেরই পায়ে। তবে প্রথমার্ধের শেষে সেই পরিসংখ্যান ছিল প্রায় সমান সমান। ২৪ মিনিটের মাথায় সাদিকু ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে যে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন, তা ছিল অবাক করার মতো। গোল ও তাঁর মধ্যে যখন শুধু গোলকিপার অমরিন্দর সিং ছিলেন, তখন তিনি গোলকিপারের পাশে বল না ঠেলে বাঁ দিকে এতটাই সরে যান যে, অতটা কঠিন কোণ থেকে গোল করা কঠিন হয়ে যায়। তাঁর শট বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়।

এর পরেও আরও একটি গোলের সুবর্ণ সুযোগ পান সাদিকু। ৩৩ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে থেকে তাঁকে কার্যত গোল সাজিয়ে দেন সহাল আব্দুল সামাদ। কিন্তু বক্সের মাঝখান থেকে তাঁর শট সামনে এসে যাওয়া অমরিন্দরের গায়ে লাগে।

মোহনবাগানের প্রাক্তনী রয় কৃষ্ণা, যিনি সম্প্রতি দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন, তাঁকে এ দিন একটু পিছন থেকে খেলা শুরু করতে দেখা যায়। ম্যাচের প্রথম আধঘণ্টা তিনি অতর্কিত আক্রমণের চেষ্টায় ছিলেন। তবে তাঁকে আটকানোর দায়িত্বে ছিলেন শুভাশিস। ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার দিয়েগো মরিসিও-ও সুযোগ তৈরিতে বেশি মন দেন।

চলতি আইএসএলে ওডিশার সবচেয়ে বেশি (১২) গোল এসেছে প্রথমার্ধের শেষ ১৫ মিনিটে। এই হোমওয়ার্কটা সম্ভবত আগেই করে রেখেছিল তাদের প্রতিপক্ষ। তাই এই সময়ে রয়দের কড়া পাহাড়ায় রাখেন শুভাশিসরা। মাঝমাঠেই আটক হয়ে যাচ্ছিলেন মরিসিওরা। মাঝমাঠে জাহুর অভাব টের পাচ্ছিলেন তাঁরা। ৪৪ মিনিটের মাথায় ৪০ গজ দূর থেকে প্রিন্সটন রেবেলোর নেওয়া শট অনায়াসে ধরে নেন কয়েথ।

তবে প্রথমার্ধের স্টপেজ টাইমে রয়ের পা থেকে বল পেয়ে বক্সে ঢুকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ থেকে গোলে যে শট নেন মরিসিও, তা বারে না লাগলে বিপদে পড়ত মোহনবাগান। তার দু’মিনিট পরেই মরিসিওর ব্যাকহিলে পাওয়া পাসে বক্সের মাথা থেকে গোলের উদ্দেশ্যে শট নেন রালতে, যা অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়। প্রথমার্ধের শেষ দিকে মোহনবাগান রক্ষণের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তাঁরা।      

বিরতির প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যে দু’বার গোলের সুযোগ তৈরি করে মোহনবাগান। প্রথমে পেট্রাটস বক্সের বাইরে থেকে গোলে শট নেন, যা সেভ হয়ে যায়। তার পরেই সাদিকু, যিনি বক্সের মধ্যে কাউকোর পা থেকে বল পেয়ে গোলকিপারের হাতে জমা করে দেন।

এর দশ মিনিট পর পর্যন্ত খেলাটা মূলত হয় মাঝমাঠে। কেউই কাউকে এক ফোঁটা জমি ছাড়তে রাজি ছিল না। ফলে কোনও পক্ষই প্রতিদ্বন্দ্বীদের ফাইনাল থার্জে পৌঁছতে দেয়নি। তবে ৬১ মিনিটের মাথায় কর্নারের পরে পেট্রাটসের কাছ থেকে বল পেয়ে যে ভাবে চেস্ট ট্র্যাপ করে দ্রুত গোলে শট নেন মনবীর, তা ছিল দেখার মতো। দুর্ভাগ্য যে, তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

এর পরবর্তী মিনিটেই ডানদিক দিয়ে শুভাশিস ও ইউস্তেকে ধোঁকা দিয়ে বক্সে ঢুকে দ্বিতীয় পোস্টের দিক দিয়ে গোলে বল রাখার চেষ্টা করেন রয় কৃষ্ণা। এ বারও তা পোস্টের বাইরে চলে যায়। রয় নিজে শট না নিয়ে তাঁর সমান্তরাল লাইনে থাকা অরক্ষিত রালতেকে দিলে হয়তো গোল পেয়ে যেত ওডিশা।

আক্রমণে গতি ও তীব্রতা আনার জন্য ৬৫ মিনিটের মাথায় সাদিকুর জায়গায় কামিংসকে নামান মোহনবাগান কোচ আন্তোনিও হাবাস। তাতে খুব একটা লাভ হয়নি দলের। জেরির সঙ্গে বল দখলের লড়াই করতে গিয়ে তিনি মাথায় আঘাত পেলে যে ফ্রি কিক পায় মোহনবাগান, সেটিও হেলায় হাতছাড়া করেন পেট্রাটস, সহালরা।

ম্যাচের বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই যেন ম্যাচে রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, তীব্রতা কমতে থাকে। একটা সময় অপর পক্ষকে ফাইনাল থার্ডে না যেতে দেওয়াই হয়ে ওঠে দুই দলের প্রধান লক্ষ্য। মোহনবাগান ৬৫ মিনিটের মাথায় প্রথম পরিবর্তন করলেও ওডিশা রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে প্রথম খেলোয়াড় নামায় প্রায় ৮০ মিনিটের মাথায়। দিয়েগো মরিসিওর জায়গায় নামেন জাপানি ফরোয়ার্ড সাই গদার্ড। সম্ভবত ম্যাচের শেষের দিকে গোল করে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল দুই দলেরই।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে সহাল ও টাঙরিকে তুলে অভিষেক সূর্যবংশী ও অনিরুদ্ধে থাপাকে নামান হাবাস। মাঝমাঠকে আঁটোসাঁটো করার জন্যই সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত তাঁর।  

৮০ মিনিটের মাথায় বক্সের অনেকটা ভিতরে গিয়ে প্রায় ৮০ ডিগ্রি কোণ থেকে শট নেন, যা গোলকিপারের আটকাতে কোনও অসুবিধাই হয়নি। পরের মিনিটেই পেট্রাসের পাস পেয়ে বক্সের বাঁ দিক থেকে শট নেন কামিংস, যা ফের লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পাঁচ মিনিটের বাড়তি সময় দেন রেফারি। যার শেষ মিনিটে ডান দিক থেকে আশিস রাইয়ের ক্রসে হেড করে গোলে বল ঠেলে দেন কামিংস। কিন্তু তা দুরন্ত দক্ষতায় আটকে দেন অমরিন্দর। এর পরে আর স্কোরলাইন বদলায়নি।        

মোহনবাগান এসজি দল (৩-১-৪-২): বিশাল কয়েথ (গোল), আনোয়ার আলি, হেক্টর ইউস্তে, শুভাশিস বোস, দীপক টাঙরি (অনিরুদ্ধ থাপা-৮৫), আশিস রাই, জনি কাউকো, সহাল আব্দুল সামাদ ( অভিষেক সূর্যবংশী-৮৫), মনবীর সিং, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, আরমান্দো সাদিকু (জেসন কামিংস-৬৫)।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ         

বল পজেশন: ওডিশা এফসি ৪৬.৫% - মোহনবাগান এসজি ৫৩.৫%, সফল পাসের হার: ৭২%-৭৬%, গোলে শট: ২-৪, ফাউল: ১১-৮, ইন্টারসেপশন: ৮-৮, ক্রস: ১১-১২, কর্নার: ৫-৩, হলুদ কার্ড: ০-১।

ম্যাচের সেরা: শুভাশিস বোস