এটিকে-র সঙ্গে তাঁর একটা আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, প্রথমবার এটিকে-র হিরো আইএসএল জয়ের নেপথ্যে কোচ হিসেবে তিনিই ছিলেন।  এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কলকাতার দলকে ফের সেই খেতাব এনে দিলেন স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। কিন্তু এ বারে যে দলটা তিনি হাতে পেয়েছিলেন, তাদের একটা পরিবারের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এত ভাল পরিবার নিজের কোচিং জীবনে কখনও পাননি বলে জানালেন তিনি।

শনিবার ফতোরদায় এটিকে এফসি-কে তৃতীয় আইএসএল খেতাব এনে দেওয়ার পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে হাবাস বললেন, “আমার মনে হয়, এ বার আমাদের দলে ভারতীয় ফুটবলারদের সঙ্গে বিদেশী ফুটবলারদের মিশ্রণটা খুবই ভাল হয়েছে। তা ছাড়া আমি এতদিন ধরে কোচিং করছি। কোনও দলে মাঠে ও মাঠের বাইরে এত কম সমস্যা দেখিনি। আমাদের যে পরিবারটা তৈরি হয়ে উঠেছিল, সেই পরিবারে সমস্যা বলে তেমন কিছুই ছিল না। এটা দারুণ ব্যাপার। এটাই সাফল্যের রহস্য বলতে পারেন”।

এটিকে-র দলগত সংহতির দৃষ্টান্ত দিয়ে কোচ বলেন, “কার্ল ম্যাকহিউয়ের চোটটা আমাদের কাছে খুবই গুরুতর ছিল। কারণ, ও একসঙ্গে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার ও সেন্টার ব্যাকের জায়গাটা সামলাতে পারত। কিন্তু ওর বিকল্প পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল। তখন দলের সবাই মিলে ওর অভাবটা পূরণ করে দেয়। এটা কিন্তু একটা ভাল দলের বড় গুণ। সবাই মিলে যদি দলের সমস্যা মেটানো যায়, তার চেয়ে ভাল আর কিছুই হতে পারে না”।

শনিবার গোয়ায় দু’বারের চ্যাম্পিয়ন চেন্নাইন এফসি-কে ৩-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয় হিরো আইএসএল শিরোপা জিতে নেয় এটিকে এফসি। । গত দুই মরশুমে সেরা চারে উঠতে পারেনি তারা। এ বার হাবাস দলের দায়িত্ব নিয়েই গোটা দলটার চেহারা পাল্টে দেন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয়বার এটিকে-কে দেশের সেরা ফুটবল ক্লাবের খেতাব এনে দিলেন।

২০১৪ ও ২০১৫—এই দু’বছর এটিকে-র কোচের ভূমিকায় ছিলেন হাবাস। প্রথম বছরই ফাইনালে কেরালা ব্লাস্টার্সকে এক গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় কলকাতার দল। পরের বছর প্লে অফে উঠেও ছিটকে যায় তারা। ২০১৬-য় ফের চ্যাম্পিয়ন হয় এটিকে। তবে সে বার কোচের ভূমিকায় হাবাস ছিলেন না। ছিলেন প্রাক্তন ভিয়ারিয়েল ম্যানেজার ফ্রন্সিসকো মলিনা।

পরের দু’বারে যথাক্রমে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন স্ট্রাইকার টেডি শেরিংহ্যাম ও ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্রাক্তন স্ট্রাইকার স্টিভ কপেলের হাতে ছিল দল। কিন্তু কোনও বারেই প্লে-অফে উঠতে পারেনি জোড়া চ্যাম্পিয়নরা। যথাক্রমে নয় ও ছয় নম্বরে থেকে লিগ শেষ করে তারা। এ বার তাই মরশুম শুরুর আগে এটিকে ম্যানেজমেন্ট হাবাসকে ফের কোচের পদে ফিরিয়ে আনে ও তাঁর প্রত্যাবর্তনেই শুরু হয় তাদের সাফল্যের রাস্তায় ফেরার প্রক্রিয়া।

কলকাতায় ফিরে আসা নিয়ে হাবাস এ দিন বলেন, “ছেড়ে চলে গেলেও এটিকের সঙ্গে সবসময়ই আমার একটা ভাল সম্পর্ক ছিল। গত বছর মে-জুনে আমার হাতে যখন কোনও ক্লাবের প্রস্তাব ছিল না, তখন ওরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমি  রাজি হয়ে যাই। কারণ, এই ক্লাবটার জন্য আমার একটা বিশেষ অনুভূতি রয়েছে। আশা করি এই সম্পর্কটা বহু দিন বজায় থাকবে”।

এটিকে এফসি-র এ বারের খেতাব জয়টা সম্ভবত সেরা হয়ে থাকবে। কারণ, সারা লিগে দাপটের সঙ্গে খেলে চ্যাম্পিয়ন হল তারা। একবারের জন্যও সেরা চারের বাইরে বেরোয়নি তারা। হাবাসও প্রথমবারের সাফল্যের থেকে এ বারের সাফল্যটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চান। তিনি বলেন, “এ বারের জয়টা একেবারে অন্য রকম। প্রথমবার এতটা আইএসএলে এতটা পেশাদারিত্ব ছিল না, এত প্রতিযোগিতাও ছিল না। এখন এই লিগে অনেক ভাল কোচেরা এসেছেন, ভাল খেলোয়াড়রা খেলছে। লিগটাও এখন দীর্ঘ, দলও বেশি। যদিও প্রথমবারটা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়। তবু এ বারেরটা স্পেশ্যাল”।

শনিবার তাদের সেরা তারকা রয় কৃষ্ণাকে ছাড়াই ৫০ মিনিট খেলতে হয় এটিকে এফসি-কে। ঊরুর পেশীতে টান ধরায় ফিজির এই অলিম্পিয়ান ও ১৫ গোলের মালিককে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। তবে অসাধারণ দু’টি গোল করেছেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার হাভিয়ে হার্নান্ডেজ। প্রথম ও শেষেরটা। মাঝখানের গোলটা করেন এডু গার্সিয়া। এ দিন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান এটিকে-র গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্য। বেশ কয়েকটি অবধারিত গোল বাঁচিয়ে তিনি এ দিন দলকে চ্যাম্পিয়ন হতে দারুণ ভাবে সাহায্য করেন।

ফাইনালে দলের পারফরম্যান্স নিয়ে হাবাস বলেন, “প্রথমার্ধে আমরা অনেক ভাল খেলেছি। রয় কৃষ্ণা চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবধানটা ধরে রাখার মতো লোকের অভাব হচ্ছিল। তবে ফুটবলে গোলই শেষ কথা, যেটা আমরা আজ বেশি করতে পেরেছি। তবে ব্যবধানটা ধরে রাখতে পারবে কি না, দ্বিতীয়ার্ধে সেই চিন্তা ঢুকে পড়েছিল ছেলেদের মাথায়। চেন্নাই খুবই কঠিন বিপক্ষ। ওরা দ্বিতীয়ার্ধে খুবই পরিশ্রম করে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। তা ছাড়া দলের সেরা প্লেয়ার, অধিনায়ক ও ভাবে হঠাৎ চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় আরও মানসিক চাপে পড়ে যায় ওরা। তবে ভাল খেলতে না পারলেও ওরা কিন্তু দুর্দান্ত মানসিকতা দেখিয়েছে। এটাই ওদের কৃতিত্ব”।

সারা লিগে বিভিন্ন ফর্মেশনে দল সাজানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা নিয়ে হাবাস বলেন, “আমরা সারা লিগে ৮-৯ রকমের ফর্মেশনে খেলেছি। কখনও ৪-৩-৩, কখনও ৪-৩-১-২, কখনও বা ৩-৪-৩, আবার ৩-৫-২ বা  ৪-৪-২। তবে ৩-৫-২ নিয়েই বেশির ভাগ ম্যাচে খেলেছি, কারণ, আমাদের হাতে দুজন দুর্দান্ত স্ট্রাইকার ছিল রয় ও উইলিয়ামস। পরিস্থিতির ওপর বিচার করেই সিস্টেম ঠিক করেছি। যখন যে রকম পরিস্থিতি এসেছে, সে রকম সিস্টেমে খেলেছে আমাদের ছেলেরা এবং সবরকম সিস্টেমের সঙ্গে মানিয়েও নিতে পেরেছে। এটাই ওদের কৃতিত্ব”। 

এ দিন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দর্শকহীন স্টেডিয়ামে হয় ফাইনাল। এমন পরিবেশে ফাইনাল খেলাটা বেশ কঠিন বলে মনে করেন হাবাস। বলেন, “দর্শকহীন স্টেডিয়ামে খেলাটা মোটেই সহজ না। ছেলেদের আমি শুরু থেকেই বলে দিয়েছিলাম, কী ভাবে এই পরিস্থিতিতেও মোটিভেশন বজায় রাখতে হবে। একটা ফাইনালে খেলতে গেলে বাড়তি মোটিভেশন লাগে, বাড়তি মানসিক শক্তি লাগে। এই অবস্থায় সেটা নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হয়। তবে করোনা ভাইরাসের সমস্যাটা মারাত্মক। এর বিরুদ্ধে লড়াইকে আমাদের সমর্থন করতেই হবে। এটা ফুটবলের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ”।

আগামী মরশুমে শুধু এটিকে নয়, এটিকে-মোহনবাগানের কোচ হিসেবে কাজ করতে হবে তাঁকে। চলতি মরশুমে তারা ইতিমধ্যেই হিরো আইলিগে চ্যাম্পিয়নশিপ নিশ্চিত করে ফেলেছে। এখন থেকেই কোনও পরিকল্পনা করেছেন কি না, জানতে চাওয়ায় হাবাস বলেন, “পরের মরশুম নিয়ে এখনও কিছু ভাবিনি। তবে মোহনবাগান ভারতের অন্যতম সেরা ক্লাব। ওদের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন। দুটো সেরা ক্লাবকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হলেও লক্ষ্য একই থাকবে আমার”। এখন সেই লক্ষ্যেই হয়তো পথ চলা শুরু হবে ৬২-র এই স্প্যানিশ কোচের।