কলকাতা ডার্বিতে অসাধারণ এক হ্যাটট্রিক করে হিরো আইসএল অভিষেকেই যিনি সারা দেশের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন, সেই তরুণ স্ট্রাইকার যে শুধু সে জন্য খ্যাতি পেয়েছেন, তা নয়। তাঁর এক অন্য পরিচয়ও রয়েছে। তিনি প্রাক্তন ফুটবল তারকা জামশিদ নাসিরির সুপুত্র। বিখ্যাত পিতাদের ঐতিহ্য বহনকারী যোগ্য পুত্রদের অন্যতম কিয়ান নাসিরি-কে নিয়ে তাই গর্বের সীমা নেই জামশিদের।

ইরান থেকে ভারতে আসা জামশিদ ফুটবল জীবনে হয়ে উঠেছিলেন তখনকার বিদেশিদের মধ্যে অন্যতম সেরা। তবে এখন তিনি ভারতীয় নাগরিক। কলকাতায় থাকেন এবং কলকাতার ফুটবলের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছেন। ছেলে কিয়ানকে ছোটবেলা থেকেই তৈরি করেছেন নিজের মতো করে। বিখ্যাত বাবার যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে ওঠার চাপ নিয়ে বড় হওয়া কিয়ানকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয় ডার্বির ওই হ্যাটট্রিকই।

তার পর থেকে অবশ্য আর জামশিদপুত্র নন, নিজের আলাদা পরিচয়েই নিজেকে ক্রমশ উজ্জ্বল করে তুলেছেন কিয়ান। এটিকে মোহনবাগান দলের কোচের আস্থাও অর্জন করেছেন। দলে গুরুত্বও পাচ্ছেন। তবে এখনও অনেকটা পথ যে হাঁটা বাকি তাঁর, দিল্লি আভি দূর হ্যায়, তা খুব ভাল করেই জানেন ভারতীয় ফুটবলের এই নয়া তারকা। প্রথম মরশুমে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে এ বার তাঁর সামনে দ্বিতীয় মরশুমের পরীক্ষা। যে পরীক্ষা আরও কঠিন বলে মনে করেন তিনি।

তবে নিজেকে প্রতিদিন উন্নত করে তোলার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর তিনি। ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামার স্বপ্ন পূরণের সংকল্প নিয়ে শুরু করে দিয়েছেন দ্বিতীয় মরশুমের প্রস্তুতি। indiansuperleague.com কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজেই সে কথা জানিয়েছেন কিয়ান। মানসিকতার দিক থেকে কতটা পরিণত হয়ে উঠেছেন ২১ বছর বয়সি এই ফুটবলার, তা এই সাক্ষাৎকারেই বোঝা যায়। যার উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে দেওয়া হল।   

হিরো আইএসএলের অভিষেকে হ্যাটট্রিকের পর মাঠে ও মাঠের বাইরে তোমার জীবন কী ভাবে পাল্টেছে? ওই ম্যাচের পর থেকে বিপক্ষের খেলোয়াড়রা নিশ্চয়ই তোমাকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা করে মাঠে নামছে।

এ বছর ২৯ জানুয়ারি ডার্বি অভিষেকের পর থেকে আমার  জীবনে যে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে, তা বলব না। আগে যা যা করতাম, এখনও সেগুলোই করি। বেড়েছে শুধু দায়িত্ব। আমার দল, সমর্থকেরা এবং ক্লাবের কাছ থেকে যে ভালবাসা ও সমর্থন পেয়েছি, সে জন্য আমি প্রত্যেকের কাছে কৃতজ্ঞ। এখন আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। প্রতি দিন আমাকে আরও উন্নতি করতে হবে, যাতে গত মরশুমের চেয়েও এই মরশুমে আরও ভাল খেলতে পারি। আর আমাকে নিয়ে প্রতিপক্ষ পরিকল্পনা করে নামে কি না, জানি না। এটুকু বলতে পারি যে, তারা এখন মাঠে নেমে বুঝতে পারে, কে কিয়ান নাসিরি। এটাও তো কম বড় প্রাপ্তি নয়।

গত মরশুমে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে কোচ তোমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন। এই বাড়তি দায়িত্ব কি তুমি উপভোগ করো? নাকি চাপ আরও বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে?

অবশ্যই উপভোগ করি। এটাই তো আমি এখানে। আমি এখানে খেলতে এসেছি। দল ও কোচকে বোঝাতে এসেছি যে, আমি যদি পরিশ্রম করি এবং তাঁদের আস্থা অর্জন করি, তাঁরা যদি আমাকে নিয়মিত মাঠে নামার সুযোগ দেন, তা হলে প্রত্যেক ম্যাচেই নিজের সেরাটা উজাড় করে দেব। চাপ সামলে খেলাটা আমার দায়িত্ব। আশা করি, এই দায়িত্বটা আমি ঠিকমতো পালন করতে পারছি। এখন আমার সামনে লক্ষ্যটা আরও উঁচুতে এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে।

সামনে আরও দীর্ঘ মরশুম, যেখানে হিরো আইএসএল ছাড়াও আরও একাধিক টুর্নামেন্ট খেলতে হবে। এই মরশুমে তোমার লক্ষ্য কী? তা ছাড়া মরশুম দীর্ঘতর হওয়ায় ফুটবলারদের কী সুবিধা হবে বলে মনে হয়?

ফুটবল ও দলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যদি আরও পরিশ্রম করতে পারি, তা হলে আগামী মরশুমে প্রতি দিন আরও উন্নতি করার সুযোগ আমার সামনে রয়েছে।  তাই এই মরশুমে আমার লক্ষ্য থাকবে আরও পরিশ্রম করা ও খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে আরও উন্নত করে তোলা। এ বার বিভিন্ন টুর্নামেন্টে আরও বেশি সংখ্যক ম্যাচ খেলার সুযোগ পাব, যেটা আমার পক্ষে খুবই ভাল হবে। কারণ, যত বেশি মাঠে থাকব, তত ভাল করে দলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব এবং আসন্ন মরশুমে দলীয় পারফরম্যান্সেও আমরা আরও উন্নতি করতে পারব। তা ছাড়া মরশুম দীর্ঘ হলে রিকভারির জন্য আরও সময় পাব এবং ভুল শোধরানোর জন্যও বেশি সময় পাওয়া যাবে। সব দিক দিয়েই ব্যাপারটা খুবই ভাল হতে চলেছে।

এটিকে মোহনবাগান রক্ষণে দুজন বিদেশি ডিফেন্ডার যোগ দিচ্ছেন ফ্লোরেন্তিন পোগবা ও ব্রেন্ডান হ্যামিল। এর ফলে কি দলের রক্ষণের শক্তি আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে?

অবশ্যই। সেই জন্যই তো ওরা আমাদের দলে যোগ দিয়েছে। নিজেদের মধ্যে যখন বোঝাপড়াটা ভাল হয়ে যাবে, আমরা যখন দল হিসেবে ছন্দে চলে আসব, তখন আমরা দুর্দান্ত ফুটবল খেলব।

পোগবা দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে নিয়মিত খেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেজর লিগ সকারেও খেলে এসেছে। এই যে এত অভিজ্ঞতা নিয়ে একজন ফুটবলার এটিকে মোহনবাগান শিবিরে যোগ দিচ্ছে, তার কাছ থেকে কতটা কী শেখার আশা রয়েছে?

আমাদের দলের প্রায় প্রতি খেলোয়াড়েরই বিভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা আছে। প্রত্যেকের কাছ থেকেই কম বেশি অনেক কিছু শেখা যায়। ফ্লো-র মতো খেলোয়াড়ের সঙ্গে থাকাটা আমার কাছে যথেষ্ট সন্মানের। কারণ, ও ইউরোপের অন্যতম বড় লিগে এবং আমেরিকার লিগে দীর্ঘদিন খেলে তার পরে এখানে এসেছে। তবে সে কোথা থেকে এসেছে, শুধু সেটা বড় কথা নয়। যে অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে, সেটাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এর ফলে আমরাও অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারব ওর কাছ থেকে।

এশিয়ান কাপ ২০২৩ বাছাই পর্বে ভারতের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স নিয়ে কী বলবে? মূলপর্বে আমাদের দল কেমন করবে বলে মনে হয়? এই দলে ডাক পেতে তোমাকে কী কী করতে হবে বলে মনে হয়?

এমন এক অসাধারণ কীর্তি স্থাপন করার জন্য ভারতীয় দলকে আমার অভিনন্দন। মূলপর্বে তারা যাতে আরও ভাল ফল করতে পারে এবং সফল হয়, সে জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল। আমি ভারতীয় দলের সাফল্য নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। কারণ, ওরা যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে ও করে চলেছে, তার ফল ভাল হবেই বলে আমার বিশ্বাস। এই দলে জায়গা অর্জন করা আমার পক্ষে মোটেই সোজা হবে না। কারণ, আমি জানি দেশের সেরাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিতে এই সন্মান অর্জন করতে হবে আমাকে। এখন এটাই আমার পরীক্ষা। পরিশ্রম করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করা। দেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামাই আমার স্বপ্ন। সেই জায়গায় পৌঁছতে গেলে আমাকে যা করতে হবে, সবই করব।

আগামী মাসেই তোমাদের এএফসি কাপ ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালে খেলতে হবে এবং সেই ম্যাচ হবে কলকাতাতেই। নিজেদের মাঠে, সমর্থকদের সামনে খেলার সুবিধা পাওয়ায় তোমাদের ইন্টার জোনাল ফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা কি যথেষ্ট নয়?

সারা মরশুম দর্শকহীন গ্যালারির সামনে খেলার পরে এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে আমরা খেলেছিলাম যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে, সমর্থকদের সামনে। তখন যেন তাজা অক্সিজেন পেয়েছিলাম আমরা। নিজেদের সমর্থকে ঠাসা গ্যালারির সামনে খেলার তৃপ্তিই আলাদা। দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওই ম্যাচগুলোতে। সমর্থকদের চিৎকারে আমাদের জেতার খিদে ও শক্তি দুটোই বেড়ে যায়। তখন শুধু নিজেদের জন্য নয়, গ্যালারিতে থাকা প্রতিটি সমর্থকের জন্য জেতার তাগিদটা বেড়ে যায়। এ বারেও আশা করি, সে রকম কিছু হবে।