সাম্প্রতিক ব্যর্থতা ভুলে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে জয়ই এখন একমাত্র লক্ষ্য: ফেরান্দো
“গত দুটো ম্যাচে হায়দরাবাদ হয়তো খুব সহজ কোনও সুযোগ পায়নি। তবে ওদের ভাল দল এবং ভাল খেলছেও। ওরা একই পরিকল্পনা নিয়ে খেলে যাচ্ছে। একই কৌশল বজায় রাখছে। ফলে এই ম্যাচটা বোধহয় আমাদের পক্ষে কঠিন হবে। এই লিগে অ্যাওয়ে ম্যাচ সব সময়ই কঠিন”।
গত গত দুটি ম্যাচে (এএফসি কাপে) হারলেও তার আগে মরশুমের শুরু থেকে ১৫টি-র মধ্যে ১৩টি ম্যাচেই জেতে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। কিন্তু হঠাৎ চোট-আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়ায় এবং কয়েকজন নির্ভরযোগ্য ফুটবলারের পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা না থাকায় তাদের রেখচিত্র ক্রমশ নামতে শুরু করেছে। এক মাস পরে ফের ইন্ডিয়ান সুপার লিগে নামছে গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। এখন পর্যন্ত তারাই এই লিগের একমাত্র দল, যাদের সাফল্যের শতকরা হার একশো শতাংশ।
সম্প্রতি এএফসি কাপের দুই ম্যাচে হারের ফলে তাদের টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যেতে হয়েছে। এই ধাক্কা সামলে সবুজ-মেরুন শিবির আইএসএলে সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যে প্রশ্ন পরবর্তী ম্যাচের আগে রাখা হয় মোহনবাগানের স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দোর সামনে।
তিনি এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমরা পেশাদার। আমরা সামনের দিকে তাকাই। যা হয়েছে, তা নিয়ে আর বেশি কথা বলে লাভ নেই। এএফসি কাপে ব্যর্থতা খুবই হতাশাজনক। এতে আমাদের সবারই মন খারাপ হয়েছে। এখন আমাদের সামনে হায়দরাবাদ এফসি-কে হারিয়ে তিন পয়েন্ট জেতা ছাড়া আর কোনও লক্ষ্য নেই”।
মরশুমের শুরুতেই দুঃসংবাদ আসে মোহনবাগান শিবিরে, আশিক কুরুনিয়ান ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে চোট পেয়ে কার্যত সারা মরশুমের জন্যই ছিটকে গিয়েছেন। এখান থেকেই শুরু হয় মোহনবাগানের দুঃসময়। আশিকের পর চোট পেয়ে যান আনোয়ার আলিও। তিনিও কবে মাঠে ফিরবেন, এখনও কেউ নিশ্চিত নন। যিনি ক্রমশ ফর্মে ফিরছিলেন, সেই মনবীর সিংও চোট পেয়ে ছিটকে যান। অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার দিমিত্রিয়স পেট্রাটসও চোটের তালিকায় নাম লেখান গত সোমবারের ম্যাচের আগে। সব মিলিয়ে প্রথম দলের প্রায় চারজন ফুটবলারকে পাচ্ছে না সবুজ-মেরুন শিবির।
দলের এই চোট-আঘাত সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে ফেরান্দো বলেন, “যে খেলোয়াড়রা সুস্থ রয়েছে, তাদের নিয়েই পরিকল্পনা করছি। চোট-আঘাত ফুটবলে হয়েই থাকে। কোনও একজন-দুজনের নাম নিয়ে ভাবছি না। আমরা একটা দল হিসেবে কাজ করি। কখনও সফল হই, কখনও ব্যর্থতা আসে। তবে গত দুটো ম্যাচে আমাদের পারফরম্যান্সে আমি হতাশ। দিমিত্রির জন্য আরও দুদিন অপেক্ষা করব। আমার হাতে তো জাদু নেই। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করব। মেডিক্যাল স্টাফ কাজ করে চলেছে। কারা খেলার অবস্থায় আছে বা কারা নেই, এর ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। এটা জানার জন্য খেলা শুরু হওয়ার ২-৩ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় আমাদের। এ ক্ষেত্রেও করব”।
এএফসি কাপে শেষ দুই ম্যাচে হারের হতাশার মধ্যেও অবশ্য ইতিবাচক দিক খুঁজে পেয়েছেন তাদের স্প্যানিশ কোচ। দলের খেলোয়াড়দের লড়াই করার মানসিকতা। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গত ম্যাচে ছেলেদের লড়াকু মনোভাব দেখে আমার ভাল লেগেছে। আমরা হারছি, টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাব জেনেও শেষ দিকে ওরা যে ভাবে প্রতিপক্ষকে চাপে রেখেছিল, তা খুবই ইতিবাচক ও লড়াকু মানসিকতার পরিচয় দেয়। ওই সময় ওই লড়াইটা করা খুব কঠিন ছিল”।
আপাতত সাম্প্রতিক ব্যর্থতা ভুলে আইএসএল অভিযানে নজর ঘোরানোর পালা, যেখানে তারা এ পর্যন্ত সব ম্যাচেই জিতেছে। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে তাদের শনিবার ভুবনেশ্বরে তাদের হারাতে হবে হায়দরাবাদ এফসি-কে। লিগ তালিকার এগারো নম্বরে থাকা দলটি এখন পর্যন্ত কোনও ম্যাচে জয় পায়নি। তিনটি ড্র ও চারটি হার নিয়ে মাত্র তিন পয়েন্ট অর্জন করে তারা পাঞ্জাব এফসি-র ওপরে রয়েছে। তবু হায়দরাবাদের দলকে সমীহ করছেন ফেরান্দো।
প্রতিপক্ষকে নিয়ে তিনি বলেন, “কেরালার বিরুদ্ধে হায়দরাবাদ খুবই ভাল খেলেছে। ওরা একটা ছোট্ট ভুলের জন্য একটা গোল খায়। চেন্নাইনের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে ওরা ম্যাচ জেতার প্রচুর সুযোগ পেয়েছিল। গত দুটো ম্যাচে ওরা হয়তো খুব সহজ কোনও সুযোগ পায়নি। তবে ওদের ভাল দল এবং ভাল খেলছেও। ওরা একই পরিকল্পনা নিয়ে খেলে যাচ্ছে। একই কৌশল বজায় রাখছে। ফলে এই ম্যাচটা বোধহয় আমাদের পক্ষে কঠিন হবে। এই লিগে অ্যাওয়ে ম্যাচ সব সময়ই কঠিন। জামশেদপুরে খেলার সময়ও আমরা অনেক সমস্যায় পড়েছিলাম। হায়দরাবাদের বিরুদ্ধেও তা হতে পারে। খেলার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা হলেই তিন পয়েন্ট আসতে পারে”।
প্রতিপক্ষের বিশেষ কোনও খেলোয়াড়কে নিয়ে চিন্তিত নন মোহনবাগান কোচ। বলেন, “দলের ওপর আমার আস্থা আছে। আমার বিশ্বাস, ছেলেরা এই ম্যাচের জন্য তৈরি। তবে প্রতিপক্ষের কোনও দু-একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে আমি চিন্তিত নই। কারণ, খেলাটা এগারো বনাম এগারো হয়। তাই প্রতিপক্ষের পুরো দলকে নিয়ে ভাবি। জিতলে আমাদের দলই জিতবে। ওরা জিতলেও ওদের দল জিতবে”।
দলে গোল করার লোকের অভাব দেখা দিচ্ছে। গত দুই ম্যাচে সবুজ-মেরুন বাহিনী যেখানে সাত গোল খেয়েছে, সেখানে দিয়েছে মাত্র তিন গোল। জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকুরা দলকে সেইভাবে সাহায্য করতে পারছেন না, যে ভাবে তাদের কাছে প্রত্যাশা ছিল সবুজ-মেরুন সমর্থকদের। মনবীর ফর্মে ফিরতে শুরু করলেও লিস্টন কোলাসোর ফারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা নেই। সহাল সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। তিনি কোনও কোনও ম্যাচে জ্বলে উঠলেও বেশির ভাগ ম্যাচেই নিষ্প্রভ থাকছেন।
তবে ব্যক্তিনির্ভর হতে রাজি নন সবুজ-মেরুন কোচ। বলেন, “কোনও ক্ষেত্রেই কোনও একজনের ওপর দায়িত্ব থাকে না। আমরা আক্রমণে জায়গা তৈরি করছি। প্রত্যেকেই জায়গা তৈরি করতে পারছি। দলের স্ট্রাইকারের প্রথম কাজই হল জায়গা তৈরি করে, তাকে কাজে লাগিয়ে আক্রমণ করা। এই কাজটাই সবচেয়ে জরুরি। কে গোল করল, সেটা কিন্তু বড় কথা নয়”।
শনিবার হায়দরাবাদের হোম ম্যাচ হলেও তা হবে ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে। ফলে কোনও দলই পুরোপুরি ঘরের মাঠের সুবিধা পাবে না। অনিবার্য কারণে এই ভেনু পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে এর ফলে তারা কোনও বাড়তি সুবিধা পাবে বলে মনে করেন না ফেরান্দো। বলেন, “নিরপেক্ষ ভেনুর জন্য কোনও সুবিধা হবে না। এএফসি কাপেও একটা ম্যাচ আমরা ওখানে খেলেছিলাম। তাতে সুবিধা কিছু হয়নি। সুবিধা একমাত্র ঘরের মাঠে খেললেই হয়, যেখানে নিজেদের সমর্থকেরা সবাই উপস্থিত থাকে। আমাদের দুপক্ষের কাছেই ম্যাচটা কঠিন হবে। দুই দলেরই তিন পয়েন্ট দরকার”।
জানুয়ারির দলবদলে কাউকে আনার কথা ভাবছেন কি না জানতে চাইলে মোহনবাগান কোচ বলেন, “এখন আমার কাছে জানুয়ারির দলবদলের চেয়ে বেশি জরুরি হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে জয় ও তিন পয়েন্ট জেতা। মাঠের বাইরের বিষয় নিয়ে ভেবে শক্তিক্ষয় করতে রাজি নই। দলের ছেলেরা সবাই তৈরি আছে। কারও কারও চোট আছে। তারা প্রত্যেকেই চোট সারিয়ে ফিরে আসবে। তাই এখন এ সব নিয়ে ভাবছি না”।
দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকার আরমান্দো সাদিকু এ দিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। আইএসএলে চারটি ম্যাচের মধ্যে একটির বেশি গোল করতে পারেননি তিনি। কোনও অ্যাসিস্টও নেই আলবানিয়ার ইউরো কাপারের। তাঁর ফর্ম প্রত্যাশিত স্তরে পৌঁছতে না পারা প্রসঙ্গে সাদিকু বলেন, “সমর্থকেরা স্ট্রাইকারের কাছ থেকে সব ম্যাচেই গোলের আশা করেন ঠিকই। তবে কোচ যেমন বললেন, আমাদের কাজ জায়গা তৈরি করা ও তা কাজে লাগানো। আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের সেরাটা দিয়ে দলের জন্য গোল করার চেষ্টা করি। কখনও কখনও চেষ্টা করেও সফল হতে পারি না। তবু চেষ্টা করে যেতে হয়। আমি সেই জায়গায় পৌঁছনোর চেষ্টা করব অবশ্যই”।
সম্প্রতি দলের ফল ভাল না হলেও তাঁরা যে ঘুরে দাঁড়াবেন, এই ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ৩২ বথর বয়সী ফরোয়ার্ড। বলেন, “দলের পরিবেশ ভাল। একে অপরের মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। বিশেষ করে আমাদের, বিদেশিদের মধ্যে। কোচ যেমন বললেন, আমরা মানসিক ভাবে শক্তিশালী এবং শনিবারের ম্যাচে যদি আমরা জিততে পারি, তা হলে তা আমাদের এবং আমাদের সমর্থকদের পক্ষে ভাল হবে”।
নিজের সেরা জায়গায় যে নেই তিনি, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়ে সাদিকু জানান, “কখনও কখনও অন্য দেশে গিয়ে নতুন কোনও দলের হয়ে খেললে সমস্যা হয়। কিন্তু আমি এখানে এই দলের সঙ্গে ভালই মানিয়ে নিয়েছি। গত ম্যাচে সমর্থকেরা আমার কাছে থেকে আরও বেশি প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু আমরা কেউই সে দিন ভাল খেলতে পারিনি। আমি জানি, এই দলের জন্য আমাকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। এর আগে আমরা টানা ১০-১২টা ম্যাচ জিতেছি। আশা করি শনিবার থেকে আবার জেতা শুরু করব”।