দু’মাস পর গোল পেট্রাটসের, ওডিশাকে হারিয়ে দ্বিতীয় লিগশিল্ড মোহনবাগানের
২২ ম্যাচে ৫২ পয়েন্ট নিয়ে অন্য সব দলেরই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল মোহনবাগান। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এফসি গোয়া বাকি চার ম্যাচে জিতলেও সবুজ-মেরুন বাহিনীর নাগাল পাবে না।

গত মরশুমের ছবিই ফের দেখা গেল এ মরশুমেও। গতবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মুম্বই সিটি এফসি-কে হারিয়ে লিগশিল্ড জিতেছিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এ মরশুমেও ফের তারা সেই শিল্ড ফের জিতে নিল ওডিশা এফসি-কে হারিয়ে, সেই ঘরের মাঠেই। রবিবার কলিঙ্গবাহিনীকে ম্যাচের একেবারে শেষে দেওয়া গোলে আকাঙ্খিত জয় অর্জন করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই লিগসেরার খেতাব জিতে নিল তারা। আইএসএলের এগারো বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও দল পরপর দু’বার লিগসেরার শিরোপা অর্জন করল।
এ দিন মোহনবাগানকে দ্বিতীয়ার্ধের সংযুক্ত সময়ের দু’মিনিট পর্যন্ত আটকে রাখে ওডিশা এফসি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তিন মিনিটের মাথায় গোল করে দলকে লিগ শিল্ড এনে দেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, যিনি চলতি লিগে শেষ গোল করেছিলেন ২০ ডিসেম্বর, এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে। রবিবার এ মরশুমে তৃতীয় ও আইএসএলে ২৫ তম গোল করলেন তিনি এবং সেই গোলেই দল জিতে নিল লিগশিল্ড। চলতি লিগের ১৬তম জয়ের ফলে ২২ ম্যাচে ৫২ পয়েন্ট নিয়ে অন্য সব দলেরই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল মোহনবাগান। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এফসি গোয়া (২১ ম্যাচে ৪২) তাদের বাকি চার ম্যাচে জিতলেও সবুজ-মেরুন বাহিনীর নাগাল পাবে না। আইএসএলের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও দল ৫০-এর বেশি পয়েন্ট নিয়ে লিগশিল্ড জিতল।
এ দিন রীতিমতো দাপুটে পারফরম্যান্স দেখিয়ে ম্যাচ জিতে নেয় গতবারের শিল্ডজয়ীরা। কার্যত সারা ম্যাচেই রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে তাদের প্রায় শেষ পর্যন্ত আটকে রাখে ওডিশা। কিন্তু ৮৩ মিনিটের মাথায় জেমি ম্যাকলারেনকে অবৈধ ভাবে বাধা দিয়ে মুর্তাদা ফল লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার পরেই তাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং সেই সুযোগ নিয়েই বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত এক শটে জালে বল জড়িয়ে দেন ৭৮ মিনিটের মাথায় রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামা পেট্রাটস। আইএসএলে এই প্রথম কোনও সবুজ-মেরুন ফুটবলার ২৫ গোলের মাইলফলক স্থাপন করলেন। লিগে ২৫ গোলের মালিকদের ক্লাবে তিনি সপ্তম সদস্য।
এ দিন সারা ম্যাচে মোট ২৯টি শট নেয় মোহনবাগান। যেখানে ন’টি শট গোলে রাখে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড, সেখানে দু’টির বেশি শট লক্ষ্যে রাখতে পারেনি কলিঙ্গবাহিনী। সারা ম্যাচে যেখানে ২৭টি ক্রস বাড়ায় মোহনবাগান, সেখানে আটটির বেশি ক্রস দিতে পারেনি ওডিশার দল। প্রতিপক্ষের বক্সে ন’বারের বেশি বল ধরতেই পারেনি তারা। নাগাড়ে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার পর অবশেষে ম্যাচের একেবারে শেষ দিকে জয়সূচক গোলটি পায় মোহনবাগান।
এ দিন দুটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামায় কলকাতার দল। গ্রেগ স্টুয়ার্ট ও আশিস রাই দলে ফেরেন জেসন কামিংস ও দীপেন্দু বিশ্বাসের জায়গায়। ম্যাকলারেনকে সামনে রেখে ও কোলাসো, স্টুয়ার্ট ও মনবীরকে তাঁর পিছনে রেখে ৪-২-৩-১-এ দল সাজান কোচ হোসে মোলিনা। অন্যদিকে, চারটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামায় ওডিশা এফসি। দলকে ৪-৩-৩-এ সাজান তাদের কোচ সের্খিও লোবেরা। তাদের স্কোয়াডে এ দিন দিয়েগো মরিসিও, আহমেদ জাহু কেউই ছিলেন না।
প্রথম কোয়ার্টারে এ দিন কোনও দলই সে ভাবে আক্রমণে ওঠার ঝুঁকি নেয়নি। ওডিশার অর্ধেই বেশিরভাগ খেলা হলেও মোহনবাগানের আক্রমণকে সেভাবে দানা বাঁধতে দেননি মুর্তাদা ফলরা। জেমি ম্যাকলারেন, গ্রেগ স্টুয়ার্টদের কড়া পাহাড়ায় রাখেন তাঁরা। তবে দুই উইং দিয়ে লিস্টন, মনবীররা আক্রমণের চেষ্টা করেন। একটি করে শটও নেন তাঁরা। কিন্তু তা লক্ষ্যে ছিল না। ১৬ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া দীপক টাঙরির শট সেভ করেন ওডিশা গোলকিপার অমরিন্দর। তার আগে মনবীরের গোলমুখী শটও আটকান তিনি। সারা ম্যাচে আটটি সেভ করেন অমরিন্দর। এ মরশুমে তাঁর মোট সেভ-এর সংখ্যা দাঁড়াল ৭৫।
শুরু থেকেই বেশ রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে ওডিশা। তবে প্রথমার্ধ যত এগোতে থাকে ততই আরও রক্ষণাত্মক হয়ে ওঠে তারা। রক্ষণে যথাসম্ভব লোক বাড়িয়ে মোহনবাগান অ্যাটাকারদের আক্রমণ তৈরির জায়গাই দেয়নি তারা। ২৮ মিনিটের মাথায় ম্যাকলারেন বল নিয়ে প্রায় ফাঁকা বক্সে ঢুকে পড়লে তাঁকে বাধা দেন মুর্তাদা। পেনাল্টির জোরালো আবেদন করেও সাড়া পাননি সবুজ-মেরুন ফুটবলাররা। এর দু’মিনিট পরে ডানদিক দিয়ে বক্সে ঢুকে গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে গোলে শট নেন ম্যাকলারেন, যা অসাধারণ সেভ করেন অমরিন্দর।
প্রথমার্ধের শেষ দিকে ডানদিক দিয়ে একাধিক আক্রমণের চেষ্টা করেন মনবীর, টাঙরি। কিন্তু কোনওবারই সফল হননি। তবে ৪৫ মিনিটের মাথায় স্টুয়ার্ট ও ম্যাকলারেন সুবর্ণ সুযোগ পান। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে প্রথমে গোলে শট নেন স্টুয়ার্ট, যা অমরিন্দরের হাত থেকে ছিটকে আসে ছ’গজের বক্সের ডানদিকে থাকা ম্যাকলারেনের কাছে। তিনিও গোলে শট নেন। এ বারও সেভ করেন মোহনবাগানের প্রাক্তন গোলকিপার। প্রথমার্ধে যেখানে মোহনবাগানের পাঁচটি শট ছিল গোলে, সেখানে ওডিশা একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি।
দ্বিতীয়ার্ধেও শুরু থেকে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখে এবং ৫৪ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে তৈরি হওয়া আক্রমণে বক্সের বাইরে থেকে দেওয়া শুভাশিসের লম্বা ভলিতে হেড করে বল জালে জড়ানোর চেষ্টা করেন মনবীর। কিন্তু তা বারের ওপর দিয়ে চলে যায়। ৬০ মিনিটের মাথায় ডান উইং থেকে গ্রেগ স্টুয়ার্টের দেওয়া ক্রসে গোলের যে সুযোগ পান মনবীর, তা অবিশ্বাস্য ভাবে হাতছাড়া করেন তিনি। বক্সের মাঝখান থেকে গোলের বাইরে বল ঠেলেন তিনি।
ওডিশা বল নিয়ন্ত্রণে এনে খেলার গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। মোহনবাগানের ঘন ঘন আক্রমণে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে যায় তারা। এর মধ্যে ৬৩ মিনিটের মাথায় অবশ্য একটি ফ্রি কিক থেকে গোলের দিকে হেড করে সুযোগ তৈরি করেন মুর্তাদা ফল। কিন্তু তা আটকে দেন গোলকিপার বিশাল কয়েথ। এর দুমিনিট পরেই মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে বক্সের সামনে এসে গোলে শট নেন হুগো বুমৌস, যা ফের সেভ করেন বিশাল। এ দিন ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ডোরিয়েলটনকে কয়েকবার গোলের পাস বাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন প্রাক্তন সবুজ-মেরুন তারকা।
ম্যাচের ৭৪ মিনিটের মাথায় স্টুয়ার্টের কর্নার থেকে গোলের সুযোগ পেয়ে যান টম অলড্রেড, যা তিনি বারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেন। ৭৫ মিনিট পর্যন্তও গোল না পেয়ে মরিয়া হয়ে ওঠে মোহনবাগান। ড্রিঙ্কস ব্রেকের পরেই আশিস, টাঙরি ও অলড্রেডকে তুলে দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, দীপেন্দু বিশ্বাস ও অনিরুদ্ধ থাপাকে নামান বাগান কোচ। ৮০ মিনিটের মাথাতেই বাঁ দিক থেকে লিস্টনের ক্রসে ম্যাকলারেন শট নেওয়ার আগেই তা ক্লিয়ার করে দেন কার্লোস দেলগাদো। পরের মিনিটেই ডানদিক থেকে মনবীর গোলের সামনে বল পাঠালে, তাও গোলে ঠেলতে পারেননি ম্যাকলারেন।
৮৩ মিনিটের মাথায় গোলমুখী ম্যাকলারেনকে বক্সের ঠিক সামনে অবৈধভাবে বাধা দেওয়ায় মুর্তাদা ফলকে লাল কার্ড দেখান রেফারি এবং বক্সের ঠিক সামনেই ফ্রি কিক পায় মোহনবাগান। কিন্তু স্টুয়ার্টের ফ্রি কিক ওয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। ফিরতি বলেও বক্সের মধ্যে গোলের সুযোগ পান পেট্রাটস। কিন্তু তিনি বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেন। দশ জনে খেলা ওড়িশার বিরুদ্ধে আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে ৮৬ মিনিটের মাথায় স্টুয়ার্টকে তুলে কামিংসকে নামান মোলিনা।
ন’মিনিটের সংযুক্ত সময়ে গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সবুজ-মেরুন বাহিনী এবং নিজেদের গোলের সামনে প্রায় দেওয়াল তুলে দেয় ওডিশা। মোহনবাগানের লড়াইটা তখন ছিল সেই প্রাচীরে চিড় ধরানোর এবং সেই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত তাদেরই জয় হয়। ৯৩ মিনিটের মাথায় গোল করে সবুজ-মেরুন ব্রিগেডকে দ্বিতীয়বার শিল্ড জয়ের স্বাদ এনে দেন পুরনো ঘোড়া পেট্রাটস। বাঁদিক থেকে আশিক কুরুনিয়ানের সেন্টার বক্সের ডানদিকে পান মনবীর, যিনি বল পাঠান পেট্রাটসের কাছে। বল নিয়ে বক্সের সামনে চলে এসে তিনি কোণাকুনি শট নেন দ্বিতীয় পোস্টের দিকে। গতিপথ সামান্য বদলে বাঁ দিকের নীচের কোণ দিয়ে তাঁর সেই শট গোলে ঢুকতেই উল্লাসের বিস্ফোরণ ঘটে যুবভারতীর গ্যালারিতে।
উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা পেট্রাটস ছুটে যান গ্যালারির দিকে। সঙ্গে তাঁর সতীর্থরাও। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকা পেট্রাটসকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যান তাঁরা। এর পরে আরও সাত মিনিট খেলা হলেও ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা খুঁজে পায়নি কলিঙ্গ-বাহিনী। স্টেডিয়াম জুড়ে তখনই শিল্ডজয়ের উল্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই যা ফের কার্যত বিস্ফোরণে পরিণত হয়।
মোহনবাগান এসজি দল (৪-২-৩-১): বিশাল কয়েথ (গোল), শুভাশিস বোস, আলবার্তো রড্রিগেজ, টম অলড্রেড(দিমিত্রিয়স পেট্রাটস-৭৮), আশিস রাই (দীপেন্দু বিশ্বাস-৭৮), দীপক টাঙরি (অনিরুদ্ধ থাপা-৭৮), আপুইয়া, লিস্টন কোলাসো (আশিক কুরুনিয়ান-৮৬), গ্রেগ স্টুয়ার্ট (জেসন কামিংস-৮৬), মনবীর সিং, জেমি ম্যাকলারেন।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: মোহনবাগান এসজি ৫৬.৯% - ওডিশা এফসি ৪৩.১%, সফল পাসের হার: ৭৮%-৭৪%, গোলে শট: ৯-২, ফাউল: ৫-৯, ইন্টারসেপশন: ৬-৭, ক্রস: ২৭-৮, কর্নার:১২-২, হলুদ কার্ড: ১-১, লাল কার্ড: ০-১।
ম্যাচের সেরা: দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (মোহনবাগান এসজি)