ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে বড় ব্যবধানে জয় দিয়ে চলতি এএফসি কাপ অভিযান শুরু করার পর মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এএফসি কাপের সঙ্গে চলছে দেশের এক নম্বর লিগ আইএসএল-ও। এই লিগেও দুরন্ত ফর্মে থাকা মোহনবাগানের পক্ষে মলদ্বীপের মাজিয়া স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাবকে হারানো খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু খেলাটা যখন ফুটবল এবং প্রতিযোগিতা যখন মহাদেশীয় স্তরের, তখন আগে থেকে কিছু ধরে নেওয়াটা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। মোহনবাগান দুর্দান্ত ফর্মে আছে, এ মরশুমে ১১টি ম্যাচের মধ্যে দশটিই জিতেছে তারা, এটা যেমন ঠিক, তেমনই আবার মাজিয়াও তাদের শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই জিতে কলকাতায় পা রেখেছে। সুতরাং, তারাও যে দুর্বল দল, এ কথা একেবারেই বলা যায় না।

গত বছর সেপ্টেম্বরে এএফসি কাপের ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালে কুয়ালালামপুর এফসি-র কাছে ১-৩-এ হেরেছিল তৎকালীন এটিকে মোহনবাগান। ৯০ মিনিট পর্যন্ত এক গোলে পিছিয়ে থাকার পর ফারদিন আলি মোল্লার গোলে সমতা আনে তারা। কিন্তু স্টপেজ টাইমে পরপর দু’গোল খেয়ে ম্যাচ হেরে যায়।

গতবার ফাইনালের মুখ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে আসার পরে এ মরশুমে সবুজ-মেরুন বাহিনীর সামনে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এএফসি কাপ। তাই এ বছর ক্লাবের সঙ্গে নতুন চুক্তি করার পরই স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো বলে দেন, “আইএসএলে এ বারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য থাকবে এএফসি কাপে ভাল ফল করা”।

দুরন্ত ফর্মে সবুজ-মেরুন বাহিনী

সেই ভাল ফলের লক্ষ্যেই এ বার যাত্রা শুরু করেছে ফেরান্দো-বাহিনী। প্রাথমিক পর্বে ভূটানের পারো এফসি ও নেপালের মাচিন্দ্রা এফসি-কে হারানোর পরে তাদের মুখোমুখি হয় ঢাকার আবাহনী লিমিটেড। তাদের ৩-১-এ হারিয়ে অবশেষে গ্রুপ পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে মোহনবাগান এসজি। আর গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই তাদের শিকার হয় সুপার কাপ ২০২৩ চ্যাম্পিয়ন ওডিশা এফসি। কলিঙ্গ বাহিনীকে কার্যত ৪-০-য় গুঁড়িয়ে দেয় তারা। দুটি গোল আসে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের পা থেকে। সহাল আব্দুল সামাদ ও লিস্টন কোলাসো বাকি দুটি গোল করেন।

এএফসি কাপের এই ‘ডি’ গ্রুপে এখন মোহনবাগানই শীর্ষে। এই গ্রুপে ওডিশা এফসি ছাড়াও তাদের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস এবং মলদ্বীপের এফএ কাপ ও প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন মাজিয়া এসআরসি। সেই মাজিয়ার বিরুদ্ধেই সোমবার ঘরের মাঠে নামছে সবুজ-মেরুন বাহিনী।

মাঠে নামার আগে বরাবরের মতোই সতর্ক সবুজ-মেরুন কোচ হুয়ান ফেরান্দো। রবিবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “কালকের ম্যাচটা সহজ হবে না জানি। কিন্তু যেহেতু আমরা ঘরের মাঠে খেলব, তাই তিন পয়েন্ট জিততেই হবে আমাদের। আমাদের এই সপ্তাহে দুটো ম্যাচ খেলতে হবে। তবে এই মুহূর্তে এই ম্যাচটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য আমরা পুরোপুরি তৈরি। এই টুর্নামেন্টটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে প্রত্যেক ম্যাচে নামা খুবই জরুরি। না হলে ম্যাচ জেতা কঠিন হবে। এই ম্যাচে দলের খেলোয়াড়দের শারীরিক দিকের চেয়ে মানসিক দিকটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক ভাবে তারা কতটা তরতাজা হয়ে মাঠে নামবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। সেরাটা উজাড় করে দিতে হবে আমাদের”।

প্রতিপক্ষকে নিয়ে ফেরান্দো বলেন, “মাজিয়া আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছে। বসুন্ধরা কিংসের মতো দলকে হারিয়ে দিয়েছে। যে খেলোয়াড়রা এখন খেলছে ওদের দলে, তারা যথেষ্ট ভাল মানের। তবে ওদের নিয়ে বেশি না ভেবে নিজেদের দলেই বেশি মনোনিবেশ করতে চাই। ওদের কী ভাবে নিজেদের সেরা পারফরম্যান্স দেখাব, সেটা নিয়েই বেশি ভাবছি এখন”।

লড়াকু মাজিয়া এসআরসি

এর আগেও মাজিয়ার সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয়েছে মোহনবাগানের। সব মিলিয়ে ছ’বার। তার মধ্যে তিনটি ম্যাচে কলকাতার দলই জয়ের হাসি হেসেছে। মাজিয়া জিতেছে দু’বার। তবে এ বার ছবিটা পাল্টানোর পরিকল্পনা নিয়েই যে এসেছেন তাঁরা, তা জানিয়েই দিলেন তাদের কোচ মিলোমির সেসলিজা। রবিবার কলকাতায় এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা দুর্দান্ত একটা দলের বিরুদ্ধে খেলতে নামছি কাল। প্রতিপক্ষকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওরা যেমন আমাদের দুর্বলতা-শক্তি জানে, আমরাও ওদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। গত মরশুমে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, তার চেয়ে এ বার ভাল দল নিয়ে এসেছি। আশা করি, ভালই খেলব। ম্যাচটাকে আমরা উপভোগ করতে চাই”।

টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসকে ৩-১-এ হারিয়ে এই ম্যাচে নামছে মাজিয়া দেশের মাটিতে দিহেভি প্রিমিয়ার লিগেও যথেষ্ট ভাল ফর্মে আছে তারা। এর প্রভাব এএফসি কাপের এই ম্যাচে পড়বে না, এমনটাই ধরে নেওয়া উচিত।

গত ম্যাচে গোল করেন ভোজিস্লাভ বালাবানোভিচ, হাসান নাজিম ও আলি ফাজির। গোল পার্থক্যের বিচারেই তারা এখন মোহনবাগানের পরেই রয়েছে। তাদের ২৭ বছর বয়সী সার্বিয়ান ফরোয়ার্ড ভোজিস্লাভ বালাবানোভিচই এখন আক্রমণে তাদের প্রধান ভরসা। যে কোনও শক্তিশালী ডিফেন্সকেই কড়া পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারেন এই ফরোয়ার্ড।

এ ছাড়া গত আট মরশুম ধরে মাজিয়ায় খেলা মিডফিল্ডার হামজা মহম্মদকেও কড়া নজরে রাখাটা মোহনবাগান মিডফিল্ডার ও ডিফেন্ডারদের অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে উঠতে চলেছে। দলের নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার হাসান শিফাজ ইতিমধ্যেই মাজিয়ার হয়ে ১৪টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। শুধু রক্ষণ নয়, মাঝমাঠেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন তিনি। পেট্রাটস, জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকু, হুগো বুমৌসরা তাঁর নেতৃত্বাধীন রক্ষণের প্রাচীরে চিড় ধরানোর জন্য কী কী করবেন, তাও এই ম্যাচের আকর্ষণীয় বিষয়।

গতবার দলে কোনও বিশেষজ্ঞ স্ট্রাইকার না থাকায় দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকেই আক্রমণের সিংহভাগ সামলাতে হয়েছিল। তিনি সেই ভূমিকায় সফলও হন। এ বার অস্ট্রেলিয়ান বিশ্বকাপার জেসন কামিংস, আলবানিয়ার হয়ে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা আরমান্দো সাদিকু, ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস্য সহাল আব্দুল সামাদ থাকায় পেট্রাটসকে অনেকটা চাপমুক্ত হয়ে খেলতে দেখা যেতে পারে।

এএফসি কাপের নতুন নিয়ম অনুযায়ী ছ’জন বিদেশি একসঙ্গে মাঠে খেলতে পারেন। ফেরান্দোর হাতে যে ছয় বিদেশি রয়েছেন, তাঁদের সবাইকেই হয়তো তিনি খেলাবেন। ভুবনেশ্বরে পাঁচ বিদেশিকে প্রথম এগারোয় রেখে দল নামিয়েছিলেন ফেরান্দো। রক্ষণে ব্রেন্ডান হ্যামিল, হেক্টর ইউস্তে, মাঝখানে হুগো বুমৌস ও আক্রমণে আরমান্দো সাদিকু ও দিমিত্রিয়স পেট্রাটস।

সে দিন কামিংসকে বিরতির পরেই নামানো হয়েছিল সাদিকুর জায়গায়। এছাড়া আনোয়ার আলি ও শুভাশিস বোস ছিলেন রক্ষণে। অনিরুদ্ধ থাপা, সহাল আব্দুল সামাদ ও মনবীর সিং খেলেন দুই বিদেশি স্ট্রাইকারের পিছন থেকে। সোমবার কোচ সেই উইনিং কম্বিনেশ ভাঙবেন কি না, সেটাই দেখার। তবে যে দলই নামান না কেন, তাঁরা সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটাতে যে জান লড়িয়ে দেবেন, সেই ইঙ্গিত দিয়েই রাখলেন দলের অস্ট্রেলীয় ডিফেন্ডার ব্রেন্ডান হ্যামিল। বলেন, “আমরা আমাদের সেরাটা দিতেই বদ্ধপরিকর। বাকিটা পরিস্থিতি ও প্রতিপক্ষের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করছে”।

এএফসি কাপ, ২০২৩-২৪ গ্রুপ লিগ

ম্যাচ- মোহনবাগান এসজি বনাম মাজিয়া এসআরসি

ভেনু- বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা

কিক অফ- ২ অক্টোবর, সন্ধ্যা ৭.৩০

সম্প্রচার- স্পোর্টস ১৮, ফ্যানকোড অ্যাপ