প্রিভিউ: সাম্প্রতিক ফলের জন্যই না এগিয়ে মোহনবাগান, না চেন্নাইন এফসি
আইএসএল এমন এক লিগ, যেখানে অঘটন নিত্যদিনের ঘটনা। বেঙ্গালুরু এফসি-র কাছে মোহনবাগানের তিন গোলে হার এবং গত মাসে এফসি গোয়ার কাছে সবুজ-মেরুন বাহিনীর হার তেমনই অঘটন।

ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এবারের আইএসএলেও গতবারের শিল্ড খেতাব ধরে রাখার জন্য মরিয়া তারা। এ সব ঠিকই আছে। কিন্তু গত দুই ম্যাচে তাদের পারফরম্যান্সে যে অশনি সঙ্কেত দেখা দিয়েছে, তার পরে সাবধান না হলে তাদের সমস্যা হতে পারে, যেমন হয়েছে বেঙ্গালুরু এফসি-র। যেমন হয়েছে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি, ওডিশা এফসি, পাঞ্জাব এফসি-র।
এ পর্যন্ত ১৬টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র দু’টিতে হেরেছে যারা, তাদের অপ্রতিরোধ্য বলাই যায়। কিন্তু ফুটবল এমন একটা খেলা আর আইএসএল এমন এক লিগ, যেখানে অঘটন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। লিগের শুরুর দিকে বেঙ্গালুরু এফসি-র কাছে মোহনবাগান এসজি-র তিন গোলে হারা এবং গত মাসে এফসি গোয়ার কাছে সবুজ-মেরুন বাহিনীর ১-২-এ হারা তেমনই অঘটন। এমন অঘটন যে ফের ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
মঙ্গলবার যাদের বিরুদ্ধে নামবে মোহনবাগান এসজি, সেই চেন্নাইন এফসি এমন একটা দল, অনিশ্চয়তা যাদের বরাবরের সঙ্গী। কোন ম্যাচে কী রকম খেলতে পারে তারা, তার কোনও রকম আন্দাজই দেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। গত চার ম্যাচে জয়হীন তারা। গত দুই ম্যাচে দু’গোলে এগিয়ে গিয়েও হেরেছে আওয়েন কোইলের দল। তার আগে জামশেদপুর এফসি, নর্থইস্ট ইউনাইটেড, ওডিশার মতো দলকে হারিয়েছে তারা। এ রকম একটা দলের বিরুদ্ধে যে কোনও দলের যে কোনও রকম ফলই হতে পারে।
পুরনো রোগের প্রত্যাবর্তন!
গত শুক্রবার জামশেদপুরে দাপুটে ফুটবল খেলেও ইস্পাতনগরীর কঠিন পরীক্ষা জিততে পারেনি মোহনবাগান। ফল ১-১ রেখে ম্যাচ শেষ করে তারা। প্রথমার্ধে দাপট থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে সেই দাপট সে ভাবে বজায় রাখতে পারেনি সবুজ-মেরুন বাহিনী। পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় ইস্পাত-বাহিনী। তাই ব্যবধান ধরে রাখতে পারেনি গতবারের শিল্ড চ্যাম্পিয়নরা। সারা ম্যাচে ১৬টি গোলের সুযোগ তৈরি করেও একটির বেশি গোল করতে পারেনি তারা। পাঁচটির বেশি শটও লক্ষ্যে ছিল না তাদের।
তার আগে কলকাতা ডার্বিতে তাদের সমর্থকদের মন ভরিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি সবুজ-মেরুন বাহিনী। সে দিনও ১১টি গোলের সুযোগ তৈরি করে মোহনবাগান। কিন্তু একটির বেশি গোল করতে পারেনি। নিয়মিত সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার রোগ লিগের শুরুর দিকে ছিল তাদের। মাঝখানে সেই রোগ সেরে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছিল। চলতি লিগে ১৬ ম্যাচে ৩১ গোল করেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি ম্যাচে প্রায় দু’গোল করে দিয়েছে তারা। কিন্তু গত দুই ম্যাচে তাদের গোলের সুযোগ নষ্ট করার বহর দেখে প্রশ্ন উঠছে, টানা সাফল্য কি তাদের আত্মতুষ্ট করে তুলেছে? সত্যিই যদি তা হয়, তা হলে চেন্নাইন কিন্তু তাদের চোখ খোলার জন্য তৈরি।
প্রস্তুতির সময়ের অভাব!
দু-একজন বাদে দলের সবাই প্রায় ফিট। তাই দল বাছাই নিয়ে কোচ হোসে মোলিনাকে তেমন কিছুই ভাবতে হচ্ছে না। তবে যেহেতু চারদিনের মধ্যে দু’টি অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে হচ্ছে তাদের, তাই এই দলের কয়েকজনকে বিশ্রাম দেওয়ার কথাও ভাবতে পারেন কোচ মোলিনা। দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, গ্রেগ স্টুয়ার্টদের হয়তো প্রথম এগারোয় দেখা যেতে পারে।
এত কম সময়ে পরপর ম্যাচ নিয়ে মোলিনা বলেন, “একদিনের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় ঠিকই। তবে এত দীর্ঘ লিগে মাঝেমধ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতেই পারে। তবে এই নিয়ে খুব একটা চিন্তার কিছু নেই। কী করতে হবে আমাদের, তা জানা আছে। চেন্নাইনের বিরুদ্ধে নিজেদের সেরাটা দিতে হবে। যেমন জামশেদপুরের বিরুদ্ধে আমরা দিয়েছি। ওই ম্যাচে ড্র হলেও ওটা এ মরশুমে আমাদের অন্যতম সেরা ম্যাচ ছিল। সে জন্য দলের ছেলেদের নিয়ে আমি গর্বিত”।
রক্ষণই চেন্নাইনের দুর্বলতা?
সম্প্রতি যে ভাবে চেন্নাইন এফসি-র মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেয় মহমেডান স্পোর্টিং, তা অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে। ম্যাচের শেষে সংযুক্ত সময়ে রীতিমতো জ্বলে ওঠে তারা। ৯০ মিনিট পর্যন্ত ২-০-য় চেন্নাইন এগিয়ে থাকার পরেও মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে পরপর দুই গোল দিয়ে ম্যাচ ২-২ ড্র রেখে মাঠ ছাড়ে সাদা-কালো ব্রিগেড। তার আগের ম্যাচেও ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে দু’গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরে ড্র করে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল আওয়েন কোইলের দলকে।
তাই চেন্নাইন এফসি-র রক্ষণ শেষ পর্যন্ত নিজেদের দূর্গ অক্ষত রাখতে পারছে না, এই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। রক্ষণে শক্তি বাড়ানোর জন্যই সম্ভবত মোহনবাগানের প্রাক্তনী প্রীতম কোটালকে কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে নিয়ে এসেছে চেন্নাইন এফসি। তাঁকে মঙ্গলবার কী ভাবে কাজে লাগানো হয়, সেটাই দেখার। যদিও গত ম্যাচে লাল কার্ড দেখায় এই ম্যাচে মাঠে থাকবেন না কোইল।
গত ম্যাচে ৮৫ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য থাকার পর ৮৬ মিনিটের মাথায় কামিংসের গোলে জয় পায় মোহনবাগান এসজি। সেই ম্যাচের কথা মনে করিয়ে দিতে মোহনবাগান কোচ বলেন, “গত ম্যাচে চেন্নাইন আমাদের বেশ ভুগিয়েছিল। জেসন শেষ দিকে গোল করে আমাদের জিতিয়েছিল। ওদের বিরুদ্ধে খেলা মানে কঠিন পরীক্ষা। প্রতিপক্ষ হিসেবে ওরা বেশ শক্তিশালী। ওরা হয়তো প্রতি ম্যাচে গোল খাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়াতেও পারছে না। তবে আমি নিশ্চিত ওদের বিরুদ্ধে ম্যাচ সোজা হবে না”।
পরিসংখ্যান-তত্ত্ব
এ বার প্রথম লিগে চেন্নাইন এফসি-কে হারায় মোহনবাগান। এ বারও তারা জিতলে লিগ ডাবল হবে। আইএসএলে চেন্নাইয়ের দলের বিরুদ্ধে কখনও লিগ ডাবল করতে পারেনি সবুজ-মেরুন বাহিনী। তারা এবং মুম্বই সিটি এফসি ছাড়া আইএসএলের অন্য সব দলের বিরুদ্ধেই এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে তারা। শেষ তিনটি অ্যাওয়ে ম্যাচেই গোল খেয়েছে তারা। মঙ্গলবারও যদি গোল খায় তারা, তা হলে আইএসএলে টানা সবচেয়ে বেশি অ্যাওয়ে ম্যাচে গোল খাওয়ার ক্লাব-নজির গড়বে তারা। ২০২২-এর অক্টোবর-নভেম্বরে টানা তিনটি অ্যাওয়ে ম্যাচে ক্লিন শিট না থাকাই ছিল এর আগে সর্বোচ্চ। চলতি লিগে মোহনবাগান তাদের প্রতিপক্ষের বক্সে গড়ে প্রতি ম্যাচে ২৫.৯ বার করে বল ছুঁয়েছে, যা সর্বোচ্চ। এর মোট সংখ্যাটা হল ৪১৫। চারশোর ওপর এখন পর্যন্ত কেউ যেতে পারেনি এই লিগে।
গত চারটি ম্যাচে জয়হীন থেকেছে চেন্নাইন এফসি। এর চেয়েও বেশি সংখ্যক ম্যাচে অবশ্য ধারাবাহিক ভাবে জয়হীন থেকেছে তারা। ২০২২-এর ডিসেম্বর থেকে ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা আটটি ম্যাচে জয়হীন ছিল তারা। শেষ দুই হোম ম্যাচেই একাধিক গোল খেয়েছে তারা, ওডিশার বিরুদ্ধে দু’গোল ও বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে চার গোল। ২০১৮-১৯-এ তারা টানা তিনটি হোম ম্যাচে আট গোল খেয়েছিল। তাদের দলের তারকা কোর শিল্ডস এ পর্যন্ত আটটি অ্যাসিস্ট দিয়েছেন। আইএসএলের একই মরশুমে দশ বা তার বেশি অ্যাসিস্ট করা খেলোয়াড়দের তালিকায় তিন নম্বরে জায়গা থেকে আর দুই ধাপ দূরে তিনি। তাদের নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড ড্যানিয়েল চিমা চুকুউ আইএসএলে কলকাতার কোনও দলের বিরুদ্ধে কোনও গোল অবদান রাখতে পারেননি।
দ্বৈরথের ইতিহাস
ইন্ডিয়ান সুপার লিগে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ৯ বার। চারটিতে জিতেছে কলকাতার দল। দু’টিতে চেন্নাইন এফসি। বাকি তিনটি ড্র হয়েছে। দুই দলের মধ্যে ম্যাচে মোট ১৭টি গোল হয়েছে। দশটি দিয়েছে কলকাতার দল ও সাতটি চেন্নাইন এফসি। ২০২২-২৩-এর আইএসএলেই সবুজ-মেরুন বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম জয়টি পায় চেন্নাইয়ের দল। দ্বিতীয় লেগে গোলশূন্য ড্র হয়। ২০২০-২১ মরশুমে প্রথম লেগে গোলশূন্য ড্র হয়। দ্বিতীয় লেগে এটিকে মোহনবাগান ১-০-য় জেতে। ২১-২২ মরশুমে প্রথম ম্যাচে ১-১ হওয়ার পরে দ্বিতীয় বার কলকাতার দল ১-০-য় জেতে। গত মরশুমের প্রথম সাক্ষাতে ৩-১-এ জেতে মোহনবাগান। দ্বিতীয় সাক্ষাতে ৩-২ গোলে জয় পায় চেন্নাইন এফসি। এটি ছিল আইএসএলে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে তাদের দ্বিতীয় জয়। এ মরশুমের প্রথম দেখায় মোহনবাগান জেতে ১-০-য়।
ম্যাচ- চেন্নাইন এফসি বনাম মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট
ভেনু- জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম, চেন্নাই
সময়- ২১ জানুয়ারি, ২০২৪, সন্ধ্যা ৭.৩০
সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং
স্পোর্টস ১৮-৩- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল ও স্পোর্টস ১৮-২- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮-১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ; জিও সিনেমা- বাংলা, হিন্দি, ইংলিশ, মালয়ালাম